রোহিঙ্গারা পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটের উত্তরাংশে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠী। এদের বেশির ভাগই মুসলমান। রাখাইন স্টেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হলো রোহিঙ্গা। সংখ্যায় প্রায় ২০ লাখ। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও উগ্র রাখাইনদের সা¤প্রদায়িক আক্রমণের শিকার হয়ে প্রায় ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানিদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব। পরবর্তী সময়ে চাটগাঁইয়া, রাখাইন, আরাকানি, বার্মিজ, বাঙালি, ভারতীয়, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের মিশ্রণে এই জাতি ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। রোহিঙ্গাদের বসবাসস্থল রাখাইন রাজ্য। এর আদি নাম আরাকান। এ নামকরণ প্রমাণ করে মুসলিম ঐতিহ্যের কথা। কারণ ইসলামের পাঁচটি মূল ভিত্তিকে একত্রে বলা হয় আরকান। আর এই আরকান থেকেই তার অনুসারী মুসলমানদের আবাস ভূমির নামকরণ করা হয়েছে আরাকান। ধারণা করা হয়, রোহিঙ্গা নামটি এসেছে আরাকানের রাজধানীর নাম ম্রোহং থেকে : ¤্রােহং>রোয়াং>রোয়াইঙ্গিয়া>রোহিঙ্গা। তবে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে আরাকানের উল্লেখ রয়েছে রোসাং নামে।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার। দেশের রাষ্ট্রপতি সেনা প্রধান থিন কিয়াও ও বৌদ্ধ ভিক্ষু আশ্বিন উইরাথু-এর প্ররোচণায় নিধন করা হচ্ছে সেদেশের প্রকৃত নাগরিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখলের পর থেকেই শুরু হয় রোহিঙ্গা নিধন। এরপর ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গাদের উপর চলে নির্যাতন এ গণহত্যা। ফলে উক্ত বছর দুটিতে দুই লাখ ও আড়াই লাখ শরণার্থীদের বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছিল। ২০১২ সালেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। রোহিঙ্গাদের আবাস তৎকালীন রোসাঙ্গ বা আরাকান বাংলাদেশের পূর্ব-দক্ষিণ সীমান্তের দিকে। ২৭১ কি.মি. সীমানা আমাদের সেদিকে। যখনই এই রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন হয়েছে তখনই তারা আশ্রয় লাভের আশায় নাফ নদী ও পাহাড়ি এলাকা পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের দিকে শরণার্থী হিসেবে এসেছে।
পূর্বের থেকে এবার শরণার্থী এসেছে তুলনামূলক সংখ্যায় বেশি। সরকারি বেসরকারি হিসাব মতে প্রায় চারলাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে এসেছে। অনেক রোহিঙ্গা কক্সবাজার থেকে বাসে করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে গেছে।
মানবিক কারণে তাদেরকে আশ্রয় দেয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা যদি তাদের এ রকম চরম দুর্দিনে আশ্রয় না দেই তাহলে তারা কোথায় যাবে? রোহিঙ্গাদের পুরুষ এবং উঠতি বয়সের যুবকদের হত্যার কারণেই চারলাখ শরণার্থীর অধিকাংশই শিশু। অবশিষ্ট নারী ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সরকার শরণার্থীদের সেবা ও সহযোগিতার জন্য সারাবিশ্বের কাছে হয়েছে প্রশংসিত। বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে আমরা চিহ্নিত করি অধিক জনসংখ্যাকে। আর রোহিঙ্গারা এসে এই অধিক জনসংখ্যার উপরে বোঝার উপর শাকের আঁটি’র মতো হয়েছে। ইউএনএইচসিআর-এর বিধিমোতাবেক তাদেরকে তাদের দেশেই ফিরত পাঠানো হোক। জাতিসংঘের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে সে দেশের নাগরিকত্ব প্রদানের মাধ্যমে মিয়ানমারে তাদেরকে পুনর্বাসিত করা হোক। না হলে এই ক্ষুদ্র ভূখন্ডে এত জনসংখ্যার চাপ নানা প্রভাব ছড়াবে।
লেখক : এম ফিল গবেষক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন