বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো। আবার প্রমাণ হলো- এদেশ মানবতার দেশ, সাম্যের দেশ, সহানুভূতি, মানবিকতার ও মানবাধিকারচেতনার দেশ। বর্বরতা ও জেনোসাইডের শিকার পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা পানির স্রোতের মত প্রাণ ভয়ে ছুটে এসেছে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায়। জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ১৪ নং ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫-এ বলা হয়েছে রাষ্ট্র তার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ চার্টারকে সম্মান দেখাবে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২-এ বলা হয়েছে, যে কোন ব্যক্তির জীবন ও স্বাধীনতার অধিকারকে বঞ্চিত করা যাবে না, যা আইনগত কোন পদ্ধতি বা উপায় ব্যতীত। এখানে ‘পারসন’ বা ‘ব্যক্তি’ এবং ‘সিটিজেন’ বা ‘নাগরিক’ শব্দগুলোর ব্যবহার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কে বাংলাদেশের নাগরিক, কে নয় তা বিবেচ্য নয়। বাংলাদেশের জন্য শরণার্থী সমস্যা একটি প্রকট সমস্যা। বাংলাদেশের ১১৬টি ক্যাম্পে প্রায় ২ লক্ষ উর্দুভাষী শরণার্থী বসবাস করছে। তাদের কখনো ‘অবাঙ্গালী’, কখনো ‘আটকে পড়া পাকিস্তানী’ কখনো ‘বিহারী’ বলা হয়। ১৯৪৬-৪৭ সালের ভয়াবহ সা¤প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞের হাত থেকে পালিয়ে জীবন বাঁচাতে তারা এখানে চলে আসে। তাদের জীবনও অনেকটা মানবেতর। তার ওপর নতুন পুরাতন মিলে প্রায় ১০ লাখ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থী যেন গোদের অপর বিষফোঁড়া। এসব শরণার্থীর নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো শরণার্থী আইন নেই। ১৯৫১ সালের শরণার্থী বিষয়ক কনভেনশন-এ সুরক্ষার বিষয়টি উল্লেখ আছে। আর ১৯৬৭ সালের প্রটোকল সে কনভেশনের সুরক্ষা দেয়া হলেও বাংলাদেশ এ দুটির কোনটিই স্বাক্ষর করেনি। ফলে এখানে একটি আইনি কাঠামোর শূন্যতা রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী বিষয়ক আইন থাকলেও বাংলাদেশে এ ধরনের কোন আইন না থাকায় বাংলাদেশে ভূখন্ডে আশ্রয় নেয়া এ বিশাল জনগোষ্ঠিকে নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা দেয়া দুরুহ হয়ে পড়েছে। অবিলম্বে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিশাল শরণার্থী জনগোষ্ঠিকে নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষার জন্য একটি আইনি কাঠামো তৈরির জন্য সরকার, আইন প্রণেতাগণ, বিচারপতি ও আইন কমিশনের আশু দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। রোহিঙ্গারা ‘রাষ্ট্রহীন’ না ‘উদ্ভাস্তু’ নাকি ‘শরণার্থী’ তা বুঝা দরকার।
Refugee - এ শব্দের বঙ্গানুবাদ ‘শরণার্থী’ ও ‘উদ্বাস্তু’ উভয় শব্দই বাংলায় চালু আছে। এক্ষেত্রে ‘শরণার্থী’ শব্দটিকে পছন্দ করা হয়েছে ইংরেজি ও বাংলা বুৎপত্তির দিকে নজর রেখে। ইংরেজি ভাষায় Refugee (অর্থাৎ ‘শরণ’) থেকেই Refugee শব্দের উৎপত্তি। ‘শরণার্থী’ শব্দের উৎপত্তি অনুরূপভাবে। উদ্বাস্তু শব্দটি ভেতরে ভেতরে ‘বাস্তুচ্যুতি’ বা ‘বাস্তুত্যাগ’ অর্থটি বহন করে, কিন্তু Refugee শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থের সঙ্গে সঙ্গতি রাখে না। তাছাড়া সব ‘বাস্তুচ্যুত’ বা ‘বাস্তুত্যাগী’ ব্যক্তি আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত Refugee সংজ্ঞার ভেতরে পড়ে না। UNHCR-এর প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত নির্দেশনায় শরণার্থীদেরকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, ‘যারা বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা, রাজনৈতিক মতাদর্শ অথবা কোনো নির্দিষ্ট সামাজিক গোষ্ঠির সদস্য হওয়ার কারণে নিশ্চিত নিগ্রহের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে এবং ফিরে আসতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক।’ এককথায় শরণার্থীরা হলো জীবন এবং স্বাধীনতা হারাবার ভয়ে দেশত্যাগী পলাতক নারী-পুরুষ এবং শিশু। তবে শরণার্থীদের মর্যাদা সংক্রান্ত ১৯৫১ সালের কনভেনশন অনুযায়ী শরণার্থী মানে, ‘এমন একজন ব্যক্তি, যার নিজ জনগোষ্ঠী, ধর্ম, জাতীয়তা, বিশেষ কোন সমাজের সদস্যপদ, অথবা রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে সু-প্রতিষ্ঠিত যন্ত্রণা ভোগের আশঙ্কা রয়েছে, তার নিজ দেশের বাহিরে অবস্থান করছে এবং সে তার দেশের সুরক্ষা পেতে অনিচ্ছুক বা তার দেশ তাকে সুরক্ষা দিতে অক্ষম বা যে ব্যক্তি যন্ত্রণা ভোগের আশঙ্কার কারণেই তার নিজ দেশে ফিরে যেতে অনিচ্ছুক। ১৯৫১ সনের কনভেনশানে উল্লেখিত সংজ্ঞার যথেষ্ঠ দুর্বলতাও আছে; যেমন- ১। কোন একজন লেখকের মতানুযায়ী এই সংজ্ঞাটিতে সার্বজনীনতার চেয়ে আঞ্চলিকতাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। এ সংজ্ঞাটি স্নায়ু যুদ্ধের ও ইউরোপ কেন্দ্রিক জটিলতার ফলাফল। তৎকালীন রাশিয়ার শরণার্থীদের পুনর্বাসনের বিষয়ই এ সংজ্ঞাতে প্রতিফলিত হয়েছে। এ সংজ্ঞায় টেকসই আশ্রয় ও স্থায়ী পুনর্বাসনের উপর জোর দেয়া হয়েছে। কিন্তু স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের বিষয়ে এতে কোন উল্লেখ নেই। ২। এ সংজ্ঞায় দু’টো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দেয়া হয়েছে (ক) প্রত্যাবাসন, (খ) রাষ্ট্রীয় দায়, যেটা শরণার্থী প্রবাহ ঘটায়। ৩। শরণার্থীদের যন্ত্রণাভোগের যে কারণগুলো সংজ্ঞায় উল্লেখ করা হয়েছে তা খুব সীমিত। ৪। জীবন রক্ষার অধিকার মৌলিক অধিকার। তাই খাদ্য সংকটের কারণেও কেউ নিজেকে শরণার্থী দাবি করতে পারে। ৫। ও.আই.ইউ কনভেশন ১৯৬৯ সালে একটি আঞ্চলিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। ঐ চুক্তিতে শরণার্থীর এ সংজ্ঞার সাথে যুক্ত করা হয়, ‘যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত আগ্রাসন পেশা, বিদেশি কর্তৃত্ব বা এমন কোন ঘটনা যা তার দেশের সরকারের ব্যাঘাত সৃষ্টি করে ইত্যাদি কারণে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয় সেও শরণার্থীর অন্তর্ভুক্ত হবে।’
জীবন রক্ষার অধিকার মৌলিক অধিকার। তাই খাদ্য সংকটের কারণে কেউ নিজেকে শরণার্থী দাবি করতেই পারে। এছাড়াও আরো অনেকগুলো কারণ আমরা দেখতে পাই, যা সংজ্ঞায় স্থান পায়নি। শরণার্থী হিসেবে পরিগণিত হবার জন্য কিছু উপাদান বাঞ্চনীয়; যেমন- ১। নিজ দেশ বা জাতীয়তার বাহিরে অবস্থান করতে হবে। ২। তারা তাদের দেশের সুরক্ষার সুযোগ গ্রহণে অক্ষম বা অনিচ্ছুক হতে হবে। ৩। এ ধরনের অক্ষমতা বা অনিচ্ছুকতা যন্ত্রণা ভোগের সুপ্রতিষ্ঠিত আশঙ্কার কারণে হতে হবে। ৪। যন্ত্রণা ভোগের আশঙ্কার কারণে হতে হবে। ৫। উপাদানে যে আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে তা অবশ্যই যৌক্তিক হতে হবে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছে, একজন সৈনিক বা অপরাধী বা যুদ্ধাপরাধী শরণার্থী হতে পারে কিনা। একজন শরণার্থী বেসামরিক ব্যক্তি একজন ব্যক্তি যে আশ্রয় প্রাপ্ত রাষ্ট্র হতে তার দেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যায় সে কখনো শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হবে না এবং সবার চোখে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত কোন কার্যের অপরাধী তার পলায়নকৃত অবস্থায় শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হবে না। অর্থাৎ কোন অরাজনৈতিক অপরাধী শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হবে না। কিন্তু কোন সাধারণ অপরাধের অপরাধী যদি রাজনৈতিক কারণে দেশ থেকে পালিয়ে বেড়ায় তাহলে সে শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হবে। রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে যদি কেউ অপরাধী হয় তাহলে অবশ্যই শরণার্থী হতে পারে। যুদ্ধাপরাধীর শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় লাভের প্রশ্নে বলা যায়, যে ব্যক্তি বা যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে বা গণহত্যার মত আর্ন্তজাতিক আইন ভঙ্গকারী কোন গণ সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অংশ গ্রহণ করেছে তারা কখনোই শরণার্থী বিবেচিত হবে না।
শরণার্থীদের বিভিন্ন প্রকারভেদ আছে:
বিধিবদ্ধ শরণার্থী: ১৯৫১ সালের কনভেশনের অনুচ্ছেদ ১ ক (১) চ-তে নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণকে বিধিবদ্ধ শরণার্থী বলা হয়েছে। ক। ১৯২৬ সালের ১২ মে এবং ১৯২৮ সালের ৩০ জুনের এরেঞ্জমেন্টের অধীনে যাদের শরণার্থী ঘোষণা দেয়া হয়েছে। খ। ১৯৩৩ সালের ২৮ অক্টোবর ও ১৯৩৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারির কনভেনশনে যাদের শরণার্থী ঘোষণা দেয়া হয়েছে। গ। ১৯৩৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বরের প্রটোকল বা আইআরসি-এর সংবিধান অনুযায়ী যাদের শরণার্থী ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
Mandate Refugee: ১৯৭৫ সাল থেকে সাধারণ পরিষদ, ECOSOCএবং UNHCR এর নির্বাহী কমিটি ইউরোপের বাইরের শরণার্থীদের সৃষ্ট অবস্থাকে সায় দেয়ার জন্য বিচিত্র পদ্ধতি অবলম্বন করে। মানব গড়া ও প্রকৃতি প্রদত্ত যে কোন ধরনের ভিকটিমকে, যারা শরণার্থী, সাহায্য করার জন্যUNHCR কে ক্ষমতা দেয়া হয়। তখন UNHCR কিছু বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যে কোন ব্যক্তি, সে ১৯৫১ সালের কনভেনশন অনুযায়ী শরণার্থী হোক বা না হোক, Mandate Refugee হিসেবে বিবেচিত হবে। Host Country তাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে কি দিচ্ছে না তা বিবেচ্য বিষয় নয়।
অস্থায়ী সুরক্ষা: অস্থায়ী সুরক্ষা হচ্ছে তাৎক্ষণিক ও অল্প মেয়াদী সুরক্ষা যা যে দেশে পলায়ন করা হয়েছে সে দেশ কর্তৃক গৃহীত হয়। এ পালানোটা সশন্ত্র সংঘাত, মানবাধিকার লংঘন বা অন্য কোন যন্ত্রণা ভোগের কারণে হতে হবে। অস্থায়ী সুরক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে সীমানা রাষ্ট্রের আশ্রয় নিশ্চিত করা এ ধরনের অস্থায়ী সুরক্ষা উদ্ভাবক হচ্ছে ইউরোপীয় দেশগুলো এবং এটা করা হয়েছিল তৎকালীন যুগোশ্লাভিয়া হতে পলায়নরত জনগণের জন্য। সাধারণত অস্থায়ী শরণার্থী বা সুরক্ষার চর্চা সীমিত সময়ের জন্য করা হয় যাতে গ্রহণকারী রাষ্ট্রের উপর সেটা বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়। শরণার্থী অথবা আশ্রয় প্রার্থনাকারীর চূড়ান্ত আশ্রয়স্থল অন্য রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রসমূহ। যে দেশ অস্থায়ী ভিত্তিতে কোন শরণার্থী গ্রহণ করে তাকে Country of First Refugee বলা হয়। অস্থায়ী সুরক্ষা বা অস্থায়ী শরণার্থী নীতির অধীনে শরণার্থী বা আশ্রয় প্রার্থীর সীমিত অধিকার থাকে। কোন কোন লেখক অস্থায়ী শরণার্থীদের প্রথাভিত্তিক আন্তর্জাতিক আইনের অংশ বলে দাবি করেন। প্রয়োজন ও মানবতার ভারসাম্যের উপর ভিত্তি ধরে এ নীতি উদ্ভাবিত হয়েছে। তারা বিভিন্ন দেশের অস্থায়ী সুরক্ষা নীতির চর্চাকে উল্লেখ করেন, যে সমস্ত রাষ্ট্র প্রচুর পরিমাণ শরণার্থী অথবা আশ্রয় প্রার্থীদের আশ্রয় মঞ্জুর করেছে। এশিয়া ও আফ্রিকান রাষ্ট্রসমূহ লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের আশ্রয় মঞ্জুর করেছে। ১৯৬৯ সালের OAU কনভেশনকে আফ্রিকান দেশসমূহ আশ্রয় মঞ্জুরের জন্য আইনী ভিত্তি মনে করে।
Refugee Surplace: যে ব্যক্তি নিজস্ব কোন বৈধ কারণে অন্য দেশে গমন করে কিন্তু পরবর্তীতে অবস্থার পরিবর্তনের কারণে দেশে ফিরে এলে তার যন্ত্রণাভোগের আশঙ্কা থাকে এবং এই যন্ত্রণাভোগের সু প্রতিষ্ঠিত আশঙ্কার কারণে যদি সে নিজ দেশে ফিরে আসতে না চায় বা তার দেশ তাকে যথাযথ সুরক্ষা দিতে না চায় তাকে Refugee Surplace বলে। রাষ্ট্রীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে যদি সে পূর্ববর্তী রাষ্ট্রে ফিরে যেতে না পারে এবং তা যদি যন্ত্রণাভোগের সুপ্রতিষ্ঠিত কারণে হয় তাহলে সেও †mI Refugee Surplace হবে।
রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি: যার কিংবা যে ব্যক্তির জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে নাগরিকত্ব নেই তিনিই রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি। একজন রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি কোন দেশের কাছে নাগরিকত্ব দাবি করতে পারে না। এ বিষয়টি ১৯৫৪ সালের কনভেশনের আর্টিক্যাল ১-এ বর্ণিত আছে। Open Society Justice Initiative এর নির্বাহী পরিচালক James Cold Stone রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন, ‘তারা চরম অবহেলিত মানব/ জনগণ। এ সমস্যাটা এখনও বজায় আছে এ কারণে যে, জাতি রাষ্ট্রসমূহ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে কোন ব্যক্তির নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া বা কোন ব্যক্তিকে নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যাপারে সীমাহীন স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়োগ করে।’
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিরা এমন কার্যকর বিস্মৃত বা অবহেলিত অবস্থায় আটকে আছে যে তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কোন আইনী সুরক্ষার (যেমন: স্বাস্থ্যের অধিকার, শিক্ষক অধিকার ইত্যাদি) পায় না। নিম্নলিখিত কারণে রাষ্ট্রহীনতার সৃষ্টি হতে পারে। যেমন- আইনী জটিলতার কারণে, যেমন- পিতা মাতার নাগরিকত্ব না থাকলে সন্তানদের ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব আইনের জটিলতা, প্রশাসনিক জটিলতা, নাগরিকত্ব হারানো বাতিলের কারণে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাতিসত্ত¡া বিলোপ কিংবা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের বিলোপ ঘটলে, ইত্যাদি কারণে।
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় মিয়ানমার সেনাসহ অন্যান্য বাহিনীর গণহত্যার শিকার হয়ে আত্মরক্ষার্থে যারা জীবন বাঁচাতে ভিটেমাটি ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে, তাদের দেশে নিরাপদে প্রত্যাবর্তন না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের সীমানায় তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে এবং তাদের বলপূর্বক প্রত্যাবর্তন করা থেকে বিরত থাকা হয়েছে। কারণ তাদের পুশব্যাক করা মানে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া। তাদের আশ্রয় লাভের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে এ বিশাল বাস্তুহারা লোকজনকে নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন করতে হবে। যাতে তারা সুরক্ষা পায় এবং বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা, পরিবেশ ইত্যাদিতে সংকট সৃষ্টি না হয়। এতে শরণার্থীদের উপযুক্ত আইনগত মর্যাদা ও নিরাপত্তা দেয়া যাবে এবং দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি রোধ হবে। এতে শরণার্থীদের আচরণ বিধি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনসহ তাদের তৃতীয় কোন রাষ্ট্রে প্রদানেও আশ্রয় সহায়তা করা যায়। সংশ্লিষ্ট সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ বজায় রেখে অথবা ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে তাদের ফেরত পাঠাতে হবে এবং তাদের শরণার্থী পরিচয় ঘোচানোর চেষ্টা চালাতে হবে। সাধারণ ক্ষমার আওতায় তারা প্রত্যাবাসন করতে চাইলে দ্রুত তাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা, শরণার্থী পরিবারগুলোকে একত্রিতকরণ ও সুরক্ষার মাধ্যমে মানবিক বিপর্যয় থেকে তাদের রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। বিপুল শরণার্থীর ঢল নেমে এলেও স্থানীয় জনগণ ও বাংলাদেশের মানবাধিকারচেতনাধারী মানুষ পরিস্থিতির মোকাবেলায় নজির সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দ্রুত এগিয়ে আসেনি এবং মিয়ানমারের মানবতা বিরোধী অপরাধ বন্ধ করতে পদক্ষেপ নেয়নি। এখন পর্যন্ত খাদ্য, পানি, পয়ঃনিস্কাশন, আশ্রয় ও চিকিৎসা সুবিধাদি নিশ্চিত হয়নি। শরণার্থীদের অধিকাংশ নারী এবং শিশু ও অশীতিপর বৃদ্ধ। ইউনিসেফ বলছে, রোহিঙ্গা শিবিরে ১৩ শতাধিক শিশু অভিভাবকহীন, এদের অনেকের মা-বাবা আরাকানে সহিংসতায় নির্মম হত্যার শিকার, নয়তো বাংলাদেশে দীর্ঘ বিপদসংকুল পথ পেরিয়ে আসার সময় হারিয়ে গেছে। এদের প্রতি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিশেষ দৃষ্টি আবশ্যক। সরকারের উচিত, এ মুহূর্তে কূটনৈতিক তৎপরতা বা জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় দ্রুত তাদের কান্ট্রি অব অরিজিন বা উৎস রাষ্ট্রে ফেরত পাঠানো। যাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন সম্ভব নয় তাদের তৃতীয় দেশে শরণার্থী অভিবাসনই একমাত্র সমাধান। বর্তমান প্রকট শরণার্থী সংকটের স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে ব্যাপক তৎপরতা চালাতে হবে। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় ও বন্ধু রাষ্ট্রসমূহকে কাজে লাগাতে হবে। যারা বলছেন শরণার্থীদের চলে যেতে, তাদের বলি, এটা সম্ভব হলে তারা চলে যেত। কেননা, স্বদেশ হারাবার মতো বড় বেদনা পৃথিবীতে আর কিছু নেই। তারা স্ব-ভূমিতে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে তাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকার ও ইউএনএইচসিআরকে যুগপৎ কাজ করতে হবে। তবে তাদের অস্থায়ী সুরক্ষার জন্য একটি শরণার্থী নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা আইন এখন সময়ের দাবি।
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন