শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

এই জনদুর্ভোগ আর কত কাল চলবে?

| প্রকাশের সময় : ২২ আগস্ট, ২০২০, ১২:০০ এএম

বর্ষা এলেই রাজধানীতে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ধুম পড়ে। যুগের পর যুগ ধরে জনভোগান্তি ও দুর্ভোগ সৃষ্টির এ কাজটি চলে আসছে। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বহু লেখালেখি হলেও তাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি এবং সুরাহারও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং তা আরও জোরোসোরে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এর যেন কোনো সমাধান নেই। গত কয়েক মাস ধরে রাজধানীর এমন কোনো সড়ক নেই যেখানে এই খোঁড়াখুঁড়ি চলছে না। প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে চলাচল দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এই বর্ষায় পরিস্থিতি আরো শোচনীয় হয়ে পড়েছে। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত অর্থবছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের চার শতাধিক সড়ক খনন করা হয়েছে। চলতি বছর খননের জন্য কত জমা পড়েছে তা সিটি করপোরেশনেরও জানা নেই। তবে গত এক বছরে দুই সিটি করপোরেশনে ৪০৬টি খননের আবেদন জমা পড়েছে। এ মধ্যে ওয়াসার আবেদন ৬৯টি, ডিপিডিসির ৫৩টি এবং বিটিসিএল-এর ৩২টি। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এসব আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে। এতে যে জনদুর্ভোগ ও ভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে, তা সীমাহীন। এই খোঁড়াখুঁড়িতে অভিজাত এলাকাসহ পুরনো ঢাকার বহু সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এর চাপ গিয়ে পড়ছে অন্যান্য সড়কে। ফলে যানজটে রাজধানী অচল হয়ে পড়েছে।

বলা হয়ে থাকে, রাজধানীর সেবামূলক কাজের উন্নয়ন করতে গেলে নগরবাসীকে কিছুটা দুর্ভোগ সইতে হবে। তবে এ কথা বলা হয় না, সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই উন্নয়নের দুর্ভোগ কবে শেষ হবে এবং তার সুফল কবে পাওয়া যাবে। নগরবাসী দেখছে, পানিবদ্ধতা নিরসনে ওয়াসা খোঁড়াখুঁড়ি করছে, অথচ সামান্য বৃষ্টি হলে সড়ক কোমর সমান পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। তাহলে পানিবদ্ধতার নিরসন কোথায় হলো? আবার খোঁড়াখুঁড়ি শেষে যে জায়গাটি দ্রুত সংস্কার করা দরকার তা না করেই ফেলে রাখা হচ্ছে। এতে বৃষ্টি হলে সেই জায়গা মানুষের জন্য মরণ ফাঁদ হয়ে দাঁড়ায়। মাঝে-মধ্যেই গর্তে পরিণত হওয়া সড়কে যানবাহন পড়ে যাত্রীদের আহত হতে দেখা গেছে। মানুষের ক্ষতির এই দায় কি ওয়াসা নিচ্ছে? দেখা যায়, ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি শেষ হওয়ার সাথে সাথে ডিপিডিসি বা বিটিসিএল একই জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে। ফলে খোঁড়াখুঁড়িতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া সড়কটি বছরের পর বছর ধরে সংস্কারবিহীন অবস্থায়ই থেকে যায়। এমনিতেই রাজধানীতে সড়কের পরিমাণ অত্যন্ত কম। একটি আদর্শ রাজধানীতে আয়তনের ২৫ ভাগ সড়ক থাকলেও ঢাকায় রয়েছে ৫-৬ শতাংশ। এই পরিমাণ সড়কও আবার অবৈধ দখল এবং মেট্রোরেল নির্মাণ কাজের জন্য আরও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। প্রধান প্রধান সড়কের মাঝামাঝি প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সড়ক দখলে নিয়ে নির্মাণ কাজ চলছে। সড়কের দুই পাশ সরু গলিতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে যান চলাচল এক প্রকার অসম্ভব। চলাচল করলেও ঘন্টার পর ঘন্টা যানজটে পড়ে থাকতে হয়। এই সরু রাস্তার মধ্যেই আবার খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। তাহলে যানবাহন চলাচল করবে কী করে? বহুবার প্রশ্ন উঠেছে, বর্ষা এলেই কেন খোঁড়াখুঁড়ি করতে হবে? সঙ্গত জবাব পাওয়া যায়নি। তবে কারণটি কারো অজানা নয়। এসব খোঁড়াখুঁড়ির কাজ যারা পায়, তারা হয় সংশ্লিষ্ট এলাকার কাউন্সিলর না হয় সরকার সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী ঠিকাদার। এদের সাথে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও জড়িত। তাদের যোগসাজসেই চলে বর্ষায় খোঁড়াখুঁড়ি। কারণ এতে যেমন বৃষ্টির অজুহাতে সময় বেশি লাগে, তেমনি সময় বেশি লাগলে নতুন করে বরাদ্দের মাধ্যমে দুর্নীতির সুযোগও সৃষ্টি হয়। বছরের পর বছর ধরে সাইক্লিক অর্ডারে বা চক্রাকারে এই চক্র কাজ করায় বষার্য় খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ হয় না। অথচ সরকারের নির্দেশই আছে, বর্ষা শুরুর আগে মে মাসের মধ্যে যত ধরনের খোঁড়াখুঁড়ি আছে, তা শেষ করতে হবে। এই সময়মীমাকে উল্লেখিত চক্র বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাদের মতো করেই কাজ করে যাচ্ছে। আশার কথা হচ্ছে, রাজধানীর এই অপরিকল্পিত ও অসহনীয় খোঁড়াখুঁড়ি পর্যবেক্ষণ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস কঠোর অবস্থান নিয়ে বলেছেন, উন্নয়নের নামে এক রাস্তা আর তিনবার কাটতে দেয়া হবে না। ঢাকাকেন্দ্রিক সকল উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আগামী ১ অক্টোবরের মধ্যে প্রতিটি সংস্থাকে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। এ সময়ের পর কেউ তদবির করলেও তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নের অনুমতি দেয়া হবে না। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের এ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। কারণ নগরবিদরা বহু বছর রাজধানীর সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করার কথা বলে আসছেন। মেয়রের বক্তব্যে তার প্রতিফলন ঘটেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, রাজধানীর উন্নয়ন কর্মকান্ডে অপরিকল্পিত ও অসময়ে খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়ার বিকল্প নেই। এমনটি দেখা গিয়েছিল গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। সে সময় বর্ষায় কোনো ধরনের খোঁড়াখুঁড়ি করা যাবে না, এমন কঠোর সিদ্ধান্তের কারণে খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নগরবাসী কিছুটা হলেও ভোগান্তি থেকে রক্ষা পেয়েছিল। আমরা মনে করি, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে বর্ষায় দুর্ভোগ সৃষ্টিকারী খোঁড়াখুঁড়ি যেমন বন্ধ হবে, তেমনি সরকারেরও বিপুল অংকের অর্থের সাশ্রয় হবে। এক্ষেত্রে উত্তরের মেয়র কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বা তার বক্তব্য কি, তা আমরা জানি না।

রাজধানীজুড়ে যে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, জনগণের দুর্ভোগ কমাতে তা আপাতত বন্ধ রাখা যায় কিনা তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা উচিৎ। বর্ষা চলে যাওয়ার পর পুনরায় কাজ শুরু করা যেতে পারে। তবে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে বর্ষা মৌসুমে এসব খোঁড়াখুঁড়ির কাজ অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে যেসব প্রকল্প কর্মকর্তা জড়িত তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার। এসব প্রকল্পের সাথে দলীয় যেসব প্রভাবশালী ঠিকাদার জড়িত তাদেরও কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে হবে। কেন তারা সময় মতো কাজ শুরু না করে বর্ষায় কাজ শুরু করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দলীয় প্রভাবশালী ঠিকাদারদের দিয়ে কাজ করালে সে কাজ যেমন যথাসময়ে যথাযথভাবে সম্পন্ন হয় না, তেমনি কাজের মানও ঠিক থাকে না। রাজধানীর সেবামূলক উন্নয়ন কাজ মানসম্পন্নভাবে যথাসময়ে শেষ করতে হলে সমন্বয়ের মাধ্যমে দলীয় প্রভাবমুক্ত প্রকৃত ঠিকাদারদের দিয়ে করানো জরুরি। উন্নয়ন কাজকে ত্বরান্বিত এবং এর সুফল নগরবাসীকে পৌঁছে দেয়ার জন্য এর বিকল্প নেই।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন