মুমিনের হৃদয়ে ইমানের অস্তিত্ব নবুওয়তের সূর্যেরই প্রতিবিম্ব ও আলোকরশ্মি। আলোকরশ্মি সূর্য থেকেই বেরিয়ে আসে, আয়না থেকে নয়। মুমিনের কাছে ইমানের বাণী নবীর মাধ্যমেই পৌঁছে থাকে। প্রথম মানব এবং প্রথম নবী হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে মহানবী (সা.) পর্যন্ত যুগে যুগে নবী-রাসুল এসেছেন এবং তারা সকলেই ইমানের দাওয়াত দিয়েছেন। মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘আমি সকল স¤প্রদায়ের কাছে নবী প্রেরণ করেছি’ (সুরা নাহল: ৩৬)। তারা সবাই এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাসী ছিলেন এবং উম্মাহর মাঝে এ বিশ্বাস স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। হজরত আদম (আ.), হজরত ইবরাহিম (আ.), হজরত মুসা (আ.), হজরত ঈসা (আ.) এবং প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)- এর যুগের মধ্যবর্তী সময়ে যদিও শতসহস্র বছরের ব্যবধান রয়েছে, কিন্তু সবার মিশন আর লক্ষ্য ছিলো আল্লাহর একাত্মবাদ শিক্ষা দেয়া। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা আদিষ্ট ছিলো একমাত্র মাবুদের ইবাদতের জন্য। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তারা যা শরীক সাব্যস্ত করে তা থেকে তিনি পবিত্র’ (সুরা তাওবা: ৩১)।
মুমিন ইমানের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে গুণান্বিত। কারণ আল্লাহ তায়ালা নিজে নিয়ন্ত্রণ করেন নবী-রাসুলের সকল ক্রিয়াকর্ম। তাই তাদের পথভ্রষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে না। বরং পৃথিবীর মানুষকে একটি আদর্শ, একটি জীবন দর্শন শিক্ষা দেয়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন তাদের বিশাল কাফেলা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের আমি নির্বাচিত করেছি, সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছি’ (সুরা আনআম: ৮৮)। নবী-রাসুলদের চারিত্রিক শ্রেষ্ঠত্বের পাশাপাশি সততা, সৎকর্মপরায়ণতা ও কল্যাণ প্রতিযোগিতায়ও ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। যিনি কল্যাণের বার্তা বয়ে আনেন, তিনিই হলেন সে কল্যাণের মূর্ত প্রতীক। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘তাদের সবাইকে বানিয়েছি সৎকর্মপরায়ণ’ (সুরা আম্বিয়া: ৭২)। নবুওয়ত ও রিসালাত ছাড়া মানবতার প্রকৃত বিকাশ ঘটবে না। মানুষ প্রকৃত পথের সন্ধান পাবে না। তাইতো তারা চেয়েছেন কেবল উম্মতের কল্যাণ। উম্মতের চিন্তায় তাদের অন্তর ব্যথিত হতো। আর এসব গুণের সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা ছিলেন আমাদের প্রিয়নবী (সা.)। পবিত্র কুরআনে যেসব আদেশ প্রদান করা হয়েছে, তাতে রাসুল (সা.)কে সরাসরি সম্বোধন করা হয়েছে এবং উম্মতকে পরোক্ষভাবে উক্ত হুকুমের আওতায় আনা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের ভাষ্য, ‘আপনি সঠিক পথে দৃঢ় থাকুন যেমন আপনাকে আদেশ করা হয়েছে এবং যারা তাওবা করে আপনার সাথী হয়েছে, তারাও যেনো সঠিক পথে চলতে পারে’ (সুরা হুদ: ১১৩)। তাই মুমিনের জন্য জরুরি হলো, নবীর সীরাত সম্পর্কে জানা। যেন নবীর পথে চলা যায় এবং অন্যকে নবীর বাতলানো পথে আহ্বান করা যায়।
মহান রাব্বুল আলামিন সুরা হুদ- এ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পূর্ববর্তী নবীগণ এবং তাদের জাতিসমূহের দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা ও অবস্থানের বর্ণনা দিয়েছেন। সঙ্গে রয়েছে রাসুল (সা.) ও উম্মাহর হেদায়াতের বর্ণানা। অবশেষে নবী রাসুলদের ঘটনা বর্ণনার করার কারণ ও হেকমত উল্লেখ করেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর আমি রসুলগণের সব বৃত্তান্তই তোমাকে বলছি, যদ্দ¦ারা তোমার অন্তরকে মজবুত করছি। আর এভাবে তোমার নিকট মহাসত্য এবং ইমানদারদের জন্য নসিহত ও স্মরণীয় বিষয়বস্তু এসেছে’ (সুরা হুদ: ১২০)। অর্থাৎ যেন এসব ঘটনা শোনার মাধ্যমে তোমাদের অন্তরে ইমানি শক্তি, স্বস্তি ও স্থিরতা সৃষ্টি হয়। তোমাদের অন্তর ইমানের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং সত্য বিষয়টি তোমাদের কাছে পরিষ্কারভাবে উদ্ভাসিত হয়। শুধু তাই নয়, অনেক সুরার নাম নবী রাসুলের নামে নামকরণ করা হয়েছে এবং তাতে তাদের সীরাত বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন: সুরা ইউসুফ, সুরা হুদ, সুরা ইউনুস, সুরা ইবরাহিম ইত্যাদি। এতে বোঝা যায়, নবী-রাসুলের সীরাত-জীবনী চর্চা করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কতটা জরুরি। রাসুল (সা.)-এর জীবনচরিত চর্চার দ্বারা প্রিয় নবীজির মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও পূর্ণাঙ্গতা সম্পর্কে অবগত হওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর সাহাবায়ে কেরামের পরিচয়ও জানা যাবে। আর এর মাধ্যমে ইমানি শক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং অসংখ্য আয়াত ও হাদিসের মর্ম বুঝে আসবে।
এই গুরত্বের কথা অনুভব করে মুসলিম উম্মাহ প্রাথমিক যুগ থেকেই মহানবী (সা.)-এর সীরাত সংরক্ষণ ও প্রচারে অক্লান্ত সাধনা করে আসছেন। তাদের ঐ সাধনার কথা বিশ্বে অমুসলিম মনীষীরাও অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। মারগোলিয়াথ-এর মত ইসলাম বিদ্বেষী প্রাচ্যবিদ বলতে বাধ্য হয়েছে, ‘মুহাম্মদের জীবনীকারদের দীর্ঘ ফিরিস্তি রয়েছে। এটা গুণে শেষ করা অসম্ভব। তবে ফিরিস্তিতে নিজের স্থান করে নেয়া গৌরবের ব্যাপার’ (খুৎবাতে মাদ্রাজ: সাইয়্যেদ সুলাইমান নদভী)। অসংখ্য মুসলমান সন্তান এটাকে নিজেদের জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এই মহান ব্রত পালন করতে গিয়ে তারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন।
দুনিয়ার বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী নিজেদের নবী, ধর্ম প্রবর্তকদের জীবনচরিত ও ইতিহাস লিখেছে। তবে তাদের কাছে তাদের আসমানী গ্রন্থ বা সহীফা সংরক্ষিত নেই। বরং তাদের এতটুকু জানা নেই যে, ঐ আসমানি গ্রন্থ কার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং কী কী বিষয় নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। তারা যাকে নিজেদের ইমাম, পথপ্রদর্শক ও অনুসরণযোগ্য মনে করেন, তাদের জীবনের সামান্য তথ্যাদিও তাদের হাতে নেই। পূর্ণাঙ্গ জীবনচরিত তো দূরর কথা। তারা তাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিদের জীবনের একটি বাক্যও বিশুদ্ধভাবে পেশ করতে পারবে না, যা নির্ভরযোগ্য এবং সুস্পষ্ট প্রমাণ ভিত্তিক বা যার ধারাবাহিতা আছে। কিন্তু মহান রাব্বুল আলামিনের লক্ষ-কোটি শুকরিয়া যে, এই গৌরব, এই মর্যাদা মহানবী (সা.)-এর উম্মতদের রয়েছে। তারা তাদের প্রিয়নবী (সা.)-এর প্রতিটি কথা, কর্ম ও মুহূর্তের বর্ণনা নির্ভরযোগ্য ধারাবাহিক সনদে উপস্থাপন করতে পারে।
রাসুল (সা.) বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরিত হয়েছেন। তিনি বিশ্বের সকল মানুষের জন্য আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ এবং তার আদর্শকে উম্মতের জন্য অনুসরণযোগ্য ঘোষণা করার পর থেকেই তার জীবনচরিত সংরক্ষিত হতে থাকে। এ কাজে তারা এতটা নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন যে, পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মপ্রবর্তক ও প্রচারকদের জীবন বৃত্তান্ত ও বাণী সংগ্রহ সংকলনের কাজে এমন সতর্কতা ও বর্ণনাকারীদের এমন ধারাবাহিকতা রক্ষা করার এত বিপুল আয়োজন দৃষ্টান্ত দ্বিতীয়টি নেই। মহানবী (সা.)-এর নবুওয়তের পর থেকে কোনো একটি মুহূর্ত এমন অতিবাহিত হয়নি, যার সঙ্গে এ উম্মতের সম্পর্ক নেই বা সে বিষয়ে তারা পরিচিত নয় কিংবা ধারাবাহিকতা শক্তিশালী নয়।
সীরাত আরবি শব্দ। এর অর্থ নিয়মাবলী, জীবনযাপন পদ্ধতি, আচার ব্যবহার, জীবনচরিত ইত্যাদি। সাধারণ অর্থে প্রিয়নবী (সা.)-এর আচার-আচরণ, জীবনযাপন প্রণালী তথা জীবনচরিতকে বোঝায়। মহানবী (সা.)-এর মূল সীরাত হলো, তার বিশাল হাদিস ভান্ডার। তবে প্রাথমিক যুগের মনীষীদের মতে রাসুল (সা.)-এর সরাসরি অংশগ্রহণ করা যুদ্ধসমূহ এবং মহানবীর প্রেরিত যুদ্ধাভিযানসমূহের সমষ্টিকে সীরাত বলে। বরং তাদের মতে সীরাত হলো, সীরাত, আদব, তাফসীর, আকাইদ ইত্যাদি আটটি বিদ্যার সমষ্টির নাম। সে হিসেবে সীরাত ইলমে হাদিসের একটি অংশ। তবে এখনকার সময়ের পন্ডিত মনীষীরা সীরাত বলতে মহানবী (সা.)-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনচরিতকে আখ্যায়িত করেছেন। (সীরাতে মুস্তফা (সা.) : আল্লামা ইদরিস কান্ধলবী (রহ.)।
প্রিয়নবী (সা.)-এর সীরাত সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সর্বপ্রথম অনুভব করেন সাহাবায়ে কেরাম ও শীর্ষস্থানীয় তাবেয়ীরা। তারা সাহাবাদের জীবদ্দশাতেই দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দিয়ে যুবক, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষের প্রত্যেকের কাছ থেকে অনুসন্ধান চালিয়ে রাসুল (সা.)-এর প্রতিটি বাণী, কাজকর্ম এবং তাদের সম্পর্ক সবগুলো ঘটনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। হিজরীর দ্বিতীয় শতাব্দীর একেবারেই সূচনাতে হাদিস গ্রন্থ রচনার কাজ শুরু হলে তখন থেকে আরম্ভ হয় সীরাত চর্চা। এ ক্ষেত্রে উমর বিন আবদুল আজিজ (রা.) হলেন সীরাত চর্চার রূপকার। সীরাত চর্চার সেই যে সূচনা হয়েছিলো তা অদ্যাবধি চলছে এবং চলবে। সীরাত চর্চার বহুমুখী বিশ্বস্ত আলো ছড়িয়ে পড়েছিলো ইমাম বোখারি (রহ.), ইমাম মুসলিম (রহ.), ইমাম তিরমিজি (রহ.), ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) প্রমুখ সংকলিত হাদিস গ্রন্থসমূহে।
রাসুল (সা.)-এর সীরাত চর্চা তার নবুওয়তের পর থেকেই অব্যাহত গতিতে চলে আসছে এবং চলতে থাকবে। তার সম্পর্কে কোনো প্রকার ভুল ব্যাখ্যা, অপব্যাখ্যা, সত্যের অপলাপ করতে পারবে না। মুসলিম সীরাত চর্চাকারীরা এ সুযোগ তাদের দিবেন না, বরং মহানবী (সা.)-এর সীরাত সম্পর্কে লাখো গ্রন্থ মুসলিম লেখকরা রচনা করেছেন এবং করছেন। প্রিয়নবী (সা.)-এর সীরাত বিষয়ক প্রতিটি গ্রন্থ অন্যান্য নবীর জীবনচরিত সংক্রান্ত গ্রন্থগুলোর তুলনায় অধিক স্বচ্ছ, নির্ভরযোগ্য ও ঐতিহাসিক। তার জীবনচরিতকে অগণিত মানুষ শুনছে ও পাঠ করছে। এর ধারাবাহিকতাও অব্যাহত গতিতে চলে আসছে এবং চলতেই থাকবে।
প্রিয় নবীজি (সা.)-এর সীরাত চর্চার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সর্বকালে সর্বযুগে এই জন্য রয়েছে যে, তিনি ছিলেন ইসলামের সর্বশেষ নবী। মানবজাতির কল্যাণের প্রতীক হয়ে আগমন করেন এই ধরণীতে। বিশ্ববাসীকে আহ্বান করেন কল্যাণের পথে, বিরত রাখেন সমূহ অকল্যাণ থেকে। মহানবী (সা.)-এর বিমূর্ত সত্তাকে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। তার অনুসারীদের সরাসরি আল্লাহর অনুসরণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে এসেছে, যে ব্যক্তি রাসুলের আনুগত্য করলো, সে যেন আল্লাহর আনুগত্য করলো। (সুরা নীসা: ১২)।
পবিত্র কুরআনের বাস্তব ও সার্থক রূপায়ণ ছিলো মহানবীর গোটা সীরাত বা জীবনচরিত। তার ইন্তিকালের পর উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়শা (রা.)কে জিজ্ঞেস করা হলো, রাসুল (সা.)-এর চরিত্র কেমন ছিলো? তিনি একবাক্যে উত্তর দিয়েছিলেন, প্রিয়নবীজির চরিত্র ছিলো আল-কুরআন। অর্থাৎ আল-কুরআনে যেভাবে আচরণ করতে ও স্বভাব গঠন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সে আচরণ ও স্বভাবের মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি। তাইতো মহান রাব্বুল আলামিন প্রিয়নবী (সা.)-এর সীরাতের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘আল্লাহর রাসুলের জীবনই হলো তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শের নমুনা’ (সুরা আহজাব: ২১)।
পবিত্র কুরআনে যত সুন্দর, সত্য, সততা, মানবতা ও কল্যাণময় গুণাবলীর কথা বলা হয়েছে, তার নিখুঁত ও পরিপূর্ণ চিত্রায়ন ঘটেছিলো রাসুল (সা.)-এর জীবনাদর্শে। মানব সমাজের উন্নতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক ও চারিত্রিক সকল ক্ষেত্রে গৌরবময় উত্তরণের পথই হলো অনুসরণীয় আদর্শ। আদর্শহীন কোনো জনগোষ্ঠী পৃথিবীতে সমাদৃত হতে পারে না। তাই আজকের এই করুণ ও অবক্ষয় মুহূর্তেও যদি মুসলিম উম্মাহ ফিরে পেতে চায় তাদের হারানো অতীত, তাহলে তাদের অনুসরণ করতে হবে প্রিয়নবী (সা.)-এর সীরাত বা পবিত্র জীবনচরিত। সুতরাং সেই পথেই হোক আমাদের নব যাত্রা। আদর্শিক প্রত্যয়ে প্রাণবন্ত হয়ে উঠুক আমাদের সমাজ জীবন।
লেখক: শিক্ষক, বাইতুন নূর মাদরাসা ঢাকা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন