ঢাকা নগরীর যান চলাচলের গতি ও বাসযোগ্যতা তলানিতে নেমে যাওয়ার অন্যতম কারণ নগরী জুড়ে যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। নগরীতে বেশকিছু ফ্লাইওভার নির্মাণের পাশাপাশি রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি নিয়ে গত দেড় দশকে বিস্তর আলোচনা ও লেখালেখি হলেও অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। অনেক দেরিতে হলেও দুই বছর আগে স্থানীয় সরকার বিভাগের তরফ থেকে ‘রাস্তা খনন নীতিমালা’ প্রণয়ন করা হয়। সেখানে বর্ষা মওসুম অর্থাৎ মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। চলতি বর্ষা মওসুমে বিভিন্ন সংস্থার খোঁড়াখুঁড়িতে ঢাকা শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্ধশতাধিক রাস্তায় তীব্র যানজট ও জনদুর্ভোগ চলছে। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও নীতিমালা তেমন কোনো কাজে আসছে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতর থেকে নীতিমালা জারি করেই যেন দায়িত্ব শেষ করা হয়, জনদুর্ভোগ লাঘবে নীতিমালা বা নির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেই। ভরা বর্ষার সময়ও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ডেসকো, পিজিবিসি, তিতাস গ্যাস, ওয়াসা, বিটিসিএল’র লাইন ও নেটওয়ার্ক সংস্কারের নামে রাস্তার বিভিন্ন পয়েন্ট বিপজ্জনক অবস্থায় পড়ে আছে। সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়া রাস্তাগুলোতে নিমজ্জিত খানাখন্দকে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা।
রাজধানীর বাইরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর, বাণিজ্যিক রাজধানী ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামে খোলা উন্মুক্ত স্যুয়ারেজ লাইনের নালাগুলো এখন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। গত সোমবার আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সেহরিন মাহবুব সাদিয়া আগ্রাবাদ বাদামতলি এলাকায় ড্রেনে পড়ে গিয়ে নিখোঁজ হওয়ার ৬ ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিস তার মৃতদেহ উদ্ধার করে। গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ মিডিয়ায় এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি ও আলোচনা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে ড্রেনে পড়ে মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। গতকাল বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, গত তিনমাসে চট্টগ্রামের উন্মুক্ত ড্রেনে পড়ে অন্তত ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। বন্দর নগরীতে প্রায় সাড়ে ৯০০ কিলোমিটার উন্মুক্ত স্যুয়ারেজ লাইন রয়েছে। ব্যস্ততম সড়কের পাশে এসব উন্মুক্ত নর্দমায় প্রতিদিন অসংখ্য দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (সিসিসি) উন্নয়ন কাজে সমন্বয়হীনতা, গাফিলতি ও দায়িত্বহীন উন্নয়ন কর্মকান্ডের কারণে শহরের উন্মুক্ত স্যুয়ারেজ লাইনগুলো জনদুর্ভোগ ও মৃত্যুর বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্মুক্ত স্যুয়ারেজ লাইনগুলোতে নিরাপত্তামূলক প্রতিবন্ধকতা এবং প্রয়োজনীয় স্ট্রিট লাইট না থাকার দায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারেন না।
গত জুন মাসে রাজধানীর খিলগাঁও-তিলপাপাড়া এলাকায় এক কিশোর রাস্তার বোতল কুড়াতে গিয়ে উন্মুক্ত ড্রেনের মধ্যে তলিয়ে নিখোঁজ হয়। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে এমন অসংখ্য উন্মুক্ত স্যুয়ারেজ লাইন ও নালা রয়েছে, যথাযথ তদারকি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় ঢাকনাবিহীন স্যুয়ারেজ ও নিরাপত্তাহীন নালায় প্রতিদিন দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে মানুষ। যেখানে স্বাভাবিকভাবেই রাস্তায় স্ট্রিটলাইন থাকার কথা, সেখানে উন্মুক্ত স্যুয়ারেজ নালায় নিরাপত্তা বেষ্টনি এবং বাতির ব্যবস্থা না করে স্থানগুলোকে কতটা বিপজ্জনক করে তোলা হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। আর কত সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হলে নগর কর্তৃপক্ষ এসব বিপজ্জনক রাস্তা, স্যুয়ারেজ লাইন ও খানাখন্দকের বিহিত ব্যবস্থা করবে? কোনো সভ্য সমাজে এমন অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলতে পারে না। নগরীর রাস্তা সারা বছর ধরে যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ির জন্য বিভিন্ন সংস্থার কাজে সমন্বয়হীনতার কথা বলা হচ্ছে বহুদিন ধরে। অবস্থার উন্নয়নে ও সমন্বয় সাধনের জন্য নগর পরিকল্পনাবিদরা বিভিন্ন সময়ে নানা রকম পরামর্শও দিয়েছেন। সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের পক্ষ থেকেও বেশকিছু উদ্যোগের কথা শোনা গেছে। সে সব ব্যর্থতার কথা বাদ দিলেও, ব্যস্ত সড়কের পাশে উন্মুক্ত নালায় নিরাপত্তা বেষ্টনি দিতে না পারার ব্যর্থতার পেছনে নগর কর্তৃপক্ষের কোনো অজুহাত থাকতে পারে না। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায়ও বেশকিছু উন্মুক্ত স্যুয়ারেজ দেখা যাচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগ অংশেই নিরাপত্তাবেষ্টনি নেই। সেই সাথে তীব্রগন্ধযুক্ত নদর্মায় মশার লার্ভা উৎপন্ন হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে যাওয়া, যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ির জনদুর্ভোগ ও উন্মুক্ত নালায় জীবন সংহারের চলমান অবস্থা পরিবর্তনে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে আরো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নগর কর্তৃপক্ষের অবহেলায় সৃষ্ট জনদুর্ভোগ ও মৃত্যুর দায় ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন