ঐতিহাসিক মালাজিকার্দ যুদ্ধের ৯৪৬তম বার্ষিকী গত ২৬ আগস্ট তুরস্কে পালিত হয়েছে। ১০৭১ সালের ২৪ আগস্ট এ ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বাইজান্টাইন বা রোমান শাসনের বিরুদ্ধে তুর্কি উপজাতিদের। রোমানরা তাদের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। এ যুদ্ধের ৯৪৬তম বার্ষিকী উপলক্ষে তুরস্কের মুম প্রদেশে অনুষ্ঠিত এক বিশাল র্যালিতে দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোগান ভাষণ প্রদান করেন। তাতে তিনি বলেন, ১৫ জুলাইয়ের অভ্যুত্থানকে রুখে দেয়া ছিল রোমানদের বিরুদ্ধে জয়ের অনুরূপ। তিনি ১৯১৫ ও ১৯২৩ সালের যুদ্ধ বিজয়ের প্রতি ও ইঙ্গিত করেন। গত ২৮ আগস্ট দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত খবরে এ তথ্যের উল্লেখ করা হয়েছে।
আরবিতে মালাজিকার্দ নামটির উচ্চারণগত কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। ফারসিতে নামটির উচ্চারণ মালাজিকার্দ; বাংলায় একে ‘মালাঘাট’ বলা হয়েছে। এই লেখার সর্বত্র আমরা মালাজিকার্দ ব্যবহার করেছি। জানা যায়, প্রাচীনকালে এটি মান্ট্রিকাট নামে অভিহিত ছিল। এটি উত্তর তুরস্কের একটি শহরের নাম, ওয়ান উপ-সাগরের নিকট অবস্থিত এবং আর্মিনিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। অতঃপর নবম শতকে এটি একটি আরবীয় রাজ্যের রাজধানী হয়। ১০০১ সালে এটি বাইজান্টাইদেনর দখলে চলে যায়। ১০৭১ সালের ২৪ আগস্ট এখানে যে ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, ইতিহাসে তা ‘মালাজিকার্দ’ যুদ্ধ নামে খ্যাত। দ্বিতীয় সেলজুক সুলতান আল্প আরসালানের নেতৃত্বে বাইজান্টনের চতুর্থ স¤্রাট রোমানুসের বিরুদ্ধে সংঘটিত এ যুদ্ধে রোমান স¤্রাট ভোজোযোন বন্দি হন এবং তার বিশাল বাহিনী ক্ষুদ্র সেলজুক বাহিনীর নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এ ঐতিহাসিক বিজয়ের ফলে সেলজুকদের জন্য এশিয়ার সকল দ্বার উম্মুক্ত হয়ে যায় এবং তারা রোম সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
ইসলামের ইতিহাসে মালাজিকার্দ যুদ্ধ কেবল তুরস্ক নয়, সমগ্র ইসলামী বিশ্বে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এখন থেকে ৪৬ বছর পূর্বে এ যুদ্ধের ৯০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তুরস্কে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল বলে জানা যায় এবং এ ঐতিহাসিক যুদ্ধ স্মরণে বিভিন্ন মুসলিম দেশের প্রচার মাধ্যম ও সংবাদপত্রে তার প্রতিফলন ছিল। এবারের ৯৪৬তম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ভাষণের কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন, এই যুদ্ধে সুলতান আল্প আরসালানের নেতৃত্বে প্রাক অটোমান উপজাতিরা বাইজান্টাইনদের পরাজিত করে এবং চতুর্থ রোমান স¤্রাট ডায়োজনের সিংহাসন দখল করে। খবরে আরো বলা হয়, পূর্ব মূস প্রদেশের যুদ্ধের ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে এরদোগান বলেন, ‘সুলতান আল্প আরসালান যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। গাজী মুস্তফা কামাল যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, আমরাও সেই সব শত্রæর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি।
তিনি আরো বলেন, ‘১৯১৫ সালের গালিপোলি যুদ্ধে মোস্তফা কামাল আতার্তুক ছিলেন প্রধান অটোমান কমান্ডার যেখানে অটোমান বাহিনী মিত্র বাহিনীর আক্রমণেকে প্রতিহত করেছিল এবং এর মাধ্যমে ১৯২৩ সালে তুরস্কে আধুনিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।’
তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বক্তব্যে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি যুদ্ধের ইঙ্গিত রয়েছে, যার প্রথমটি মালাজিকার্দ যুদ্ধ। এ যুদ্ধের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও সুদূর প্রসারী প্রভাব প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি এবং আনুষঙ্গিক অনেক বিষয় ৯৪৬তম বার্ষিকীতে আলোচিত হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়।
১০৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত সেলজুকী সা¤্রাজ্যের অন্যতম প্রবর্তক ছিলেন তোগরনবেগ। তিনি ইরান ও ইরাক নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলেন যে, মাত্র একবারই মালাজিকার্দ পর্যন্ত গমন করেছিলেন। গজ তুর্কিরা তখন বাইজান্টাইনী এলাকাগুলোতে লাগাতার হামলা চালিয়ে বিপুল পরিমাণে গনিমত নিয়ে আসতো। ইসলামী দুনিয়ার জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক বাইজান্টাইনী সা¤্রাজ্য গজ তুর্কিদের আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়ে তোগরল বেগের নিকট দূত প্রেরণ করে এবং অনুরোধ জানায় যে, বিরোধমূলক বিষয়গুলোকে শান্তিপূর্ণ সমাধান করা হোক। তোগরলকে সন্তুষ্ট করার জন্য তারা কৌশল গ্রহণ করে যে, কয়েক যুগ ধরে অত্যন্ত জীর্ণ ও অবহেলিত অবস্থায় পড়ে থাকা মসজিদগুলো উত্তমরূপে সংস্কার সাধন করে সেগুলোর প্রধান প্রবেশদ্বারসমূহে তোগরল বেগের জঙ্গী নিশান কামান এবং তিনটি তীরের প্রতিচ্ছবি টানিয়ে দেয়। কিন্তু তোগরল বেগ দাবি করেন যে, আব্বাসীয় আমলে তারা যেভাবে বার্ষিক রাজস্ব প্রদান করতো অনুরূপভাবে বাইজান্টাইনী রাষ্ট্রও তা প্রদান করবে। এ দাবি বা শর্তের কারণে তোগরলের সাথে কোনো সন্ধিচুক্তি হলো না এবং তুর্কিদের হামলা অব্যাহত থাকে। হিজরী ৪৫৫ সালের ৮ রমজান তোগরল তার রাজধানী ‘রায়ে’ ইন্তেকাল করেন।
তোগরলের ইন্তেকালের পর তারই ভ্রাতুষ্পুত্র আল্প আরসালান ইবনে মিকাইল ইবনে সেলজুক সিংহাসন লাভ করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎসাহসী ও হৃদয়বান সুলতান। তিনি সে সময়কার বিখ্যাত সুসাশক নিজামুল মুলক তুসীকে তাঁর প্রধান উজির নিযুক্ত করেন। আল্প আরসালানের রাজত্বকালে বাইজান্টাইনি এলাকাগুলোতে গজ তুর্কি তথা তুর্কি উপজাতিদের আক্রমণের ধারা অধিক তীব্রতর হয়ে উঠে, মধ্য আনাতুলিয়া পর্যন্ত এ আক্রমণের ধারা সম্প্রসারিত হয়ে যায়। এ সময় তারা বাইজান্টাইনিদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে নেয়। এ অবস্থায় রোমান স¤্রাট চতুর্থ রোমানুস ডায়োজেন তুর্কিদের এসব হামলা চিরদিনের খতম করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেন। এজন্য তিনি এক বিশাল বাহিনী সমবেত করেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক রাওয়ান্দির মতে, বাইজান্টাইনিদের সংখ্যা ছিল ৬ লাখ। আল জুওয়াইনী বলেন, তিন লাখ এবং অপর এক মত অনুযায়ী দুই লাখ এবং ইবনুল আসিরও শেষোক্ত সংখ্যা উল্লেখ করেছেন। পক্ষান্তরে মুসলিম সৈন্যদের সংখ্যা ছিল মাত্র বারো হাজার।
সুলতান আল্প আরসালান বাইজান্টাইনি এ বিশাল বিস্ময়কর প্রস্তুতির খবর পেয়ে তিনি মিশরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে পূর্ব আনাতুলিয়ায় প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত করেন। সে সময় বাজোন্টাইন স¤্রাট মালাজিকার্দ নামক স্থানে অবস্থান করেছিলেন। যখন তিনি অবগত হন যে, আল্প আরসালান ইলাতে প্রত্যাবর্তন করেছেন, এ খবরে তিনি বিস্মিত হন এবং তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে, উভয় পক্ষের অগ্রগামী বাহিনীগুলোর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে। এতে তুর্কিদের বিজয় সূচিত হয়। শক্র বাহিনীর অগ্রগামী দলের কমান্ডারকে গ্রেফতার করা হয়, যিনি বিরাট ক্রুসেড চিহ্ন পরিহিত ছিলেন এবং তাকে বাগদাদের খলিফার নিকট প্রেরণ করা হয়।
বাইজান্টাইনি সৈন্যরা মালাজিকার্দের নিকট তাবু স্থাপন করেছিল। সৈন্যরা সারারাত অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় অতিবাহিত করে। তাই এ তাবু হতে যে দল বের হয়ে আসতে থাকে সেলজুক বাহিনী তাদেরকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে ফেলতো। শানাই ও নকিল ইত্যাদির শোরগোলের শব্দের কারণেও শত্রæবাহিনীর সাহস বিলীন হয়ে যায়; ততক্ষণে আল্প আরসালান বাইজান্টাইনি ক্যাম্প হতে ৬ কি.মি. দূরত্বে পৌঁছে যান এবং একটি নদীর তীরে ক্যাম্প স্থাপন করেন। উভয় পক্ষ তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য সংকল্প বদ্ধ হয়।
আল্প আরসালানের উত্তমরূপে জানা ছিল যে, সংখ্যার দিক থেকে শত্রæ সৈন্যদের সংখ্যা বহুগুণ বেশি এবং অতি উৎকৃষ্ট সাজ-সরঞ্জাম দ্বারা সজ্জিত তারা। সেলজুক বাহিনী কিছু সময় লাভের উদ্দেশ্যে আব্বাসী খলিফার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সন্ধির প্রস্তাব পেশ করে, কিন্তু বাইজান্টাইনি স¤্রাট দূতগণের সাথে যে আচরণ প্রদর্শন করেন, তাতে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, তিনি তুর্কীদের মোকাবিলায় নিশ্চিত জয় লাভে পূর্ণ বিশ্বাসী এবং বাইজান্টাইনি অগ্রগামী বাহিনীর পরাজয়ের ফলেও তার অহমিকায় কোনো ভাটা পড়েনি এবং তুর্কী সৈন্যরা শত্রæদের উদ্দম উদ্দীপনা হ্রাস করার জন্য যা কিছু করেছে, তাতে তিনি প্রভাবিত নন।
বাইজান্টাইনি স¤্রাট তুর্কী দূতগণকে প্রথম প্রশ্ন করেন, আপনাদের নিকট হামদান উত্তম স্থান, নাকি ইস্ফাহান? আমার বাসনা হচ্ছে আমার ঘোড়াগুলো শীতের মওসুমে হামদানে অবস্থান করবে এবং আমি স্বয়ং ইস্ফাহানে অতিবাহিত করবো। এভাবে তিনি নিজের সংকল্পের কথা স্পষ্ট করেছিলেন। এ বক্তব্যের জবাবে বাগদাদের খলিফার একদূত ক্রুসেড স¤্রাটকে অতি চমৎকার জবাব দেন এবং তা এই যে, নিঃসন্দেহে তা অতি উত্তম হবে যে, আপনার সৈন্যদের ঘোড়াগুলো শীতকালে হামদানে থাকবে, কিন্তু আপনার ব্যাপারে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
এতে বাইজান্টাইনি স¤্রাট এতই উদ্ধত হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি সন্ধির প্রস্তাব সম্পর্কে কথা বলতেও অস্বীকৃতি জানান। বস্তুত দূতগণের প্রতিনিধি দল যখন বলল যে, আপনি সন্ধির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করুন এবং নিজের দেশে চলে যান, তখন স¤্রাট বললেন, আমি মুসলমানদের এহেন আচরণের মজা দেখানো ব্যতীত প্রত্যাবর্তন করবো না, যা তারা বাইজান্টাইনি গ্রিকদের সাথে প্রদর্শন করেছে। আমি এ অভিযানে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছি সুতরাং আমার প্রত্যাবর্তন করার প্রশ্নই আসতে পারে না।
(চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন