কে এস সিদ্দিকী
এবার বিশ্ব মুসলিমের ঈদে মিলাদুন্নবীর পবিত্র মাস রবিউল আউয়াল এবং খ্রিস্টানদের বড়দিনের ঐতিহাসিক মাস ডিসেম্বর সহযাত্রী হয়ে এসেছে। নানা জাতি ও নানা দেশের বর্ষপঞ্জির ন্যায় আমাদের দেশে প্রচলিত বর্ষপঞ্জির মধ্যে বাংলা বর্ষপঞ্জির হিসাব সূর্যের উদয়স্তর সাথে, খ্রিস্ট বা ইংরেজি বর্ষপঞ্জি বা তারিখ গণনা হয় ১২টা এক মিনিট থেকে এবং ইসলামী চান্দ্র হিজরি বর্ষ উদয় ফজর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এবং তিনটি বর্ষের নববর্ষ যথাক্রমে ১ বৈশাখ ১ জানুয়ারি এবং ১ মহররম। রবিউল আউয়াল হিজরি সালের তৃতীয় মাস এবং ডিসেম্বর খ্রিস্টবর্ষের দ্বাদশ বা শেষ মাস। এ দুটি মাসের অনেক দিন পর এবার একত্রে মিলন ঘটেছে।
শ্রেষ্ঠ মানব, শ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী-রাসূল হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম ও ওফাত একই দিন অর্থাৎ ১২ রবিউল আউয়াল বিধায় মুসলিম উম্মাহ এ দিবস মিলাদুন্নবী নামে উদযাপন করে থাকে। মুসলমানগণ বিশ্বাস করে যে, খ্রিস্টানদের যিশু মুসলমানদের হজরত ঈসা-মাসীহ (আ.) এবং তিনি ছিলেন অন্য নবী -রাসূলগণের ন্যায় আল্লাহর প্রেরিত রাসূল ও বিশিষ্ট নবী। অন্যতম আসমানি কিতাব ইঞ্জিল তথা বাইবেল তার প্রতিই নাজিল করা হয়েছিল, যার পরবর্তী বিকৃত সংস্করণ বিশ্বময় ছড়িয়ে গেছে; আসলের অস্তিত্ব কোথাও নেই। খ্রিস্টানরা হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মদিন (তাদের ধারণা বা হিসাব অনুযায়ী) ২৫ ডিসেম্বর (ক্রিস্টমাস ডে) শুভ বড়দিন হিসেবে পালন করে থাকে। হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মদিবসে মুসলমানগণ সবাই সম্মান প্রদর্শন করে আসছে এবং তাদের এ বড়দিনের উৎসব পালনকে মর্যাদা প্রদান করে থাকে।
যিশুর জন্মদিবস শুভ বড়দিন হিসেবে অত্যন্ত জাঁকজমক ও উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে উদযাপিত হলেও তার মৃত্যু(!) দিবস উদযাপিত হতে দেখা যায় না। অথচ ভারতের একটি বিশেষ সম্প্রদায় কাশ্মীরের কোনো এক স্থানে যিশুখ্রিস্টের একটি সমাধিও আবিষ্কার করে রেখেছে বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে ত্রিত্ববাদী খ্রিস্টানদের দৃষ্টিভঙ্গি কি সে প্রশ্নের জবাব কখনো পাওয়া যায়নি। তাদের মধ্যে যারা মনে করেন বা বিশ্বাস করেন যে, প্রভু যিশু শূলবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন অথবা তাকে হত্যা করা হয়েছে তারাও বলতে চান না, নিহত হওয়ার পর তাকে কোথায় সমাহিত করা হয়েছে এবং তার কোনটি মৃত্যু দিবস? কাশ্মীরে সমাধি থাকলে তার মৃত্যু দিবস স্মরণ করার যৌক্তিকতা তো থাকার কথা। তবে মুসলমানগণ কালামুল্লাহ আল্লাহর কিতাব-আল কোরআনের স্পষ্ট ঘোষণাকে বিশ্বাস করে, যিশু (হযরত ইসা-মাসীহ)-কে আল্লাহ আসমানে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন, সেখানে তিনি জীবিত আছেন এবং কেয়ামতের পূর্বে তিনি দুনিয়াতে আগমন করবেন এবং তখন তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবেন।
৩১ ডিসেম্বর খ্রিস্টবর্ষের শেষ দিন। সাধারণ ধারণা অনুযায়ী যিশু খ্রিস্টের (হজরত ঈসা আ.) জন্ম তারিখ থেকে খ্রিস্ট বর্ষের গণনা করা হয়ে থাকে। এটি বর্ষের দ্বাদশ এবং সর্বশেষ মাস হিসেবে পরিচিত। আগেও এটি শেষ মাস ছিল, কিন্তু ‘দশম’-এর পূর্বের অংশের নাম ‘ডিসম’, ল্যাটিন ভাষায় যার অর্থ দশ। প্রাচীন যুগে এর মাত্র ২৯ দিন নির্দিষ্ট ছিল। পরবর্তীকালে তা ৩১ করা হয়
খিস্টবর্ষ গণনার তারিখ সম্পর্কে ইতিহাসবিদগণের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। কেউ কেউ বলেন যে, হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম তারিখ থেকে খ্রিস্টবর্ষের গণনা করা সঠিক নয়, বাস্তবে অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। খ্রিস্টবর্ষ হজরত ঈসা (আ.)-এর বহু পূর্ব থেকেই প্রচলিত। কারো কারো মতে, এ ক্যালেন্ডার বা বর্ষ হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের চার বছর পূর্ব থেকে প্রচলিত ছিল। জানা যায়, এ বর্ষ প্রাচীন রোমানদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। বর্তমানে এই বর্ষের মাসগুলোর যে ক্রমিক ধারা বিদ্যমান, পূর্বে তা ছিল না। ৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবারের মতো একে খ্রিস্ট সন হিসেবে গণনা করা হয়। ইতিপূর্বে খ্রিস্ট সন সম্পর্কে কেউ অবহিত ছিল না। তা হলে খ্রিস্ট সন বা বর্ষ কিরূপে প্রচলিত হয়ে যায় সেই প্রশ্ন দেখা দেয়।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, খ্রিস্ট সনের প্রবর্তক ছিলেন একজন বিখ্যাত গ্রিক গবেষক, যিনি বহু অনুসন্ধান-গবেষণা দ্বারা হিসাব করে এই সনকে হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম তারিখের সাথে সমন্বয় সাধন করেছিলেন, কিন্তু আধুনিক গবেষণা এই হিসাবকে ভুল প্রমাণিত করেছে। আধুনিক গবেষণা থেকে জানা যায়, এই সন ও হজরত ঈসা (আ.)-এর বয়সের মধ্যে তিন-চার বছরের ব্যবধান রয়েছে। এই সন আমরা প্রথম খ্রিস্টাব্দ থেকে গণনা করি কিন্তু হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম খ্রিস্টপূর্ব তিন বা চার বছরের মধ্যবর্তী সময়ে হয়েছে। তাছাড়া এখানে আরো একটি ত্রুটি হচ্ছে এই যে, এই সনের সূচনাকাল যখন আমরা ১ জানুয়ারি থেকে হিসাব করি, তখন মনে হয়, যেন এ সনের সূচনাও ১ জানুয়ারি থেকে হয়ে থাকবে, কিন্তু ঘটনা এরূপ নয়। সমগ্র বিশ্বে ২৫ ডিসেম্বর হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম দিবস পালিত হওয়ায় এ সনের সূচনায় ত্রুটি থেকে যায়। উল্লেখ্য, খ্রিস্ট সনের কয়েকটি মাস বিভিন্ন দেব-দেবীর নামে এবং কয়েকটি স¤্রাটের নামে নামকরণ করা হয়েছে। ফলে এই সনের মৌলিক দুর্বলতা থেকেই গেছে। ১৭৫৩ সাল পর্যন্ত এই সনের সূচনাকাল সম্পর্কে তীব্র বিরোধ ছিল এর সূচনা মার্চ মাস থেকে বলে গণ্য করা হতো।
কোথাও ইস্টার বা ক্রিস্টমাস দ্বারা এবং কোনো কোনো দেশে সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু করা হতো। কিন্তু ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড কর্তৃক এই সন জানুয়ারি থেকে চালু করা হয় এবং ইউরোপ ও আমেরিকায় খ্রিস্টবর্ষ শুরু হয়ে যায় এবং এ মাস হতে তা স্বীকৃতি লাভ করতে থাকে। প্রাচীন গ্রিক ও ফরাসিদের প্রতিটি মাস ৩০ দিনে ধরা হতো। তারা প্রতিটি মাসকে দশ দিন করে তিন ভাগে বিভক্ত করত এবং মাসের তারিখ নির্ণয় দশক দ্বারা করা হতো। বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রচলিত খ্রিস্টবর্ষ প্রকৃতপক্ষে শামসী বা সৌর ক্যালেন্ডার, যাকে গ্রেগরি ক্যালেন্ডারও বলা হয়। বাস্তবে এটি হচ্ছে প্রাচীন গ্রিক ক্যালেন্ডার, যার সংশোধন সংস্কার করেন আগস্ট। অতঃপর সংশোধন করেন জুলিয়ানÑ যা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নামে অভিহিত হতে থাকে। অতঃপর কয়েকবার এ ক্যালেন্ডার সংশোধন করা হয়। ১৫৮২ সালে পোপ গ্রেগরির নির্দেশে সংশোধনী আনয়ন করা হয়।
জুলিয়ানের ৬০০ বছর পর একজন খ্রিস্টান পাদ্রি ডেনিস এ্যাকজিগোস একে হজরত ঈসা (আ.)-এর নামে ভুল হিসাব করে চালু করেছেন। তখন থেকে এটিকে খ্রিস্ট ক্যালেন্ডার বলা হতে থাকে। নতুবা হজরত ঈসা (আ.)-এর সাথে এরবাস্তব কোনো সম্পর্ক নেই বলে আমেরিকান পিপল এনসাইকোপেডিয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। খ্রিস্ট সৌর ক্যালেন্ডার অসংখ্য বার সংশোধন করা হয়েছে। ১৯২৩ সালে জাতিপুঞ্জের জেনেভা সম্মেলনে বিশেষজ্ঞদের এক বিশেষ কমিটি গঠিত হয়, উদ্দেশ্য সারা বিশ্বের জন্য আধুনিক সৌর ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করা। কমিটি দীর্ঘদিন এ বিষয়ের ওপর কাজ করে এবং বিশাল এক রিপোর্ট পেশ করে। তাতে তেরো মাসে এক বছর হিসাব করে একটি ক্যালেন্ডার রচনার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল এবং এ বিষয়ও স্পষ্ট করা হয়েছিল যে, মৌসুম ও তারিখ এক সাথেই থাকবে এরূপ করা সম্ভব নয়। আবার এটাও সম্ভব নয় যে, সমগ্র বিশ্বে একই তারিখ হতে হবে ইত্যাদি। এভাবে খ্রিস্ট ক্যালেন্ডার পুনঃ পুনঃ সংশোধন ও পরিবর্তন করা হতে থাকে। অতীতে সৌর বর্ষের পরিবর্তন সংশোধন কতবার হয়েছে তার সঠিক হিসাব ইতিহাসেও নেই। এ সনে মাসে দিনে হ্রাস-বৃদ্ধির তামাশা ও কম হয়নি। কখনো ৮ দিন হ্রাস করা হয়েছে কখনো দশ দিন কখনো ২০ দিন বিয়োগ করা হয়েছে। আবার মাসগুলোও এহেন ধাক্কাধাক্কি থেকে রক্ষা পায়নি। যেমন বর্ষ হিসাব করতে গিয়েও কখনো চৌদ্দ মাসে এবং কখনো সাড়ে দশ মাসে এক বছর গণ্য করা হয়েছে। সর্বশেষ ১৯২৩ সালে জাতিপূঞ্জের জেনেভা সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে প্রণীত সৌর ক্যালেন্ডারের কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, যা এখন পর্যন্ত বলবৎ আছে। খ্রিস্ট সৌর ক্যালেন্ডারের এ ইতিহাসের কাহিনীর আলোকে বলা যায়, বার বার সংশোধন করেও এ ক্যালেন্ডারকে একটা স্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী রূপদান করা সম্ভব হয়নি (ভবিষ্যতে কয়েক বছর পরে হলেও), সংশোধন আনয়ন করতে হবে এবং বিশ্ববাসীকে তা গিলতে হবে। খ্রিস্ট ক্যালেন্ডার যা হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম তারিখের সাথে জড়িত বলে দাবি করা হয় তা যে সঠিক ও নির্ভুল নয়, সে তথ্য আমরা গোড়াতেই পেশ করেছি এবং তা বর্তমান ও অনাগত বিশ্বের উপযোগী স্থায়ী কোনো ক্যালেন্ডার এ দাবিও কেউ করেন না। অপরদিকে মুসলমানদের চান্দ্র হিজরি ইসলামী বর্ষ এমন তাৎপর্যম-িত ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যে, এতে অন্য কোনো জাতির বর্ষপঞ্জির ন্যায় ত্রুটিযুক্ত দুর্বলতা নেই। এ বর্ষের দিন-মাসের হিসাব গণনায়ও কোনো জটিলতা নেই। রাতের সূচনা হয় সূর্যাস্তের সাথে সাথে এবং এরও সমাপ্তি ঘটে ফজরতুলু হওয়ার পূর্বাহ্নে। বাকি অংশ দিনের অন্তর্ভুক্ত। মাসের হিসাবও নির্দিষ্ট। মাস পূর্ণ হবে ৩০ দিনে এবং ২৯ দিনে, ৩১ বা ২৮ দিনে, এতটুকু বেশ কমও মাসের মধ্যে নেই। বছরেও কোনো তারতম্য নেই, ৩০ ও ২৯ দিন বিশিষ্ট বারো মাসে এক বছর গণনা করা হয়। আর এ ধারা চলতেই থাকবে। সুতরাং চান্দ্র বর্ষই চিরস্থায়ী বছর এবং ব্যতিক্রমী। এখানে একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মক্কা হতে মদিনায় হিজরতের পূর্ব পর্যন্ত মুসলমনাদের কোনো নির্দিষ্ট বর্ষপঞ্জি ছিল না, এমনকি হিজরতের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও সুবিন্যাস্তভাবে হিজরি বর্ষ চালু হয়নি, তবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তথায় হিজরি সনের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। তিনি যখন নাজরান নামক স্থানে খ্রিস্টানদের সাথে চুক্তি করেন, তখন চুক্তি রচনাকারী হজরত আলী (রা.)-কে নির্দেশ দান করেন যে, চুক্তিপত্রের নিচে তখন হিসেবে হিজরতের পঞ্চম বছর লেখা হয়। হজরত উমর (রা.)-এর খেলাফত আমলে হিজরি সালের প্রবর্তন হয়েছিল। কাজেই খ্রিস্ট বর্ষ ও চান্দ্র হিজরি সালের মধ্যে যথেষ্ট মৌলিক তফাৎ বিদ্যমান এবং হিজরি সনের স্থায়িত্বই তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
জো
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন