সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় বেরুনোর পর প্রধান বিচারপতি ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নির্মম সমালোচনার শিকার হয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা অত্যন্ত কদর্য ও অমার্জনীয় ভাষায় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সমালোচনায় ব্যাপৃত আছেন। আদালতের রায় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা অতীতে হলেও বিচার বিভাগ কিংবা প্রধান বিচারপতি এর আগে কখনো এমন আক্রমণের শিকার হননি। রায় এবং এর পর্যবেক্ষণ পছন্দ না হওয়ায় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে স্বাধীনতা বিরোধী, শান্তি কমিটির সদস্য ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করে ফেলেছেন ইতোমধ্যেই। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের এ ক্ষোভের কারণটা না হয় বোঝা যায়। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় তাদের একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ভেস্তে গেছে। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে নেয়ার উদ্দেশ্য ছিল বিচারপতিদের হাতের মুঠোয় রাখা যাতে তাদের চাকরির ভয় দেখিয়ে প্রয়োজন মতো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন অথবা গৃহীত সিদ্ধান্তের ওপর আদালতের সিলমোহর লাগানো সহজ হয়। কিন্তু একটি রিট পিটিশনের ওপর দেয়া রায়ে হাইকোর্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়। সরকার পক্ষ আপিল করে সুপ্রিমকোর্টে। সেখানেও সাত সদস্যের ফুল বেঞ্চ হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন। সে রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশিত হওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝড়ের সৃষ্টি হয়। যে ঝড়ের রেশ এখনো কাটেনি। বরং প্রতিদিনই সরকার দলীয় কোনো না কোনো নেতা কিংবা মন্ত্রী তীব্র বাক্যবাণে বিদ্ধ করে চলেছেন প্রধান বিচারপতিকে। এসব আক্রমণ শানানোর সময় তারা মোটেও খেয়াল করছেন না যে, এর দ্বারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, সুশাসন ইত্যাদি বিষয়ে অতীতে তাদেরই কথার একেবারে বিপরীত দিকে অবস্থান নিয়ে ফেলছেন। যিনি বা যারা বিচার বিভাগ কিংবা প্রধান বিচারপতিকে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করছেন, তারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কিংবা আইনের শাসনে বিশ্বাস করেন এ কথা অন্তত জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন কোনো মানুষকে বিশ্বাস করানো যাবে না।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এরই মধ্যে আরো একজনের অশালীন ও নির্মম আক্রমণের শিকার হয়েছেন। অবাক করা বিষয় হলো, আক্রমণকারী একজন সাবেক বিচারপতি। এই সাবেক বিচারপতি মহোদয়ের কথাবার্তা শুনে লোকজন চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করেন, এ লোক আমাদের বিচারপতি ছিলেন! এমন নি¤œ রুচির একজন মানুষ আমাদের বিচারালয়ে বসে বিচার কাজ করেছেন, ভাবতেও অবাক লাগে! তো সে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন, ‘শুধু বিচারপতি পদই নয়, তোমাকে এ দেশও ছাড়তে হবে। তুমি যখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব স্বীকার কর না, এ দেশে থাকার কোনো অধিকার তোমার নেই।’ সাবেক বিচারপতি মানিক রায় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলছেন, ‘উনি মাত্র ২৫ দিন সময়ের মধ্যে ৪০০ পৃষ্ঠার রায় লিখেছেন। এটা অসম্ভব। এটা হতে পারে না। এটা মোটেও তার লেখা নয়। রায়ে অনেক শব্দ আছে যেসব শব্দ তার আগের কোনো রায়ে নাই। অর্থৎ এটা পরিষ্কার, এ রায় তার লেখা নয়। অন্য কেউ লিখে দিয়েছে। সম্ভবত পাকিস্তানের কোনো আইএসআই লিখে দিয়েছে।’ (সূত্র: ২৭ আগস্টের দৈনিক সমূহ)।
সাবেক বিচারপতি মানিক যে ভাষায় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে আক্রমণ করেছেন, তাকে ভদ্রজনোচিত বলার কোনো উপায় নেই। অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন যে, একজন সাবেক বিচারপতি, যিনি নিজেও বর্তমান প্রধান বিচারপতি অধীনে হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন, তিনি এমন অশালীন কথা বলেন কী করে! লক্ষণীয় হলো, আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা প্রধান বিচারপতিকে তুলোধুনো করলেও তাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করেই তা করেছেন। কিন্তু শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে হুমকি দিয়েছেন। সরকার বা কোনো একটি রাজনৈতিক দলের তল্পি বহন করতে গিয়ে একজন সাবেক বিচারপতি এতটা নিচে নামতে পারেন, তা ভাবতেও অবাক লাগে। স্বীয় মান-মর্যাদা এবং ব্যক্তিত্বের প্রতি তোয়াক্কা না করে এমন ফোঁপর দালালি করার কি খুবই প্রয়োজন ছিল বিচারপতি মানিকের?
অবশ্য লোকজন বলছে ভিন্ন কথা। তারা বলছেন যে, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ওপর শামসুদ্দিন মানিকের ক্ষোভ অনেক দিনের। সবাই জানেন যে, বেশ কিছু বিচারের পূর্ণাঙ্গ রায় না লিখেই অবসরে যান শামসুদ্দিন মানিক। বার বার তাগিদ দেয়া সত্তে¡ও মানিক সেসব রায় লিখে দিচ্ছিলেন না। সে সময় প্রধান বিচারপতি বিচারপতি মানিকের অবসরকালীন ভাতা ও আনুতোষিক বন্ধ রাখার জন্য সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তিনি (মানিক) তার বিচারকৃত মামলা সমূহের পূর্ণাঙ্গ রায় না লেখা পর্যন্ত তাকে যেন কোনো টাকা পরিশোধ করা না হয়। প্রধান বিচারপতির এ নির্দেশের পর খুব ক্ষেপেছিলেন শামসুদ্দিন মানিক। সব নিয়ম-কানুন রীতি-নীতির তোয়াক্কা না করে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছিলেন। সে সময় একটি টিভি টক শো’তে মানিক প্রধান বিচারপতিকে ‘সিনহা বাবু’ বলেও সম্বোধন করেছিলেন। তখন অনেকেই এই ভেবে বিস্মিত হয়েছিলেন যে, একজন সদ্য অবসরে যাওয়া বিচারপতি কী করে প্রধান বিচারপতি সম্বন্ধে এ ধরনের ধৃষ্টতামূলক উক্তি করেন! কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন তার নৈতিকতা নিয়েও।
এই মানিক সাহেব বর্তমান রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদের স্পিকার থাকা অবস্থায় তাকে ‘স্যাডিস্ট’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। সে সময় জাতীয় সংসদের (নবম সংসদ) এক অধিবেশনে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যরা তীব্র ভাষায় বিচারপতি মানিককে তুলোধুনো করেছিলেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, এক সময় স্পিকার আবদুল হামিদকে স্যাডিস্ট বললেও পরবর্তীতে তার কাছেই দরখাস্ত করেছিলেন প্রধান বিচারপতিকে অপসারণের দাবি জানিয়ে। সে সময় এক লেখায় বিশিষ্ট আইনজীবী ড. তুহিন মালিক মন্তব্য করেছিলেন, “গত পরশু সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী বলেছেন, ‘বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিচার বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্টের সর্বনাশ করছেন। বিচারপতি মানিক তার আচরণে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি হতাশাগ্রস্ত উন্মাদ।’ বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদে থাকা সাবেক একজন প্রধান বিচারপতি যদি একজন বিচারককে উন্মাদ বলে সাব্যস্ত করেন, তাহলে সেই উন্মাদ বিচারকের লেখা সংবিধান সংশোধনী বাতিলের রায় কতটা বৈধ বলে গণ্য হবে?” (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১১ ফেব্রæয়ারি, ২০১৬)। বাস্তবিকই বিচারপতি মানিকের গত বছর দু’য়েকের কথাবার্তা পর্যালোচনা করলে তার সম্পর্কে সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীর মন্তব্যকে অমূলক বলা যাবে না।
প্রধান বিচারপতিকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার হুমকি দিয়েছেন শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। কোন ক্ষমতাবলে তিনি এমন হুমকি দিলেন তা জানতে চাওয়া নিশ্চয়ই দোষের কিছু হবে না। দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবেই জানার আগ্রহ, এ দেশের আদালত অথবা সরকারের নির্দেশ ব্যতীত কোনো একজন বৈধ নাগরিককে দেশ ছেড়ে চলে যাবার কথা বলার অধিকার কারো আছে কীনা। যদি না থাকে তাহলে প্রধান বিচারপতির প্রতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের এ হুমকি অপরাধের কোন পর্যায়ে পড়ে? আমরা ভালো করেই জানি, যত কথাই বলা হোক, প্রধান বিচারপতিকে অশালীন ভাষায় আক্রমণ এবং দেশ ছাড়া করার হুমকি দিলেও বিচারপতি মানিকের কিছু হবে না। কারণ ইতোমধ্যে সরকারের দু একজন মন্ত্রীও তার সুরে সুর মিলিয়ে বিচাপতি এস কে সিনহাকে দেশ ছাড়া করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। গত ২৭ আগস্ট ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে গিয়ে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে একই কথা বলেছেন। তবে, একটু ঘুরিয়ে। তিনি দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত এস কে সিনহার ওপর চাপিয়ে দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের কোনো কিছু ভালো না লাগলে দেশ ছেড়ে চলে যান।
প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও এর সতীর্থদের মন্তব্য দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাদের আশঙ্কা, রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভের অন্যতম বিচার বিভাগের প্রধানকে যে ধরনের অশালীন ভাষায় আক্রমণ করা হচ্ছে তাতে আগামী দিনগুলোতে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক শৃঙ্খলায় ভয়াবহ ধস নামতে পারে। যা দেশে সৃষ্টি করতে পারে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি। সে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির হাত থেকে কেউই রেহাই পাবে না। কথায় আছে, ‘নগর পুড়লে দেবালয়ও রক্ষা পায় না’।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন