মিয়ানমারের রোহিং এলাকায় যারা বসবাস করেন তারাই রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। রোহিঙ্গা শব্দের অর্থ নৌকার মানুষ। যারা সমুদ্রে নৌকার সাহায্যে মৎস্য আহরণ করে জীবিকা অর্জন করেন। ইতিহাসবিদদের মতে, আরবি শব্দ রহম থেকে রোহিঙ্গা শব্দের উদ্ভব। অষ্টম শতাব্দীতে আরবের বাণিজ্য জাহাজ রামব্রি দ¦ীপের তীরে এক দুর্ঘটনার কারণে ভেঙ্গে পড়ে। তখন তারা বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে রহম, রহম, বলে দয়া প্রার্থনা করে। মহান আল্লাহপাক তাদের বাঁচিয়ে দেন। তখন থেকেই তারা রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি পায়। রাখাইন রাজ্যের জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী। বিভিন্ন তথ্যানুসারে বহুকাল আগে থেকেই রোহিঙ্গারা বসবাস করছে সে অঞ্চলটিতে। মিয়ানমার বিট্রিশ শাসন মুক্ত হয়েই রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করার বিভিন্ন প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে থাকে। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১০ লাখের ওপর, সৌদি আরবে ৪ (চার) লাখ, পাকিস্তানে ২(দুই) লাখ এবং থাইল্যান্ডে ১ (এক) লাখ। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির ওপর নৃশংস রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও নিপীড়ন পৃথিবীর সকল শান্তিপ্রিয় মানুষকে হতবাক করেছে। মানুষ হিসেবে আজ তাদের কোন বেঁচে থাকার অধিকার নেই, নেই কোন মানবাধিকার। জাতিসংঘই বলেছে, বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠির নাম রোহিঙ্গা। নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধে জাতিসংঘ উদ্যোগ গ্রহণ করলেও অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়নি। মিয়ানমার স্বীকার করুক বা না করুক রোহিঙ্গারা ঐতিহাসিকভাবেই সে দেশের নাগরিক। বিশ্বের কোথাও যদি শান্তি বিঘিœত হয়, মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার যদি না থাকে সেখানে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, মানুষের বসবাসের অধিকার ফিরিয়ে দেয়াই জাতিসংঘের দায়িত্ব ও কর্তব্য। বৌদ্ধ রাখাইনদের টার্গেট হলো নিরস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্যাতনের মাধ্যমে নির্মূল করে দেওয়া, দেশ ত্যাগে বাধ্য করা। সেই লক্ষ্যে মিয়ানমার সরকার, সেনাবাহিনী অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য গণহত্যা চালাচ্ছে। অং সান সূচি ও তার দল এনএলডি লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছে। বৌদ্ধ ধর্মের মূল নীতি হলো অহিংস হওয়া। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে মানবতার জয়গান গাওয়া। গৌতম বুদ্ধ তাঁর অনুসারীদের অহিংস হওয়ার শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তিনি সর্বজীবে দয়া ও অহিংসা মন্ত্রের চর্চা করে গেছেন। মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের সম্পূর্ণ বিপরীত ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই সূিচর রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল সমর্থক। সূচির ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। অং সান সূচি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু তিনি মুসলিম রোহিঙ্গাদের নির্য়াতনের বিষয়ে কথা বলছেন না। তার নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবি উঠেছে। পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবি ক্রমাগত জোরালো হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ সূচির নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের পক্ষে। আন্তর্জাতিক শান্তি এবং ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠায় যারা কাজ করেন তারই নোবেল পুরস্কার পেয়ে থাকেন। সূচির মতো যারা এই পুরস্কার পেয়েছেন তারা আজীবন এই মানবিক মূল্যবোধ রক্ষা করবেন পৃথিবীর মানুষ স্বাভাবিকভাবেই এটি প্রত্যাশা করে। কিন্তু অং সান সূচির ভূমিকা পুরস্কার প্রত্যাহার বা ফিরিয়ে নেয়ার দাবিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলছে। যখন একজন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী তার নিজ দেশে ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় শান্তি রক্ষায় ব্যর্থ হন, নির্যাতনের কারণে সংখ্যালঘুরা দেশ ত্যাগে বাধ্য হয় তখন শান্তি রক্ষার স¦ার্থেই নোবেল শান্তি কমিটির উচিত শান্তি পুরস্কার জব্দ করা অথবা শান্তির স্বার্থেই নতুনভাবে চিন্তা করা। নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে কারও পুরস্কার এখনও প্রত্যাহার হয়নি এটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি সত্য মিয়ানমারের মতো অন্য কোন দেশে সংখ্যালঘু মানুষও এ ধরনের অমানবিক নৃশংস গণহত্যার শিকার হয়নি। সকল ধর্মই বলে মানুষ হত্যা মহাপাপ। অথচ মিয়ানমারের বৌদ্ধ নেতারা নীরব। তারা কেন গৌতম বুদ্ধের অহিংস বাণীগুলো অনুসরণ করেন না, ধারণ করেন না। সকল ধর্মের শিক্ষাই হলো বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব ও মানবতা। মানবাধিকারের মূল কথা হলো ব্যক্তির মানবসত্তা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, রোহিঙ্গারা কোন মানব তো নয়ই, এমনকি তারা কোন প্রাণীই নয়। কারণ যারা সত্যিকারের মানব সন্তান তারা অন্য প্রাণীর প্রতিও মায়া-মমতা দেখাবে। মানুষ হয়ে অন্য মানুষের বিপদাপদে সহমর্মিতা সাহায্য-সহযোগিতা না করা মহাপাপ। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে চলাচল ও বসতি স্থাপনের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, নির্যাতন এড়ানোর জন্য প্রতোকেরই অপর দেশসমূহে আশ্রয় প্রার্থনা ও ভোগ করার অধিকার রয়েছে। ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, কাউকে তার সম্পত্তি থেকে খেয়াল খুশি মতো বঞ্চিত করা চলবে না। ২২ ধারায় বলা হয়েছে, সমাজের সদস্য হিসেবে প্রত্যেকেরই সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে। প্রত্যেকেই জাতীয় প্রচেষ্টা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এবং প্রতিটি রাষ্ট্রের সংগঠন ও সম্পদ অনুসারে তার মর্যাদা ও অবাধে ব্যক্তিত্ব বিকাশে অপরিহার্য অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারসমূহ আদায় করার জন্য সত্ত¡বান। সদস্য রাষ্ট্রসমূহ যাতে মানুষের মানবাধিকার হরণ না করতে পারে সেজন্য জাতিসংঘ অঙ্গিকারবদ্ধ। মানবাধিকারের বিষয়টি কোনো রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয় নয়।
রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অধিকার পুনঃ প্রতিষ্ঠাই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। মানবাধিকার রক্ষার জন্যই বাংলাদেশের সম্পদ ও ভূমি সীমিত থাকা সত্তে¡ও লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নির্মম নির্যাতন পৃথিবীতে নজিরবিহীন নির্যাতনের ঘটনা। রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের নিজস্ব সমস্যা। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার চিন্তা করতে পারে বলে মনে করি। রোহিঙ্গারা শত শত বছর ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করছে। জন্মগতভাবেই তারা সেখানকার নাগরিক। ১৯৪৮ সালে স্বাধীন বার্মার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন জেনারেল অং সান। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই অং সান ও তার মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের ব্রাশ ফায়ারে হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয় সেনাবাহিনী। তখন থেকেই বার্মা চলে যায় সামরিক শাসনের অধীনে। পৃথিবীর অন্য কোন দেশ এত দীর্ঘ সময় সামরিক শাসনের অধীনে থাকার রেকর্ড নেই।
১৯৮২ সালে সামরিক সরকার মিয়ানমারের সংবিধান সংশোধন করে রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন মানুষে পরিণত করে। মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আজীবন আন্দোলন করে সূচি ক্ষমতায় এসেছেন, শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। মিয়ানমারের কথিত গণতন্ত্রের নেত্রীকে মার্কিন সাংবাদিক অ্যালেন ক্লেমেন্টস ক্ষমতাহীনদের ক্ষমতার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। অ্যালেন ক্লেমেন্টস এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে অং সান সূচি বলেছিলেন, ‘আমরা এমন একটা বিশ্বে বসবাস করতে চাই যেখানে দেশগুলো মানবিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে। আমার ভয় হলো আমরা যদি সহিংস পদ্ধতিতে গণতন্ত্র অর্জন করি তাহলে ভবিষ্যতে যে কোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এ আইডিয়া বা ধারণা থেকে আমরা কোনোভাবেই রেহাই পাবো না। এটা শুধু আমাদের শক্তিশালী গণতন্ত্র গড়ে তুলতে সাহায্য করে না, এটাও শেখায় যে, সহিংসতা কোনো সঠিক পথ নয়।’ কিন্তু এখন সূচি এত নিষ্ঠুর কেন? কেন তিনি এত অমানবিক, কেন এত নীরব ও নিস্তব্ধ। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সূচির দেশ মিয়ানমারে যে নিষ্ঠুর অমানবিক নির্যাতন মানুষের উপর চালানো হচ্ছে, এমন নির্যাতন আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগকেও হার মানায়। রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের কথা আসলেই মানুষ হিটলারের কথা বলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করেছিল। মিয়ানমারের অমানবিক নিষ্ঠুর নির্যাতনের অবস্থা দেখে মনে হয়, সূচি হিটলারের মতই নিষ্ঠুর। সূচি যদি প্রতিবাদী না হন, সংখ্যালঘু মানুষের উপর অত্যাচার বন্ধ না করেন তাহলে পৃথিবীর মানুষ হয়তো হিটলারের নাম ভুলতে শুরু করবে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বাড়িতে ঢুকে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে। শিশুদেরকে হত্যা করছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মেয়েদের তুলে নিয়ে ধর্ষণ করছে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতি এমন অমানবিক আচরণ দেখা যায়নি। রোহিঙ্গাদের ওপর যেভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে বা হচ্ছে তা বর্ণনাতীত। ফেসবুকে এসব নির্যাতনের দৃশ্য দেখে বিবেকমান মানুষ মাথা ঠিক রাখতে পারে না। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক রোহিঙ্গার মর্মস্পর্শী চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের অবস্থা হলো, খাঁচার ভেতরে ক্ষুধার্ত বিড়ালের সামনে একটি অসহায় ইঁদুরের মতো। আমার সারা জীবন মানে জীবনের ২৪টি বছরই আমি এই উন্মুক্ত কারাগারে বাস করেছি। আপনারা যাকে বলছেন রাখাইন। আমার বাবা মায়ের মতো আমিও মিয়ানমারে জন্মগ্রহণ করেছি। তবে আমার জন্মের আগেই আমার নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছি। আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় যদি বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত এই জনগোষ্ঠীর পাশে না দাঁড়ায় তবে আমরা শেষ হয়ে যাব। সেক্ষেত্রে আপনারাও হবেন এই অপরাধের একটি অংশ। আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হলো পালিয়ে যাওয়া অথবা আমাদের কেউ উদ্ধার করবে এই আশায় থাকা।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট এবং সভাপতি, লেখক ফোরাম, মৌলভীবাজার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন