আজ তুরস্কের জাতীয় দিবস। ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর তুরস্ক ওসমানীয় সালতানাত থেকে প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের যুগ যুগ যাবৎ সুসম্পর্ক বিদ্যমান। স¤প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটে তুরস্ক বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সাথে নিয়ে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের স্ত্রী বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। এখানে এসে গমন করেন উখিয়া। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের করুণ অবস্থা অবলোকন করে তাদের জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন তিনি। দুই লাখ শরণার্থীর দায়িত্ব নিয়েছে তুরস্ক সরকার। সুলতানী আমল থেকে আমাদের দেশের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক বহমান। এর মূলে ছিল তিন কারণ : (১) মুসলিম দেশ, (২) বর্তমান সউদী আরবের হেজাজ অঞ্চলে পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনা তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং (৩) তাদের বিশাল সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার বৃহত্তর স্বার্থে চট্টগ্রাম বন্দরে নির্মিত জাহাজ ক্রয় করতো তারা।
১২৮৮-১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৩৭ জন সুলতান ৬৩৬ বছরব্যাপী ওসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। প্রথম ৩ শ’ বছর সুলতানগণের যোগ্যতার কারণে জয়জয়কার অবস্থা ছিল। ইউরোপ, আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়ার বিশাল অংশ নিয়ে ছিল তাদের সাম্রাজ্য। শেষের ৩ শ’ বছরে যোগ্য শাসক ছিল মাত্র কয়েকজন। অপর শাসকগণ ছিলেন অযোগ্য। ছিল না তাদের শাসকসুলভ গুণাবলী। এমনি প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যের বহু অংশ হাত ছাড়া হয়ে যায়। তুরস্কের নাজুক পরিস্থিতিতে ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণকারী সামরিক কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল পাশা তুরস্কের হাল ধরতে পর্যায়ক্রমে এগিয়ে আসতে থাকেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ২৭ সেপ্টেম্বর ইস্তাম্বুল থেকে আঙ্কারায় সরিয়ে নেন রাজধানী। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ অক্টোবর মোস্তফা কামাল পাশা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এ বছরই ২৮ অক্টোবর দিবাগত রাতে নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও অনুমোদনের মাধ্যমে তুরস্ক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।
বর্তমান তুরস্কের পরিধি ১০ লক্ষ ১ হাজার ৫ শত বর্গ কি.মি. যা আমাদের দেশের চেয়ে প্রায় ৬ গুণ বড়। মোস্তফা কামাল পাশার পিপলস পার্টি দীর্ঘ সময় ধরে তুরষ্ক শাসন করে। তার ইন্তেকাল পরবর্তী ক্ষমতায় আসেন ইছমত পাশা ইনুনু। পিপলস পার্টি দীর্ঘ প্রায় ৪০/৪৫ বছর যাবৎ তুরস্ককে ধর্মীয় অনুশাসন থেকে দূরে রেখেছিল। তুর্কিরা মুসলমান বিধায় তাদের মাঝে আরবী শিক্ষা, ধর্মীয় আচার-আচরণ দানা বাঁধতে শুরু করে। সে আরেক ইতিহাস। তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। তুরস্কে তিনি একজন সাহসী ব্যক্তিত্ব। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে তার জন্ম। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইসলামী কল্যাণ পার্টি থেকে ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে একটি ভাষণের কারণে তিনি ৪ মাসের কারাদÐে দÐিত হন। পরবর্তীতে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি মধ্যপন্থী রক্ষণশীল এ.কে.পি পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের নির্বাচনে জয়লাভ করে এরদোগান প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৩-১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় তিনি তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে এসে প্রেসিডেন্ট হন। শাসনতন্ত্র সংশোধন এবং তাঁর অনুক‚লে ভোট দিয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হন। গত বছর তিনি সামরিক অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হন। কিন্তু তার আহŸানে জনগণ সাড়া দিলে এ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সিরিয়া ও ইরাকে গৃহযুদ্ধের কারণে তুরস্ক নানাভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। এ দু’দেশের সাথে তুরস্কের সীমান্ত রয়েছে। আইএসের উত্থান ও ইরাকে কুর্দিস্তানের গণভোটে এরদোগানের পক্ষে নীরব থাকা কঠিন। অপরদিকে, মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যায় তিনি অবদান রাখতে চান। যেমন কাতার নিয়ে সউদী আরবের বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে তিনি তৎপর। সে লক্ষ্যে তিনি সউদী আরব গিয়ে বাদশাহ সালমানের সাথে বৈঠক করেন। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের কারণে ২৫ আগস্ট থেকে সেখানকার রোহিঙ্গারা নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশে আসতে থাকে। গতবারে তাদের ফিরিয়ে দিলেও এবার বাংলাদেশ তার সীমান্ত খুলে দেয়। এ পর্যন্ত ৬ লাখের অধিক রোহিঙ্গা মুসলমান উখিয়া, টেকনাফে অবস্থান করছে। এরদোগানের স্ত্রী রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে বাংলাদেশে আগমনের কথা আগে উল্লেখ করেছি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গা বিষয়ে তুরস্ক বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। ধনী দেশ না হয়েও পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কল্যাণ কাজে ব্যয়কারী দেশ হিসেবে তুরস্ক প্রথম।
বস্তুতঃ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান নিজ দেশের পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের স্বার্থে ভূমিকা রাখতে চান, রাখতে চান অবদান। আমরা তুরস্কের জাতীয় দিবস উপলক্ষে সে দেশের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করছি। আরও কামনা করছি তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন