চট্টগ্রামে মেগা প্রকল্পের ব্যয় এবং সময় দুটোই বাড়ছে। কিন্তু বাড়ছে না কাজের গতি। তাতে জনদুর্ভোগ বেড়েই চলছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহানগরী বন্দরনগরীর যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি আনতে নেওয়া হয় বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্প। তবে এসব প্রকল্পই এখন নগরীকে স্থবির করে দিয়েছে। কাজের ধীরগতিতে হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প এখন যানজটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আটশ’ কোটি টাকার সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্পের ব্যয় তিন দফায় তিনগুণের বেশি বেড়েছে। কিন্তু ছয় বছরেও কাজ শেষ হয়নি। সড়কটি দুই বছর আগে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হলেও সংযোগ সড়ক নির্মাণ এখনও শেষ হয়নি। নগরীর লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেডেট এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ ব্যয় তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে চার হাজার ২৯৮ কোটি টাকা করা হয়েছে। কিন্তু কাজে এখনও গতি আসেনি। দীর্ঘ চার বছরের বেশি সময় ধরে মহানগরীর প্রধান সড়কের ১৬ কিলোমিটার অংশে প্রকল্পের জন্য খোঁড়াখঁড়িতে যানজট এবং জনদুর্ভোগ স্থায়ী হয়ে গেছে। নগরীর বাকলিয়া থেকে কর্ণফুলী সেতু সংযোগ সড়ক পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ বাকলিয়া এক্সেস রোড প্রকল্পও চলছে সম্ভুক গতিতে। ছয় বছরে প্রকল্পের মেয়াদ এবং ব্যয় দুটোই বেড়েছে, কিন্তু শেষ হয়নি কাজ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তড়িঘড়ি করে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প গ্রহণ, বাস্তবায়নকারী সংস্থার যথাযথ তদারকির অভাব, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের গাফেলতি আর অদক্ষতা এবং বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে এমন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা না থাকাও অন্যতম কারণ বলছেন অনেকে। জনগণের করের টাকায় নেওয়া উন্নয়ন প্রকল্পে এমন বেহাল দশায় জনমনে ক্ষোভ অসন্তোষ বিরাজ করছে।
নগরীর পতেঙ্গা সৈকত এলাকায় বেড়িবাঁধ হয়ে সিটি আউটার রিং রোড নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। অর্ধযুগের বেশি সময় পার হলেও প্রকল্পের কাজ পুরো শেষ হয়নি। পতেঙ্গা থেকে কাট্টলি পর্যন্ত সড়কটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে বিগত ২০২০ সালে। তবে এখনও তিনটি সংযোগ সড়কের একটিও নির্মাণ করা হয়নি। এরফলে প্রকল্পের সুফল মিলছে না। দীর্ঘ পথ ঘুরে চট্টগ্রাম বন্দরমুখি আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী ভারী যানবাহন চলাচল করছে। ব্যক্তিগত যানবাহনও দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বিমানবন্দরে যাতায়াত করছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, একটি সংযোগ সড়কে ফ্লাইওভারের উচ্চতা নিয়ে রেলওয়ের আপত্তিসহ নানা কারণে সংযোগ সড়ক নির্মাণে সময় লাগছে।
এদিকে আগামী ফেব্রুয়ারিতে খুলে দেওয়া হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। তার আগে আউটার রিং রোডের সংযোগ সড়ক চালু না হলে পতেঙ্গা এলাকায় যানজট বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। টানেল চালুর আগেই এলিভেটেড এক্সপ্রেওয়ের বিমানবন্দর থেকে বন্দর নিমতলা পর্যন্ত অংশ খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কথা ছিল গেল ডিসেম্বরের মধ্যে ওই অংশের কাজ শেষ করে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু ওই অংশের কাজও এখনও শেষ হয়নি।
কর্ণফুলী টানেল চালু হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামমুখি যানবাহন সিটি আউটার রিং রোড হয়ে টানেল দিয়ে চলাচল করবে। আর উত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন যানবাহন বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিঙ্ক রোড হয়ে পোর্ট কানেকটিং রোড ধরে নগরীর প্রধান সড়ক হয়ে টানেলে প্রবেশ করবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আংশিক চালু না হলে বিমানবন্দর সড়কে যানজট আরো প্রকট হবে। চট্টগ্রাম বন্দর, সিইপিজেড, কর্ণফুলী ইপিজেড আর পতেঙ্গা এলাকায় গড়ে উঠা বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোর কারণে ওই সড়কে এমনিতেই যানবাহনের তীব্র চাপ রয়েছে। তার উপর টানেলমুখি যানবাহন চলাচল করলে সড়কে অচলাবস্থার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তবে যে গতিতে কাজ চলছে তাতে আগামী ফেব্রুয়ারির আগে এক্সপ্রেসওয়ের ওই অংশ যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া যাবে না বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ শুরু হয় বিগত ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কয়েক দফায় প্রকল্পের সময় এবং ব্যয় বাড়ানো হয়। সর্বশেষ এই মেগা প্রকল্পটির ব্যয় এক হাজার ৪৮ কোটি টাকা বেড়ে চার হাজার ২৯৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা করা হয়েছে। আর মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রকল্পের কাজে গতি নেই। বিমানবন্দর থেকে কাস্টমস মোড় পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। তবে কাস্টম হাউস থেকে দেওয়ানহাট পর্যন্ত এখনও গাডার বসানো কাজ শুরু হয়নি। দেওয়ানহাট থেকে টাইগার পাস অংশে চলছে পাইলিংয়ের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি। নিমতলা অংশসহ মোট ১৫টি র্যাম্প নির্মাণে পরিকল্পনা থাকলেও এ কাজ এখনও শুরুই হয়নি।
চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে ও মহানগরীর যানজট নিরসনে এই প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০১৭ সালে একনেক সভায় প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। সে সময় তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকায় প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। ২০১৯ সালে প্রকল্পটির কাজ শুরু হলে চট্টগ্রাম বন্দর ও ট্রাফিক বিভাগের আপত্তি, জমি অধিগ্রহণের জন্য অপেক্ষা, লালখান বাজার অংশের নকশা নিয়ে রেলওয়ে ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামসহ পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের আপত্তি এবং বিকল্প সড়ক চালু না থাকাসহ নানা জটিলতা সামনে আসে। এসব কারণে প্রকল্পটি নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। অভিযোগ ছিল সঠিকভাবে সাম্ভাব্যতা যাচাই না করে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল।
এদিকে দেড় কিলোমিটার বাকলিয়া এক্সেস রোডের কাজ চলছে ধীরগতিতে। বিগত ২০১৬ সালে ২০৫ কোটি টাকায় ৬০ ফুট চওড়া বাকলিয়া এক্সেস রোড প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। সড়কটি চালু হলে মাত্র পাঁচ মিনিটে কর্ণফুলী সংযোগ সড়ক হয়ে মহানগরীতে প্রবেশ করা যাবে। কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। ২০১৯ সালের জুন মাসে প্রকল্পের প্রথম মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এক বছর সময় বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এরপর প্রকল্পটি সংশোধিত আকারে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ব্যয় ২০৫ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২২০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। তবে কাজে এখনও তেমন গতি নেই। মহানগরীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রকল্পটির কাজ চলছে। কাজে ধীরগতির কারণে এ এলাকার বাসিন্দাদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন