মানুষ অদূরদর্শী হলে প্রকৃতি শাস্তি দেবেই। মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের আদর্শ নজির হতে পারে ডিএনডি (ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা) প্রকল্প এলাকার জলাবদ্ধতা। বিশাল এ সেচ প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল ১৯৬৮ সালে- খরার মৌসুমে জল সেচে চাষাবাদ আর বর্ষায় পানি নিষ্কাশনের সুবিধা রেখে। কিন্তু কাঠামোটি নিরাপদ রাখার দায়িত্বটি পালন করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো। বাঁধের ভেতরে বন্যার পানি ঢোকে না, এলাকাটি রাজধানী লাগোয়া- এসব কারণে বসতি গড়া ও কল-কারখানা স্থাপনের হিড়িক যখন পড়ল, কর্তৃপক্ষ তা প্রতিহত করেনি। অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন ও অবৈধ দখলের কারণে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাটিও যখন ধ্বংস হচ্ছিল, কর্তৃপক্ষ তখন ছিল উদাসীন। নিষ্কাশন ব্যবস্থাটির পুনরুজ্জীবন ডিএনডি এলাকার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারে।
২৩৮ কোটি ৩৮ লাখ ১৬ হাজার টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় ২০১০ সালে। এর মধ্যে আছে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকার শিমরাইল ও আদমজী এলাকায় দুটি পাম্প স্টেশন স্থাপন, পাগলা ও ফতুল্লা এলাকায় দুটি পাম্পিং পয়েন্ট স্থাপন, ১৪৫টি কালভার্ট ও ১৫০টি সেতু নির্মাণ ও মেরামত, ৯৪ কিলোমিটার খাল খনন ও পুনঃখনন এবং খালের পাড় নির্মাণ, অবৈধ দখল ঠেকাতে ৬০ কিলোমিটার খালের দুই পাড় গ্রিল দিয়ে ঘেরাও এবং ৯ দশমিক ২৫ কিলোমিটার খালের দেয়াল উঁচু করা। প্রকল্প গ্রহণ মানেই তো এর উপযোগিতা ছিল! বাস্তবায়ন না হওয়া মানেই তো ভোগান্তির পুনরাবৃত্তি! হচ্ছেও তাই। কিন্তু যাদের টনক নড়লে কাজটি গতি পাবে তাদের ভূমিকা আমরা দেখছি না।
হাতে গোনা যে কটি নিষ্কাশন পাম্প আজও চালু সেগুলো প্রায় অর্ধশতাব্দী কালের পুরনো- এ তথ্যটিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কাঁহাতক উদাসীনতা কর্তৃপক্ষের। সেই সঙ্গে আছে বাসিন্দাদের অসচেতনতা। তাদের নিক্ষেপিত পলিথিন-বর্জ্যের কারণে টানা পাম্প চালানোও সম্ভব হয় না। মানবসৃষ্ট এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে হলে এলাকার মানুষকে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। যত্রতত্র বর্জ্য ফেলা বন্ধের পাশাপাশি সরকারি জমি ছেড়ে দিতে হবে। দখলকৃত খাল ও পয়োনিষ্কাশন নর্দমাগুলো উদ্ধার করার জন্য সরকারি উদ্যোগও অপরিহার্য। তাই গৃহীত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে অনতিবিলম্বে। উচ্ছেদ করতে হবে খাল ও নর্দমা দখলকারীদেরও। শুধু বছর নয়, ভোগান্তিতে দশকের পর দশক গড়াবে; সমাধানে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে না- এমনটি মানা যায় না।
আশার কথা হচ্ছে, রাজধানীর প্রান্তভাগের ডিএনডি এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে ৫৫৮ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ডিএনডি এলাকার প্রায় ২০ লাখ অধিবাসীর দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে জলাবদ্ধতা নিরসনের এ প্রকল্প অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ অবসানে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত আগ্রহে ডিএনডির জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ৫৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকার সাংবার্ষিক দুর্ভোগের অবসান ঘটবে। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত¡াবাবধানে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ঢাকা দক্ষিণ ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। এলাকার সংসদ সদস্যরাও সুষ্ঠুভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। ডিএনডি এলাকার বাসিন্দারা কয়েক দশক ধরে জলাবদ্ধতার যে অভিশাপ ভোগ করছে তার উত্তরণে সরকারের নেওয়া প্রকল্পটি দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পাল্টে যাবে ডিএনডি এলাকার চেহারা। জলাবদ্ধতা এলাকার জনস্বাস্থ্যের জন্য যে হুমকি সৃষ্টি করে চলেছে বছরের পর বছর ধরে তারও অবসান ঘটবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে অবৈধ স্থাপনা ভাঙার প্রয়োজন হলে সে ব্যাপারে জনপ্রতিনিধিরা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ২০ লাখ মানুষের কল্যাণের জন্য যা কিছু করা দরকার সে ব্যাপারে তারা সহযোগিতা দেবেন। সেনাবাহিনীর তত্ত¡াবধানে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এলাকাবাসীর বিশ্বাস, এটি মানসম্মতভাবে বাস্তবায়িত হবে। জলাবদ্ধতা নিরসনে তা রোল মডেল বলে বিবেচিত হবে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন