বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

কবি সিকান্দার আবু জাফর

| প্রকাশের সময় : ২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. গুলশান আরা
ভাষা, ছন্দ, শব্দ দিয়ে কবিরা কবিতা লেখেন। নির্বাচিত শব্দ ব্যবহার করেন পাঠকের কল্পনা শক্তিকে উসকে দেয়ার জন্য। শব্দ কবির চেতনার বাহন হিসেবে কাজ করে। কবিতার ভাবটি আবেগ হয়ে পাঠকের মনে সাড়া জাগায়। সমাজ এবং সংসারের প্রত্যক্ষ সংঘাতের অভিজ্ঞতাকেও কবি ব্যক্ত করেন তার কবিতায়- তার কাব্যে শব্দের আবেগময় প্রকাশে।
তেমনি একজন শব্দসচেতন, সমাজসচেতন সংগ্রামী কবি সিকান্দার আবু জাফর। তিনি তার কাব্যের মূল সুর খুঁজেছেন সমাজ সংঘাতের দুঃখ বেদনার মধ্যে। বক্তব্যে স্পষ্টভাষী এবং মেজাজে বলিষ্ঠ হওয়ার পক্ষপাতী সিকান্দার আবু জাফর। এ ধাঁচটি নজরুলের কাব্যাদর্শ থেকে এসেছে। চল্লিশ দশকে যাদের কবি জীবনের সূত্রপাত তারা জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে নজরুলের প্রভাব বলয় ছিন্ন করতে পারেননি। তবুও তার বক্তব্যকে অনায়াস নির্ভাবনায় প্রকাশ করতে সচেষ্ট সিকান্দার আবু জাফর। তার সময়ের বিকার ও অন্যায়কে একটি পরিহাস তিক্ততার মধ্যে প্রকাশ করেছেন কবিতায়।
সিকান্দার আবু জাফরের কাব্যগ্রন্থ ‘বৈরী বৃষ্টি’তে প্রথম কবিতার শেষ স্তবকের লাইনগুলো এরকম-
‘ধ্বংসের রাহু পেয়েছে রাজ্যতার।
বিশ্ব মানবতার-
দিক্্ দিগন্তে একি ক্ষমাহীন ব্যাভিচার?
স্তব্ধ কৌতূহলে-
অতীত যুগের পাতা ছিঁড়ে একে একে
ভাসাই তিক্ত বিস্মরণের জলে!’
এমন বিষাত্মক স্বগতোক্তি বাংলা কাব্যে নূতন নয়। কবি হৃদয়ের ক্ষোভ স্পন্দন বাঙালি পাঠক বহু শুনেছেন। তবে সিকান্দার আবু জাফরের এই উক্তি যেন কিছুটা অভিনব ঠেকলোÑ কারণ এই সত্যের ভাষ্যকার হওয়ার যোগ্যতা তার ¯œায়ুর অবিমিশ্র উপাদান। জীবনকে আলোড়িত করেই এই সত্য প্রকাশিত। তাই ‘দিক দিগন্তে’ শুধুমাত্র ‘ব্যভিচার’ দেখেই সময় কাটাতে পারেননি কবিÑ বিক্ষুব্ধ হয়ে উচ্চারণ করলেন দুটো বিশেষণÑ ‘ক্ষমাহীন’ ও ‘অকণ্ঠ’। এ উচ্চারণ শুধু মৌখিক আস্ফালন নয়, কবির চেতনা স্পন্দিত বিক্ষোভ এতেও সন্তুষ্ট না থাকতে পেরে নিজের অবিভাজ্য ব্যক্তি সক্রিয়তায় অবশেষে অতীতের পাতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে বিস্মরণের জলে ভাসিয়ে স্বস্তি পেলেন যেন। এই আত্মগত চেতনা ও সেই সঙ্গে বলিষ্ঠ বক্তব্যের যে সুরস্বতন্ত্র বিশেষত্ব সিকান্দার আবু জাফরের মধ্যে বিদ্যমান তা-ই তাকে নজরুল সংলগ্নতা থেকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করেছে। অবশ্য এই আত্মগত সুর যা শিল্পম-িত করার সুযোগ তার হাতে এসেছিল, তা তিনি ক্ষেত্রবিশেষে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করলেও সব ক্ষেত্রে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেননি। দেখা গেছে, কখনও তিনি উচ্চকণ্ঠ, উপাদান ব্যবহারে নির্বিচার, কাব্যের শিল্পসত্তা সম্পর্কে একেবারে বেপরোয়া।
‘ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখবে
চাউল এসেছে ঘরে-
তেল নুন চিনি অনেক এসেছে আরো
দুধ মাছ আর খাসির মাংশ
এনেছি জোগাড় করে।
সারাটা সকাল তোমার জননী-
রান্নায় মশগুল।
(এখন তুমি ঘুমাও/সমকাল)
যদিও সিকান্দার আবু জাফরের কবিতায় ছন্দ ও শব্দের ব্যবহারে একটা উজ্জ্বল সাবলীলতা আছেÑ তা সত্ত্বেও অনেক সময়েই তিনি গদ্য ও পদ্য উপাদানের পার্থক্য সম্পর্কে বেশ অসচেতন এবং অসাবধান।
কবিরা জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাদের ধ্যান-ধারণা ব্যক্ত করবেন এটাই প্রত্যাশা। কবি কী ধরনের কথা বলছেন, কীভাবে বলছেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ এবং বিবেচনার বিষয়। বাচন ভঙ্গিকে চিহ্নিত করা হয় আঙ্গিক হিসেবে। কবিতায় শিল্প গুণের প্রকাশ পায় ভাষায়, ইঙ্গিতে আর শব্দ ব্যঞ্জনায়। কবিরা নিরাকার ভাবকে সকার করেন উপযুক্ত শব্দ চয়নে। কিন্তু সিকান্দার আবু জাফর বার বার স্খলিত হয়েছেন কবিতার এই শিল্প সৌন্দর্য থেকে। যাপিত জীবন ধারণা পাঠকের মনে সঞ্চারিত করার অভিপ্রায় তাকে উত্তেজিত-উদ্বেলিত করেছে ঠিকই, কিন্তু সুস্থিরতার অভাব বোধে কবিতা হয়েছে গদ্যধর্মী। এই একই কারণে সিকান্দার আবু জাফরের ছন্দও প্রায়ই অত্যন্ত গদ্যধর্মী। ‘ঈদের চিঠি’তে কবি লিখেছেন-
‘বাপজান-
ঈদের সালাম নিও। দোয়া কোরো আগামী বছর
কাটিয়ে উঠতে পারি যেন এই তিক্ত বছরের
সমস্ত ব্যর্থতা।
অন্তত: ঈদের দিনে সাদাসিদে লুঙ্গি একখানি
একটি পাঞ্জাবি আর সাদা গোলটুপি
তোমাকে পাঠাতে যেন পারি;
আর দিতে পারি পাঁচটি নগদ টাকা
এই টুকু পেলে-
দশজন পড়শীর মাঝে
পুত্রের কৃতিত্ব ভেবে দু’টি অন্ধ চোখে
হয়তো আসবে ফিরে দৃষ্টির সান্ত¦না।’
কাব্যের কাব্যগুণ, শিল্পের শিল্প সৌন্দর্য সাহিত্যের মানদন্ডে অপরিহার্য বিবেচনা। শিল্পের বিচার এই ত্রুটিকে ক্ষমা করে না।
কবিতা একাধারে মনকে বিস্তৃত করে, কানকে সচেতন করে শব্দের ধ্বনি ব্যঞ্জনার পরিম-লে। তাই কবিতা মামুলী ব্যাপার না হয়ে- হয়ে ওঠে শ্রাবন্তীর কারুকাজের মতো কঠিন আর অনিন্দ্য সৌন্দর্যের বাণীরূপ। প্রেম যখন ব্যক্তি থেকে নির্বিশেষে পরিব্যাপ্ত হয়, তখন শিল্প সুষমা ফুটে ওঠে। এক্ষেত্রে বলিষ্ঠ মেজাজ অথবা স্পষ্ট বক্তব্যের প্রয়োজন খুব জরুরি নয়। অথচ সিকান্দার আবু জাফরের প্রেমের কবিতাতেও এ ধাঁচটিও লক্ষ্যণীয়। যেমনÑ
‘তাকাতেই দেখি নাগালের গ-িতে
ইঙ্গিত আঁকা অমৃত কুম্ভ
তুমিই প্রথমে মেলেছো আমন্ত্রণ-
মুহূর্তে তুমি প্রিয়া,
এবং তোমাকে আত্মদানের তখুনি উদ্দামতা।’
সুখের কথা এই যেÑ সিকান্দার আবু জাফর কোনো নির্দিষ্ট গ-িতে বা ছকে বাঁধা পড়ে থাকেননি। চল্লিশের দশক থেকে কবিতা লিখতে শুরু করেন। সৃষ্টিশীলতা অব্যাহত রেখে বিশেষ করে সময়ের প্রবাহমানতার সঙ্গে শুধু বিষয়ে নয়, আঙ্গিকের পরিবর্তনেও যোগ স্থাপনে সচেষ্ট। এখানেই তিনি সজীব কবি। তার কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা ১৩৭২’ স্পষ্টতই সিকান্দার আবু জাফরের পালা বদলের উজ্জ্বল স্বাক্ষর।
কবিতায় তার এগিয়ে চলার কথাই বলে। এর পরেও তার লেখা নূতন কবিতার প্রায় প্রত্যেকটিতে যেন খোলস খুলে খুলে যুগের কাছাকাছি ধাপে ধাপে এগিয়ে গেছেন। বক্তব্য, ভাষা ও শিল্প চেতনার প্রতি স্তরেই তার এই পরিপক্বতা লক্ষণীয় হয়ে ধরা পড়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে সিকান্দার আবু জাফর হয়ে উঠেছেন পরিণততর কবি। কবিতায় যুগ যন্ত্রণার প্রতিফলন তাকে ঋদ্ধ করেছে/কাজী নজরুল ইসলামের মতো সিকান্দার আবু জাফরও সঙ্গীত রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। বহু জনপ্রিয় গানের ¯্রষ্টা তিনি। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উদ্দীপনা সঙ্গীত ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’ গানটিও তার লেখা। এটি তিনি লিখেছিলেন ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সময়।
‘আমাদের চোখে চোখে লেলিহান অগ্নি-
সকল বিরোধ-বিধ্বংসী।
এই কালো রাত্রির সুকঠিন অর্গল
কোন দিন আমরা যে ভাঙবোই
মুক্ত প্রাণের সাড়া অনবোই
আমাদের শপথের প্রদীপ্ত স্বাক্ষরে
নূতন সূর্যশিখা জ্বলবেই।
চলবেই চলবেই
আমাদের সংগ্রাম চলবেই।’
একজন বিপ্লবকামী কবি হিসেবে অসংখ্য গণসংগীত লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন কবি। প্রথমদিকে কলকাতায় ‘দৈনিক নবযুগে’ সাংবাদিকতা শুরু। দেশ বিভাগের পর রেডিও পাকিস্তানে চাকরি গ্রহণ। ১৯৫৩-এ দৈনিক ইত্তেফাকের সহযোগী সম্পাদক, ১৯৫৪-এ দৈনিক মিল্লাতের প্রধান সম্পাদক এবং ১৯৫৭-১৯৭০ পর্যন্ত মাসিক ‘সমকাল’  (সেপ্টেম্বর-১৯৫৭) পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। পঞ্চাশের দশকে ‘দৈনিক মিল্লাত’-এর সম্পাদক ছিলেন সিকান্দার আবু জাফর। শোনা যায়, ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়ার মালিকানাধীন ‘দৈনিক মিল্লাত’ পত্রিকার মুদ্রণ প্রমাদ তখন ছিল এক প্রকার হাস্যরসের উৎস। সম্পাদক সাহেব এই দুর্নাম ঘোচাতে ছিলেন স্থিরচিত্ত। মুদ্রণ প্রমাদকারীকে চিহ্নিত করে তার ওই দিনের বেতন মাসিক বেতন থেকে কেটে হলেও মুদ্রণ প্রমাদ শুদ্ধ করার নির্দেশ দেন। সফল সম্পাদক কোনো গাফিলতির প্রশ্রয় দিতে পারেন না- এটাই সত্য। সিকান্দার আবু জাফর পত্রিকা সম্পাদনায় সাফল্যের পরিচয় দেন।
‘রুবাইয়াৎ- ই-ওমর খৈয়াম’ অনুবাদ প্রসঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলী মন্তব্য করেন ‘কাজীর অনুবাদই (কাজী নজরুল ইসলাম) সকল অনুবাদের কাজী। তা সত্ত্বেও সিকান্দার আবু জাফরের ওমর খৈয়াম অনুবাদ যথেষ্ট কৃতিত্বের দাবিদার। নাট্যকার হিসেবেও তিনি বাংলা সাহিত্যে অবদান রেখেছেন। তার লেখা ঐতিহাসিক নাটক ‘সিরাজদৌল্লা’র একটি বিশেষ বৈশিষ্ট হলো মীর জাফর চরিত্রে অতি নবতর দৃষ্টিভঙ্গির আরোপ। সংলাপ ঐতিহাসিক আবাহ সৃষ্টিতে সক্ষম। ‘মহাকবি আলাওল’ তার একটি জীবনীভিত্তিক নাটক। এ নাটকে তিনি ঐতিহাসিকতার চেয়ে কল্পনার উপরে অধিক নির্ভরশীল। ১৯৬৬-তে নাটকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
আধুনিক কবিতা মানুষের অনুভূতিতে বিপ্লব এনেছে, গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মূল্য নিরূপনের পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটিয়েছে, পৃথিবীকে নতুন বিশ্বাস ও বিস্ময়ে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। আমাদের অস্তিত্বের অতলে অনবরত কত যে অনুভূতি আমাদের দেহে ও মনে উত্তাপ এনেছে, তাকে বোধের আয়ত্তে আনার নিরন্তর চেষ্টা করেছেন আধুনিক কালের কবিগণ। তাই তাদের সুরে ও শব্দে বিচিত্র কৌশল, আশ্চর্য দুরূহতা এবং অপরিচয়ের তাৎপর্য। তারা তাদের কাব্যে যে নূতন আবহ এনেছেন, নতুন স্বাদ ও সংশয়- তাতে কল্লোলমুখর হয়েছে কাব্যাঙ্গন।
সিকান্দার আবু জাফরও এনেছেন তার কবিতায় আধুনিকতার পরশ। সিকান্দার আবু জাফর শুধু কবি হিসেবেই খ্যাত নন, সাহিত্য মাসিক ‘সমকাল’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবেও তার অবদান অবিস্মরণীয়। কারণ বাংলাদেশে আধুনিক সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে সমকালের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পরিচয় থাকলেও কবি হিসেবেই তিনি অধিকতর উজ্জ্বল।
খুলনার তেঁতুলিয়া গ্রামে ১৯১৯-এ জন্মগ্রহণ করেন তিনি, মৃত্যুবরণ করেন ঢাকায় ৫-৮-১৯৭৫-এ। 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন