স্টালিন সরকার : খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা দেশের আত্মসম্মান বাড়ায়। কৃষিতে বিপ্লব ঘটায় আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করায় শ্লাঘার শেষ নেই। যে কৃষক খাদ্য উৎপাদন করে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করছে তারা কী ভালো আছে? আজ ২৬ পৌষ। সামনের মাসে শুরু হবে ইরি রোপণের মৌসুম। তিস্তায় পানি কমতে শুরু করেছে। অন্যান্য নদীর দশাও অভিন্ন। সেচের পানি নিয়ে এখনই কৃষকের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে দুশ্চিন্তা। যে কৃষক পদ্মা-তিস্তার পানি ইরি-ধানের সেচের কাজে ব্যবহার করে তারা উদ্বিগ্ন এবার পানি পাবে তো? নাকি পানির অভাবে এবারও তাদের স্বপ্ন চুরমার হবে? দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে গতকাল হেডলাইন খবর ছাপা হয়েছে ‘তিস্তা চুক্তি নিয়ে নতুন আশাবাদ’। ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্ভাব্য দিল্লি সফরের প্রসঙ্গ তুলে সম্পাদকীয় নীতিতে দিল্লি ঘেঁষা ওই পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আড়াই বছর পূর্তি উপলক্ষে দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার ভারত সফরে তিস্তা চুক্তির সম্ভাবনা আছে। আমরা এ নিয়ে অভ্যন্তরীণ ঐকমত্যের চেষ্টা চালাচ্ছি। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্য সরকারের (পশ্চিমবঙ্গ) মতৈক্যের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।’ প্রশ্ন হলো আমাদের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা অববাহিকার কৃষকরা এবার কী তিস্তা চুক্তি নিয়ে আশাবাদী হতে পারেন? নাকি ‘কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিঁটা’ প্রবাদের মতো পত্রিকাটি আমাদের কৃষকদের যন্ত্রণা উষ্কে দিচ্ছে?
তিস্তার পানি উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের জন্য জীবনমরণ সমস্যা। পানির অভাবে প্রতি বছর লাখ লাখ একর জমিতে ধান উৎপাদন সম্ভব হয় না। ভারত গজলডোবায় অবৈধ বাঁধ দিয়ে পানি উঠিয়ে নেয়ায় তিস্তার পানির অভাবে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে; এবং উত্তরাঞ্চল মরুভূমি হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে ১৮৫১-১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ৫টি সমীক্ষা হয়। উদ্দেশ্য ছিল গঙ্গার পানি হুগলি ও ভাগীরথীতে কীভাবে প্রবাহিত করা যায়। প্রতিটি সমীক্ষাতেই বিশেষজ্ঞরা অভিমত দেন, গঙ্গা-পদ্মার মতো বিশাল নদীর গতিপথে বাঁধ দিলে উজান-ভাটি দুই অঞ্চলেই প্রাকৃতিক ভারসাম্যে বিঘœ ঘটবে। এ অভিমত উপেক্ষা করেই ১৯৫৭ সালে ভারত সরকার গঙ্গার ওপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ ও হুগলী-ভাগীরথীতে সংযোগ দেয়ার জন্য ফিডার খাল খননের পরিকল্পনা করে। ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা চালু হওয়ার পর নদীমাতৃক বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়ে। এ অবস্থায় ১৯৯৬ সালে ১২ ডিসেম্বর ৩০ বছরমেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া। চুক্তির ২০ বছর অতিক্রান্ত হলেও পর্যাপ্ত পানি পায়নি বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ-ভারত পানি চুক্তি নিয়ে গত এক যুগে তিস্তার অনেক পানি ঘোলা হয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দু’দেশের সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করে। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফর; অতঃপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরে এক নম্বর এজেন্ডা ছিল তিস্তা চুক্তি। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দমোদর মোদীর ঢাকা সফরের সময়ও তিস্তাচুক্তি ইস্যু ছিল সর্বাগ্রে। কিন্তু বাংলাদেশের ট্রানজিট, করিডোর, সমুদ্রবন্দর সবকিছু ভারত নিলেও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অজুহাতে তিস্তা চুক্তি থেকে বিরত থাকে। ভারতের দাবি পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জী তিস্তা চুক্তিতে বাগড়া দিচ্ছেন। প্রশ্ন হলো মমতার বাগড়ার দায় কী বাংলাদেশের?
পদ্মা-তিস্তার পানি শুকিয়ে গেলে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ কৃষকের আত্মা শুকিয়ে যায়। আমাদের কিছু দিল্লিমুখী বুদ্ধিজীবী যুক্তি দেন ফেডারেল রাষ্ট্র ভারত আইন অনুযায়ী অঙ্গরাজ্যের সম্মতি ছাড়া চুক্তি করতে পারে না। তিস্তা ইস্যু পুঁজি করে পশ্চিমবঙ্গের বিগত বিধানসভা নির্বাচনে উত্তরের জেলাগুলোতে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস সাফল্য পেয়েছে। যুক্তি দেয়া হয় ভোটের কারণে মমতা তিস্তা চুক্তিতে বাগড়া দিচ্ছেন; তাহলে তিনি পশ্চিমবঙ্গের উজান থেকে তিস্তার পানি অন্যত্র সরিয়ে নেয়ারও বিরোধিতা করতেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো পাশের রাজ্য সিকিমে একাধিক বিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্পের জন্য তিস্তার পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চিত করে। মমতা তার বিরোধিতা করেননি। অতএব তিস্তা চুক্তিতে মমতার বাধা দিল্লির এমন কথাবার্তা অবান্তর।
২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হওয়ার পর তা পিছিয়ে যায় আগামী ফেব্রুয়ারিতে। সেই সফরের দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত না হলেও প্রস্তুতি চলছে। পত্রিকাটিতে প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরে অনেকগুলো স্মারক ও চুক্তির সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো ভারতের স্বার্থে দিল্লি-ঢাকার মধ্যে শত চুক্তি হলেও বাংলাদেশের স্বার্থে কী তিস্তা চুক্তি হবে? তিস্তা চুক্তি নিয়ে বার বার যে মমতার ওপর দায় চাপানো হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের সেই মমার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তিক্ততা ক্রমেই বাড়ছে। তাদের এই দ্বৈরথ তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলেছে। শুধু তাই নয় নরেন্দ্র মোদী চরম বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়ে গেছেন। বাল ঠাকরের পুত্রের দল সিবসেনা নরেন্দ্র মোদীর সময়কে সবচেয়ে জঘন্য শাসন হিসেবে অবিহিত করেছে। ৫টি রাজ্যে তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিল করায় দেশব্যাপী নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়; সারদা ও রোজভ্যালি নামে দুটি ভুয়া প্রকল্পের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের টাকা আত্মসাৎ করা নিয়ে ভারতজুড়ে তোলপাড় চলছে। এ অবস্থায় মোদী তিস্তা চুক্তি নিয়ে কতটুকু অগ্রসর হবেন তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।
এটা ঠিক বাংলাদেশ-ভারত সম্পকের্র টানাপোড়েন স্বাধীনতার পর থেকেই। সেই ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির পর আমরা বেরুবাড়ি দিয়ে দিলেও ভারত তিনবিঘা সমস্যার সমাধান করেনি। দীর্ঘ ৪০ বছর পর সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করেছে। আমাদের নেতাদের নতজানু মানসিকতার কারণে দেশের বড় বড় দলগুলো দিল্লি তোষননীতির প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। ভারতীয় দূতাবাসে ‘খাম সংস্কৃতি’র কারণে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বৃহৎ অংশ ঢাকার স্বার্থের চেয়ে দিল্লির স্বার্থ নিয়ে বেশি বিচলিত হন। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র তার উদাহরণ। সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষার অজুহাতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর দিল্লির ভূমিকা’র কারণে পরবর্তী নির্বাচনের বদলে সরকার পুরো মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দলগুলো অতীতে দেশের জাতীয় ইস্যুগুলোর ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ হলেও এখন দিল্লির অনুকম্পায় আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে জাতীয় স্বার্থে নীরব। এ অবস্থায় এবারের ইরি মৌসুমে ঢাকা-দিল্লি চুক্তির মাধ্যমে তিস্তায় পানি গড়াবে এমন প্রত্যাশা পূরণ হবে কিনা বলা দুষ্কর। তবে সুযোগ এসেছে তিস্তা চুক্তিতে দিল্লিকে বাধ্য করতে চীনের সহায়তা নেয়ার। চীনের প্রেসিডেন্ট শিন জিনপিং-এর ঢাকা সফরে দু’দেশের মধ্যে ২৭টি চুক্তি এবং সমঝোতা হয়েছে। ওই সময় চীন বাংলাদেশকে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ঋণ দেয়। সেই চীন এখন ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। পদ্মা-তিস্তার পানি নিয়ে ভারত আমাদের ওপর আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করলেও চীনের হাতে নাস্তানাবুদ হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের উজানে চীনের বাঁধ নির্মাণের ঘোষণা ভারতকে বিচলিত করেছে। এ অবস্থায় তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে বাংলাদেশ-ভারত-চীন ত্রীদেশীয় আলোচনায় সুফল আসতে পারে। অপ্রিয় হলেও উল্লেখ করতে হয় আওয়ামী সমর্থক বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, পাকিস্তানের ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১৯৬৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘এমন প্রতিবেশী (ভারত) জুড়ে দিয়ে খোদা আমাদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন।’ বাস্তবতা হলো ভারত এমন একটি হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসী দেশ তারা সব প্রতিবেশীর সঙ্গেই নিষ্ঠুর আচরণে অভ্যস্ত। তবে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়ে দেশের মানুষ আশাবাদী। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইসলামী দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলন ওআইসিতে যোগ দিতে লাহোর যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ নিয়ে দিল্লি নাখোশ হয়। ‘খাম সংস্কৃতি’র বদৌলতে দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী দিল্লির সুরে কোরাস গেয়ে ওআইসি সম্মেলনের যোগদানের বিরোধিতা করেন। সবার বিরোধিতার মুখেই বঙ্গবন্ধু ওআইসি সম্মেলনে যোগ দেন। লাহোর যাওয়ার প্রাক্কালে মন্ত্রীদের দু’একজন ‘লাহোর গেলে দিল্লি নাখোশ হতে পারে’ জানালে গর্জে উঠে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি কারও মাখা তামাক খাই না’। প্রধানমন্ত্রীর সে ধরনের ভূমিকাই কেবল পারে তিস্তা চুক্তিতে দিল্লিকে বাধ্য করে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি প্রবাহ বৃদ্ধি করতে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন