শনিবার, ২৫ মে ২০২৪, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৬ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ব্যবসা বাণিজ্য

আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগেনি বেনাপোল বন্দরে

| প্রকাশের সময় : ৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বেনাপোল অফিস : দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোলর কার্যক্রম চলছে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। সরকার বাংলাদেশকে ডিজিটাল ঘোষণা করলেও বন্দরটি চলছে পুরোনো ধারায়। সিসি ক্যামেরাসহ বন্দরের কার্যক্রম ডিজিটালাইজড না হওয়ায় ব্যহত হচ্ছে দু’দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। বন্দরের বিল সেকশন থেকে শুরু করে সর্বস্তরের অফিসিয়াল কার্যক্রম চলছে হাতেকলমে। এখানকার অব্যবস্থাপনায় দিন দিন ব্যবসায়ীরা আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে আগ্রহ হারাচ্ছেন। বন্দরের মধ্যে অনায়াসে ঘটছে পণ্য চুরিসহ বহিরাগতদের হামলায় মারা যাচ্ছে বন্দরের নিরাপত্তা কর্মীরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্দরে সিসি ক্যামেরা থাকলে এখানকার অনিয়ম অনেকাংশে বন্ধ করা সম্ভব। এ ব্যাপারে তারা বন্দর কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন বৈঠকে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের ওপর জোরদাবি জানালেও কারো কোনো মাথা ব্যাথা নেই। আর বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছেন, বিষয়টি তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন।
জানা যায়, ১৯৭২ সাল থেকে বেনাপোল বন্দরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। এ বন্দর থেকে ভারতের কোলকাতা শহরের দূরত্ব মাত্র ৮৪ কিলোমিটার। কোলকাতা থেকে রওয়ানা হয়ে চার ঘণ্টায় একটি মালবাহী ট্রাক আমদানি পণ্যের চালান কাগজপত্রের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে পৌঁছায় বেনাপোল বন্দরে। যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হওয়াতে ব্যবসায়ীদের এ পথে বাণিজ্যে আগ্রহ বেশি।
বেনাপোল বন্দরের আমদানি পণ্য প্রবেশদ্বারসহ দুই কিলোমিটার বন্দর এলাকাজুড়ে কোথাও কোনো সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়নি। প্রয়োজন ছাড়া বন্দরের মধ্যে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ থাকলেও অবাধে বহিরাগতরা প্রবেশ করছে বন্দরের অভ্যন্তরে। প্রতিনিয়ত বন্দরের অভ্যন্তর থেকে চুরি যাচ্ছে লাখ লাখ টাকার মালামাল। চুরি হওয়া আমদানি পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য বন্দরের সামনেই নামে-বেনামে বিভিন্ন দোকান গড়ে উঠেছে। বন্দরের অভ্যন্তরে সড়কগুলোর বেহাল দশা। বর্ষায় হাঁটু পরিমাণ পানি জমে পণ্য ডুবে যায় পানির নিচে।
ব্যবসায়ীদের ধারণা, এসব অব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করায় ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে পর পর পাঁচ বছর এখানে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। যদিও সরকার প্রতিবছর এই বন্দর থেকে ২৫০০ থেকে ৩০০০ কোটি টাকার রাজস্ব আয় করে থাকে।
বেনাপোল বন্দরের নিরাপত্তা সংস্থা আনসার কমান্ডার শফিকুল ইসলাম জানান, চলতি বছরের ১৬ নভেম্বর দায়িত্ব পালনের সময় চোর সিন্ডিকেটের হামলায় আনসার সদস্য ফিরোজ আহমেদ খুন হন।
আমদানিকারক বাবলুর রহমান জানান, বন্দরে রহস্যজনক অগ্নিকাÐে তাদের আমদানিকৃত ২৫ লাখ টাকার পণ্য পুড়ে যায়। বন্দরে সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা থাকলে হয়ত বা অগ্নিকাÐের রহস্য উদঘাটন সম্ভব হতো। গত ১০ বছরে বন্দরের খুব একটা অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়ন হয়নি। বন্দরের বিভিন্ন শেড দিয়ে বর্সায় পানি পড়ে মালমাল ভিজে নষ্ট হচ্ছে। তার পরও কোনো উদ্যোগ নেই পণ্য রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। বন্দরে ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। আগুন লাগলে তার তাৎক্ষণিক নেভানোর জন্য ফায়ার ফাইটারগুলো থাকে সার্বক্ষণিক অকেজো। বন্দরের পর্যাপ্ত শেড না থাকায় ট্রাক টার্মিনালেই খোলা আকাশের নিচে রাখা হচ্ছে কোটি কোটি টাকার মালামাল। বন্দর থেকে মালামাল চুরির জন্য বন্দরে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী চোর সিন্ডিকেট। চোর সিন্ডিকেট এতোই বেপরোয়া যে মালামাল চুরিতে কেউ বাধা দিলে তার ওপর চালানো হয় হামলা ও নির্যাতন। সব মিলিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। অন্য দিকে বেনাপোল কাস্টমস হাউজে বর্তমানে সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে চলছে পণ্যের শুল্কায়ন কার্যক্রম।
ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের বন্দর সাব কমিটির চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান জানান, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বেনাপোল স্থলবন্দর একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। এই বন্দরটি আজ পর্যন্ত সিসি ক্যামেরার আওতায় আসেনি এটা দুঃখজনক। অথচ বেনাপোল বন্দরের বিপরীতে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে ৩০০ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হযেছে ইন্ট্রিগেটেড চেকপোস্ট। বাণিজ্যিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতাধীন, রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এসি ওয়ারহাউজ, চোরাচালান প্রতিরোধে স্কানিং ব্যবস্থাসহ আরও অনেক আধুনিক ব্যবস্থা। যার একটিও আধুনিক সুবিধা নেই বেনাপোল বন্দরে। এতে লোকসানের মুখে পড়ে ব্যবসায়ীরা এ পথে বাণিজ্য কমিয়ে দিচ্ছেন। বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন জানান, প্রতিটি বৈঠকে বন্দর উন্নয়নের বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও তারা বিষয়টি আমলে নেয়নি। প্রতি বছর মালামাল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাঁচ শতাংশ হারে বন্দরের ভাড়া বৃদ্ধি করা হলেও অনেকটা অব্যবস্থানার মধ্য দিয়ে চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখানে সুনজর দিলে প্রতিবছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দ্বিগুন রাজস্ব আয় সম্ভব ।
বেনাপোল স্থলবন্দরের উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) আব্দুল জলিল জানান, বন্দরের সিসি ক্যামেরা লাগানোর পরিকল্পনা তাদের রয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একাধিকবার জানান হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য অবকাঠামোর কিছু কিছু উন্নয়ন কাজ পর্যায়ক্রমে চলছে বলে জানান তিনি।
বন্দর ও কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বেনাপোল কাস্টমস হাউজে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি ছিল ২০৩ কোটি টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ঘাটতি ৮ কোটি ৭১ লাখ, ২০১৩-১৪-তে ঘাটতি ১৩৪ কোটি ৭৩ লাখ, ২০১২-১৩ তে ঘাটতি ৪৫২ কোটি ৮৯ লাখ এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে ঘাটতি ১৯৪ কোটি টাকা।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে ভারত থেকে ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ৩৪৮ মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমে আমদানি হয় ১২ লাখ ৯৮ হাজার ৯৮৩ মেট্রিক টন পণ্য।
ব্যবসায়ীরা অবিলম্বে বেনাপোল বন্দরকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল ও আধুনিকায়ন করে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার জোর দাবি জানিয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন