মানুষের প্রতি আল্লাহর যেসব নিয়ামত ও দানের কথা চিরস্মরণীয় ভাষা তার অন্যতম। বৈচিত্রময় ভাষা আর অনুপম বাক প্রতিভার গুণে মানুষ অন্য সব প্রাণী থেকে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। নিপুণ শিল্পকুশলতায় আল্লাহ যেমন অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভ‚মি বসুন্ধরা সৃষ্টি করেছেন, তেমনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন নানা বৈচিত্র ও সৌন্দর্যের প্রতীক বানিয়ে। মহান আল্লাহ বলেন, “আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আসমান ও জমিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা। নিশ্চয় এর মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।”(স‚রা আর-রূম, আয়াত : ২২)
পৃথিবীতে ঠিক কতগুলো ভাষা রয়েছে তা অনুমান করা খুব কঠিন। তবে ধারণা করা হয় এর সংখ্যা প্রায় ৩০০০ থেকে ৮০০০ হবে। ঈথনোলোগ (ঊঃযহড়ষড়মঁব) নামের ভাষা বিশ্বকোষের ২০০৯ প্রকাশিত ১৬তম সংস্করণের হিসেব মতে জীবিত ভাষার সংখ্যা প্রায় ৬৯০৯। ইউকিপিডিয়ার তথ্যমতে, পৃথিবীতে এ পর্যন্ত ৭৩৩০টি ভাষার সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে এতগুলো ভাষার মধ্যে প্রত্যেক জাতির কাছেই নিজ মাতৃভাষা অতুলনীয়। মাতৃভাষার গুরুত্ব সব জাতির কাছেই আলাদা। মাতৃভাষার প্রতি আবেগই অন্যরকম। মাতৃভাষায় যেভাবে মানুষ মনের কথা তুলে ধরতে পারে অন্য ভাষায় তা পারে না। আমাদের হাসি-কান্না আর আনন্দ-বেদনা কিংবা বৈরিতা-মিত্রতা আর আশা-হতাশার সবই প্রকাশ করে মাতৃভাষা। শিশুর প্রতি মা জননীর তুলনাহীন স্নেহ, মায়ের প্রতি শিশুর অফুরন্ত ভালোবাসা প্রকাশ করে এই মাতৃভাষায়। পৃথিবীর প্রত্যেক জাত-বর্ণের লোকই তাই মায়ের মতোই ভালোবাসে তার মাতৃভাষাকে।
ভাষা কি?
মনের ভাব প্রকাশের ভঙ্গিই ভাষা। তা কন্ঠধ্বনির মাধ্যমে হোক বা অন্য কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ইশারার মাধ্যমে হোক। ভাষার সংজ্ঞা প্রদানে আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ বলেন, ভাষা হচ্ছে মানুষের ভাব বিনিময় ও প্রকাশের প্রতীকী প্রত্যয় বিশেষ। এটি ধ্বনি ও ইশারা ও ইঙ্গিত উভয়কে অন্তর্ভূক্ত করে। তবে পারিভাষিক অর্থে কারো কন্ঠনিঃসৃত অর্থবোধক ধ্বনিকেই ভাষা নামে অভিহিত করা হয়।( আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, আধুনিক ভাষাতত্ত¡, (ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৫ খ্রি. পৃ.১)
ভাষাবিজ্ঞানী A language is a system of arbitrary vocal symbols by which members of a social group Co-operate and interect(Edger H. Sturtevant, An introduction to languistic Science, (New Haven:Yale University Press, 1947), Chapter-1.).
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, কতিপয় উচ্চারিত প্রতীকী নিয়মের মাধ্যমে সমাজের লোকেরা একে অন্যের সাথে যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও আচরণ করে, তাই ভাষা।
মাতৃভাষা বলতে কী বুঝায়:
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ^কোষ থেকে, মাতৃভাষা পরিভাষাটির সংজ্ঞা পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। মানুষ যে ভাষায় কথা বলতে সবচেয়ে বেশি পারদর্শী, যে ভাষাটি সে তার পিতামাতা বা অভিভাবকের কাছ থেকে ছোটবেলায় শিখেছে ও ভাষাটি যে অঞ্চলে বহুল প্রচলিত, সে অঞ্চলের মানুষের মতই ভাষাটিতে কথা বলতে সক্ষম, তাকে সাধারণভাবে মাতৃভাষা বলা হয়।
আবার কারো কারো মতে, মাতৃভাষা হচ্ছে স্বজাতির ভাষা, কোনো ব্যক্তির নিজের ও তার স্বজাতির ভাষাকে মাতৃভাষা বলে।
আল কুরআনে মাতৃভাষা:
ইসলাম সব সময় সমাজের প্রচলিত ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বার বার সম্মান জানিয়ে এসেছে। রাসুল স. তার জীবনে আরবদের অনেক প্রচলনকে স্বীকৃতি দিয়েছেন যদি না তা তাওহীদের পরিপন্থি ও মানুষের জন্য অকল্যাণকর না হয়ে থাকে। মাতৃভাষা যে কোনো দেশের ও সমাজের প্রচলিত ভাষা হতে পারে। ইসলাম সকল কাজ ও যোগাযোগ মাতৃভাষায় করার জন্য গুরুত্বারোপ করেছে।
সকল ভাষাই মহান আল্লাহর সৃষ্টি। তাই কোন ভাষাকেই অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। প্রত্যেক ভাষাই সম্মান ও মর্যাদা প্রাপ্তির দাবী রাখে। ভাষা সৃষ্টি বৈচিত্র করার মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহর মহাত্ম প্রকাশিত হয়। মহান আল্লাহ তাঁর ভাষা সৃষ্টি সম্পর্কে বলেন-
আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আসমান ও জমিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা। নিশ্চয় এর মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে। (সূরা আর রূম, আয়াত-২২)
মানুষের বুঝা ও বুঝানোর জন্যই সৃষ্টির সূচনায় মহান আল্লাহ তাঁকে ভাষা শিখিয়েছেন। হযরত আদম আ. কে সৃষ্টির পরেই ভাষা শিখিয়েছেন। আল্লাহ বলেন- “তিনি আদমকে সকল বস্তুর নাম শেখালেন অতঃপর তা তিনি ফেরেশতাকুলের সামনে পেশ করে বললেন, তোমরা যদি তোমাদের দাবীতে যথার্থ হয়ে থাকো তবে এগুলোর নাম বলো। ফেরেশতারা বললেন, আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করে বলছি, আপনি আমাদের যা কিছু শিখিয়েছেন তার বাইরে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। নিশ্চয়ই আপনি মহাজ্ঞানী ও ও মহাবিজ্ঞানময়”। অনেক মুফাসসিরের মতে, আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম আদম আ. কে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে যত নবি ও রাসুল পাঠিয়েছেন তারা সকলেই নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলতেন। মানুষকে আল্লাহর তাওহিদ বা একাত্ববাদের দাওয়াত দিতে তারা নিজেদের মায়ের ভাষা বা মাতৃভাষা ব্যবহার করতেন। এ বিষয়টি আমাদেরকে আল্লাহ তাআলা তাঁর নবির মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন।
আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার জন্য। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন আর যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন। তিনি পরক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।(সূরা ইবরাহিম, আয়াত-৪)
আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র ইরশাদ করেন, তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনি তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাষা।( সূরা আর রহমান, আয়াত- ২-৪) ।
অতএব প্রতীয়মান হয় যে কুরআন মাতৃভাষার প্রতি অপরিসীম গুরুত্ব প্রদান করেছে এবং মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য ও শ্রদ্ধাবোধ শিক্ষা দিয়েছে।
আল হাদিসে মাতৃভাষা: নিজ নিজ মাতৃভাষার স্বকীয়তা রক্ষা করা অপরিহার্য বিষয়। পারতপক্ষে সব জায়গায় নিজের ভাষায় কথা বলা। নিজের ভাষায় লেখা আবশ্যক। মহানবী স. হুদায়বিয়ার সন্ধির পর রোম ও পারস্য স¤্রাটসহ বিভিন্ন রাজা-বাদশাহর কাছে আরবি ভাষায় চিঠি লিখে ইসলামের প্রতি আহŸান জানিয়েছিলেন। রাসুল সা. বলেছেন, “আল্লাহ প্রত্যেক নবিকে তার উম্মতের নিকট তার ভাষায় প্রেরণ করেছেন।”
মাতৃভাষার গুরুত্ব প্রদানের জন্যে মহান আল্লাহ তাআলা প্রসিদ্ধ আসমানি কিতাব প্রসিদ্ধ সেইসব রাসুলদের নিজেদের স¤প্রদায়ের ভাষায় নাযিল করেছেন। তাইতো তাওরাত হিব্রæ ভাষায়, ইঞ্জিল সুরইয়ানি ভাষায়, যবুর ইউনানি ভাষায় এবং আল-কুরআন আরবিতে নাযিল করেছেন।
শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। মহানবি সা. নিজ মাতৃভাষায় বিশুদ্ধতা অর্জনের ফলে গর্ববোধ করে বলেছিলেন,
“আমি আরবদের মধ্যে সর্বাধিক বিশুদ্ধ ভাষাভাষী। উপরন্তু আমি কুরাইশ বংশের লোক(ইবনে হিশাম) ।”
মহানবি সা. ছিলেন আরবি ভাষাভাষী, মাতৃভাষাকে তিনি এত বেশি ভালোবাসতেন যে তিনি নিজেই বলেছেন, তোমরা তিনটি কারণে আরবিকে ভালবাসো। কেননা আমি আরবি (আমার মাতৃভাষা আরবি), কুরআন আরবি, জান্নাতিদের ভাষাও আরবি।(ইমাম বায়হাকি, শুয়াবুল ইমান, হাদীস নং-১৬১০) ।
আমি তিনটি কারণে আরবি ভাষাকে ভালোবাসি। তন্মধ্যে একটি হলো আরবি আমার মাতৃভাষা।”
আরবিতে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আরবি ভাষা মহিমান্বিত হলেও কোনো ভাষাই ইসলামে অবহেলিত নয়। সব মাতৃভাষা আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান। তাই কুরআনের ভাষা আরবি হওয়া সত্তে¡ও পবিত্র কুরআন অন্যান্য ভাষার শব্দকে আরবি হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। যেমন- তোয়াহা, আল-ইয়াম, আত-ত‚র ইত্যাদি সুরইয়ানি ভাষার শব্দ। এর মাধ্যমে কুরআন সব ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে। আর এভাবেই একটি মাতৃভাষা সমৃদ্ধ হয় (জালালউদ্দীন সুয়ুতী, আল-মুযহির) ।
মাতৃভাষায় বিশ^নবির ইসলাম প্রচার:
রাসুলুল্লাহ স. সারা জীবনে নিজ মাতৃভাষায় একটি অশুদ্ধ বাক্যও উচ্চারণ করেন নি; বরং অন্যদের মাতৃভাষা বিশুদ্ধভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এবং মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে জ্ঞানের পথ উন্মুক্ত করেছেন। আবার কখনও কখনও তিনি যুদ্ধবন্দীদের ভবিষ্যত প্রজন্ম সন্তান-সন্তুতিদের জন্য নিছক ভাষার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে, ভাষা শিক্ষা প্রদানের বিনিময়ে তাদেরকে মুক্তও করে দিয়েছেন(তাবাকাতে ইবন সা‘দ)।
আমাদের প্রিয়নবি রাসুল সা. এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। মাতৃভাষাতেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন স্বজাতীর লোকদের। মাতৃভাষাতেই কুরআন নাযিল করে আরবদের জন্য সহজসাধ্য করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
আর আমি এ কুরআনকে তোমার মাতৃভাষায় সহজ করে দিয়েছি। যাতে মুত্তাকিদেরকে এর (বেহেশেতের) সুসংবাদ দিতে পার আর এর সাহায্যে কলহে লিপ্ত জাতিকে (দোজখের) ভয় দেখাতে পারো।( সূরা মারইয়াম, আয়াত-৯৭)
কুরআন আরবি ভাষায় নাজিল হওয়ার কারণ উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আমি কুরআনকে আরবি ভাষায় নাজিল করেছি এ জন্য যে যাতে তোমরা তা বুঝতে পারো।( সূরা ইউসুফ, আয়াত- ২)
একজন রাসুল হিসেবে মুহাম্মাদ সা. এর সর্বপ্রথম কর্তব্য ছিল তার নিজ পরিবার ও নিজ জাতির কাছে দীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া। তাঁর জাতি আরবদের মাতৃভাষা আরবি ছিল বলে তাদের কাছে দাওয়াত আরবিতেই হওয়া যুক্তিসঙ্গত । আরবি ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় তিনি দাওয়াত দিলে কিংবা কোনো অনারব ভাষায় কুরআন নাজিল হলে তারা কিছুই বুঝত না। তাদের হেদায়াত করাও সম্ভব ছিল না।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন , আমি যদি আরবি ভিন্ন অন্য কোনো ভাষায় কুরআন পাঠাতাম তাহলে তারা বলতঃ এর বাক্যগুলো ভালো করে বুঝিয়ে বলা হলো না কেন? সেকি, কিতাব আরবিতে নয় অথচ পয়গম্বর আরব।( সূরা হামীম সাজদাহ, আয়াত-৪৪)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রত্যেক নবি ও রাসুলকে তাদের স্বজাতীর ভাষায় প্রেরণ করেছেন এবং তাদের মাতৃভাষায় কিতাব বা সহিফা প্রদান করেছেন। মাতৃভাষার গুরুত্ব স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা নিজেই দিয়েছেন। (চলবে)
মুসলিম মনীষীদের মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ:
মাতৃভাষা মানুষের জীবনে কত যে গুরুত্বপ‚র্ণ তার প্রতি লক্ষ রেখে মনীষীরা ম‚ল্যবান উক্তি করেছেন। যেমন- হজরত ইবরাহীমের আ. সহিফায় লেখা ছিল, “জ্ঞানীর জন্য উচিত তার ভাষা ও সাহিত্যের সংরক্ষণ করা, যুগসচেতন হওয়া ও স্বীয় কর্তব্যে সদা মগ্ন থাকা।” হজরত আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি র. তাঁর এক ছাত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, “যদি হিন্দুস্থানে দ্বীনি খেদমত করতে চাও, তবে উর্দু ভাষায় যোগ্যতা অর্জন করো।” প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন বলেন, “প্রত্যেকেরই শিক্ষার মাধ্যম তার মাতৃভাষা হওয়া উচিত। অপর ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষাদান অসম্পূর্ণ শিক্ষারই নামান্তর।” সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী র. বলেন, “কোনো দেশে দ্বীনি খেদমত করতে আগ্রহী ব্যক্তিকে সে দেশের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি বোধ পূর্ণ মাত্রায় অর্জন করতে হবে।” হুসাইন আহমদ মাদানী র. বলেন, “যতক্ষণ না তোমরা আপন ভাষা সাহিত্যের অঙ্গনে বলিষ্ঠ ভ‚মিকা রাখবে, ততক্ষণ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না।”
ইমাম আযম আবু হানিফা র. এর মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ :
ইমাম আবু হানিফা রহ. মাতৃভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তার দেশবাসীর জন্য মাতৃভাষা ফারসি ভাষায় আল কুরআন অনুবাদ করার ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং তা নামাজে তিলাওয়াতের অভিমত প্রদান করেন। অবশ্য এই অভিমত তিনি বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের স্বার্থে প্রত্যাহার করে নেন। এ ঘটনায়ও ইসলামে মার্তৃভাষা মূল্যায়নের প্রমাণ মেলে। এ ছাড়া মনের আকাঙ্খা কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে নিবেদন করতে হলেও মাতৃভাষায় সর্বোত্তম সম্ভব হয়।
বাংলাদেশে মাতৃভাষায় ইসলাম প্রচার :
ঐতিহাসিকদের মতে, বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর খিলাফতকালের মাঝামাঝিতে অর্থ্যাৎ ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খোরাসান, তুরস্ক, মিসর প্রভৃতি দেশ হতে ইসলাম প্রচারকগণ বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করার জন্য এসেছেন। তারা এ দেশে এসে এ দেশের মানুষের ভাষা আয়ত্ত করেছেন এবং এ দেশের মানুষের ভাষাতেই ইসলাম প্রচার করেছেন। এ দেশের মানুষ অতি সহজেই তাদের কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে, ফলে দলে দলে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।
মুসলিম মননে মাতৃভাষাপ্রীতি সঞ্চারিত হয়েছে ইসলামের মাতৃভাষার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপের কারণে। সুতরাং নিজ মাতৃভাষা বাংলা ভাষার স্বকীয়তা রক্ষা করা অপরিহার্য বিষয়। পবিত্র কুরআন মজিদ ও হাদিসে নববি তথা ইসলামের আলোকে ধর্মপ্রাণ মানুষের সৎ মনোভাব প্রকাশের দ্বারা মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য, ইসলাম প্রচারে মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা এবং সর্বোপরি বিশ্বমানবতার কল্যাণে মাতৃভাষার চর্চা, অনুশীলন, সংরক্ষণ ও উৎকর্ষ সাধনে ভাষা শহীদদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শনে সবাইকে দায়িত্বশীল ভ‚মিকা পালন করতে হবে।
১৯৫২ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত এই দিনকে উদযাপন করলেও কয়েক বছর ধরে এ দিবসটি আর্ন্তজাতিকভাবে প্রতিটি দেশে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এটা আমাদের জন্য গৌরবের বিষয়। এ স্বীকৃতি বাংলাদেশের মানুষের জন্য বড় অর্জন। কাজেই এ দিন আমরা বিভিন্ন জ্ঞান এবং বিজ্ঞানের তত্ত¡কে এই ভাষায় আলোচনা করা এবং বাংলাভাষায় ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টি করার মাধ্যমে এই ভাষাকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করব। এই ভাষা এই দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে যেন সুস্থ থাকে। অপসংস্কৃতির কু-প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে, শিরকের প্রভাব থেকে যেন মুক্ত থাকে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, ইসলাম মাতৃভাষাকে যথার্থ মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদানের শিক্ষা দেয়। আর এই শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদেরকে মাতৃভাষাকে সম্মান করতে হবে, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য আমাদের সংগ্রাম করতে হবে এবং প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আরবি ভাষা আমরা চর্চা করব। কারণ এটি কুরআন ও হাদিসের ভাষা। আর আল্লাহ পাক একুশের যে গৌরব বাঙালি মুসলমানদেরকে দান করেছেন, তা যেন ইসলামের কল্যাণে, এই দেশের মুসলমানদের কল্যাণে আমরা ব্যবহার করতে পারি ও এ ভাষার মাধ্যমেই যেন আমরা বিশ্বের দরবারে মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারি, মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে সে তাওফিক দান করুন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন