আল ফাতাহ মামুন : আমরা শপথ করিতেছি যে, নববর্ষারম্ভে বিগত বছরের ঋণ শোধ করব এবং কৃষিকাজের যে সব সন্ত্রপাতি ও হাঁড়ি-বাসন ধার নিয়ে ছিলাম তাও ফিরিয়ে দেব।’ আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে এভাবেই পুরোনো বছরের ঋণ শোধের শপথ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপন হতো নতুন বছরের প্রথম দিনটি। এর পাঁচশো বছর পর অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব দু’হাজার সনে ‘ধারদেনা শোধের শপথ’ অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে নতুনরূপে নববর্ষ উদযাপন হয় ব্যবিলনিয়া দেশের ব্যবিলন নগরে। বর্তমান ইরাকের ‘আল হিল্লা’ শহরের কাছেই ছিল ব্যবিলন নগরের অবস্থান। এগারো দিন ব্যাপী নববর্ষ উৎসবে নানা আয়োজনে মুখর থাকত ব্যবিলনিয়ার ব্যবিলন। শেষ দিন মারদুকের মন্দিরে থেকে নববর্ষের মিছিল শুরু হয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রমের পর ‘নববর্ষ ভবনে’র সামনে এসে শেষ হতো বর্ষবরণ আনন্দ মিছিল। নববর্ষের শুরুর ইতিহাস এমনটিই। এরপর নানান ঘাত-প্রতিঘাত ও সংঘাত-সংস্কারের মধ্য দিয়ে দেশে দেশে বিস্তার হতে থাকে নববর্ষ সংস্কৃতি। এরই ধারাবহিকতায় বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ইংরেজি নববর্ষ।
জানুয়ারি মাসের পহেলা তারিখ ইংরেজি বছরের প্রথম দিন। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কল্যাণে (!) ইংরেজি নববর্ষ এখন অশ্লীতা আর নোংরামির হাতেখড়ি হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি পেয়েছে। অবশ্য ইংরেজি নববর্ষের সঙ্গে উচ্ছৃংখলতার সম্পর্ক নতুন নয়। স্যার জেমস ফ্রেজার তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য গোল্ডেন বাও’-এ লেখেন, ‘নববর্ষ উপক্ষে আমেরিকান আদিবাসী নারী-পুরুষদের আচরণ ছিল কা-জ্ঞানহীন মানুষের মতো। বিভিন্ন সাজে সজ্জিত নারী-পুরুষরা এ বাড়ি ও বাড়ি ছুটে বেড়াতো আর সামনে যা পেত ভেঙ্গে ফেলত। শুধু যে অন্যের সম্পদের ক্ষতি করতো তা নয়; নিজেদের কাপড়চোপর এবং আসবাবপত্রও ভাঙচুর করতো তারা। পুরোনো বছরের সঞ্চয় ও সম্পদ ধ্বংসের মাধ্যমে নতুন বছরে নতুন জীবন শুরু করো- এ দর্শনই আমেরিকানদের উগ্রপথে বর্ষবরণে উদ্বুদ্ধ করে। সেখানকার আদিবাসীদের দেখাদেখি অভিবাসী আমেরিকানরাও নববর্ষে ভয়াবহ রকমের অস্বাভাবিকতা প্রদর্শন করতে লাগলো। অগ্ন্যুৎসব, শব্দ দূষণসহ নানান কর্মকা- করে ভীতিকর পরিস্থিতিতে ৩১ ডিসেম্বর রাত অতিবাহিত করে নতুন বছরের নতুন সূর্যকে স্বাগত জানাতো তারা।
সময় পাল্টেছে। দিন বদলেছে। এখন আর অন্যের বা নিজের আসবাবপত্র ভেঙ্গে নববর্ষ উদযাপন করা হয় না। এখন নতুন বছরের নতুন সূর্যকে স্বাগত জানানো হয় নিজেকে ধ্বংস করে। একত্রিশ ডিসেম্বর রাত বারোটার পরপরই ‘নিউ ইয়ার’ উদযাপনে তরুণ-তরুণীরা ধর্ম ও নৈতিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে নাচ-গান ও মদ-ইয়াবায় মেতে ওঠে। না, ইউরোপ-আমেরিকা বা অন্য কোনো পাশ্চাত্য রাষ্ট্রের নববর্ষ উদযাপনের কথা বলছি না। বলছি, বারো আউলিয়ার পূণ্যভূমি বাংলাদেশে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন সম্পর্কে। ভাবতেও কষ্ট হয়! একটি ভিন্ন জাতির উৎসবকে কেন্দ্র করে কীভাবে আরেকটি জাতি নিজের বিশ্বাস-সম্পদ ও সংস্কৃতিকে বিলিয়ে দেয়। আমরা বাঙালি। আমাদের আছে নিজস্ব সংস্কৃতি। পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফালগুন, নবান্ন উৎসবসহ বিভিন্ন উৎসব বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এসব সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় ও ধর্মীয় জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির আকাশ-পাতাল ব্যধান। থার্টিফার্স্ট নাইট, ভেলেন্টাইনস ডে-সহ ইংরেজি বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান পালন করার মাধ্যমে আমরা আমদে দেশীয় এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সংকটাপন্ন করে তুলছি। পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মে বিশ্বাসী নয়। ইন্দ্রীয় সুখ লাভ এবং জীবন উপভোগই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। এ জন্য তারা কোনো আইন কিংবা বাধানিষেধের ধারধারে না। তারা আরো বিশ্বাস করে, এ জীবনই শেষ জীবন। এরপর আর কোনো জীবন নেই। নেই জবাবদিহির মতো গুরু দায়িত্বও। অপর দিকে আমাদের দেশের প্রায় শতভাগ মানুষ ধর্মে বিশ্বাসী। তারা পরজীবনে জবাবদিহির বিষয়টি গভীরভাবে লালন করে এবং বাস্তর জীবনে এর কঠোর অনুশীলনের চেষ্টা করে। সুতরাং আমাদের এবং পশ্চিমাদের জীবনাচার এবং সংস্কৃতির যে বিরাট পার্থক্য থাকবে তা বলাই বাহুল্য।
আমাদের সঙ্গে বিশ্বাস ও চিন্তায় এত বৈপরিত্যপূর্ণ একটি জাতির সংস্কৃতি যখন আমরা চর্চা করতে থাকি তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের বিশ্বাসও আমাদের মনমননে গেঁথে যেতে থাকে। যে কারণে পাঁচ বছর আগের বাংলাদেশকে পাঁচ বছর পরের বাংলাদেশের সঙ্গে মেলাতে গেলে রীতিমত আঁতকে ওঠতে হয়। কয়েক বছর আগেও দৈনিক কাগজগুলোর একটি নিয়মিত শিরোনাম ছিল- ‘সম্ভ্রম হারানোর ভয়ে তরুণী/গৃহবধূর আত্মহত্যা’। আর সাম্প্রতিক সময়ে ইউটিউব বা পর্ণ সাইটগুলোতে আমাদের দেশের মেয়েদের সম্ভ্রম দানের মিছিল দেখে নিজেকেই বিশ্বাস করাতে কষ্ট হয়, একদিন এ দেশের মেয়েরাই সম্ভ্রম বাঁচাতে আত্মাহুতি দিয়েছিল! আজকের এ জাতীয় অধঃপতন যে বিজাতীয় সংস্কৃতিরই পরিণাম ও ফায়দা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
থার্টিফার্স্ট নাইটকে কেন্দ্র করে যেকোন ধরনের নৈরাজ্য রোধে প্রতিবছরই সরকার ও আইনশৃৃংখলা বাহিনী তৎপর থাকেন। তবে আফসোস! অশ্লীলতা এবং কথিত ‘তারুণ্যের উম্মাদনা’ রোধে কারোই কোনো ভাবনা থাকে না। বরং আইনশৃংখলা বাহিনীর তত্ত্বাবধানেই নাচগান, মদপান ও শ্লীলতাহানির মতো ঘৃণ্য কাজগুলো ঘটে থাকে। কয়েক বছর আগে টিএসসি চত্বরে নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, এসব অপসংস্কৃতি এদেশের তরুণ-তরুণীদের জন্য কতটা বিপদজনক। ‘নিউ ইয়ার’ উদযাপনকে কেন্দ্র প্রতি বছরই শ্লীলতাহানির ঘটে, এবারও ঘটবে হয়তো। কিন্তু প্রশ্ন হলো- আমরা যাকে শ্লীলতাহানি বলছি, আমাদের নারী সমাজও কি সেটিকে শ্লীলতাহানিই মনে করেন? যদি তাই হয়, তবে তো টিএসসির ঘটনার পর ‘নিউ ইয়ার’ উৎসবে অংশগ্রহণ করা কোনো নারীর চিন্তায়ও আসার কথা নয়। কিন্তু হায়! ওই ঘটনার পর যেন নারীদের অংশগ্রহণ আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে।
এ লেখা পড়ে কোনো নারীবাদীর নাকে যে মৌলবাদীর গন্ধ লাগবে না, তা হলফ করে বলতে পারি না। তবে যে কথাটি আমি হলফ করে বলতে পারি তা হলো- নারীবাদীদের মহান হৃদয়ে এ প্রশ্ন অবশ্যই জাগবে যে, নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে এত কথা বলছেন, কিন্তু যারা নারীর সম্ভ্রমহানি করেছে সেই সব পশুদের ব্যাপারে কিছু বলছেন না কেন? আসলে যারা এমনটি করেছে তারা মানুষের পর্যায়ে পড়ে না- এ ব্যাপারে আমার কেন খোদ শয়তানেরও দ্বিমত নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেদিন কোনো মানুষরূপী পশুতো বাসায় গিয়ে কোনো নারীর সম্ভ্রমহানি করেনি। বরং মেয়েরাই পশুর খাঁচায় এসে নিজ থেকে ধরা দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমি শুধু বলছি, বোন! ‘কুকুর হইতে সাবধান।’ এতে আমার কোনো অপরাধ হয়েছে বলে মনে হয় না।
ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় না বললেই নয়। আমরা বাঙালির পাশাপাশি মুসলিমও। মুসলিম হিসেবে আমাদেরও রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি এবং হিজরি সন। বিজাতীয় (অপ)সংস্কৃতি চর্চায় গা ভাসিয়ে না দিয়ে দেশীয় এবং ধর্মীয় সংস্কৃতি চর্চায় মুসলিম তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে আলেম-ওলামাদের বিশেষ ভূমিকা রাখার আহবান করছি। আরেকটি কথা। সামগ্রীক বিবেচনায় বিদায়ী বছর বিশ্ব মুসলমানের জন্য সুখকর ছিল না। উপভোগ্য তো নয়ই। মিয়ানমার, কাশ্মীর, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, আলেপ্পোর মুসলমানরা এখনো আঁতকে ওঠছে ১৬’র ক্ষত দেখে। নতুন বছর পুরনো ক্ষতে সুখের প্রলেপ দেবে এই আশায় দিন গুনছে নির্যাতিত মুসলমান। মুসলিম বিশ্বের ঘোর অমানিশা দূর করে আলোকিত ভোর-সুবহে সাদিক ফিরিয়ে আনুক নতুন বছরের প্রথম সূর্য। স্বাগতম ২০১৭।
লেখক : শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
alfatahmamun@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন