ক্ষণস্থায়ী এ পৃথিবীতে মানুষের আগমনস কিছু কালের জন্য। মৃত্যুই তার অবশ্যম্ভবী পরিণতি। প্রায়ই মানুষ কারো না কারো মুত্যুর ঘটনা প্রত্যক্ষ করছে। তা সত্তে¡ও সে তার উপর ন্যস্ত বাধ্যতামূলক ও ঐচ্ছিক দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে উদসীন থাকে। কিন্তু যখন মৃত্যুর অপ্রতিরোধ্য থাবা তাকে কাবু করে ফেলে, তখন সে অন্তিম মুহুর্তে অস্থিত অবস্থায় অনুসন্ধান করে সারা জীবনের দায়িত্ব অবহেলার ক্ষতিপূরন আদায় করার কোন উপায় আছে কিনা। ইসলামী আইনে সেই মুহুর্তে ক্ষতিপূরণ করার একটি মাত্র পথ আছে, তা হলো ওসিয়্যঅত। ওসিয়্যাতের মাধ্যমে বিত্তশালী জীবনের অন্তিম মুহুর্তে যেমন গরীবের উপকার করতে পারে তেমনি অনেক সময় এর মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় সামাজিক কাজও সম্পন্ন করা যায়। সে জন্য ইসলামী শরীয়তে ওসিয়্যাতের আলোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
ওসিয়্যাত এর শাব্দিক অর্থ: ওসিয়্যাত আরবী শব্দ যার অর্থ উপদেশ, পরামর্শ, সুপারিশ, আদেশ, উইল। ‘অ উরপঃরড়হধৎু ড়ভ গড়ফবৎহ ডৎরঃঃবহ অৎধনরপ’এ ওসিয়্যাতের অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে, উরৎবপঃরড়হ, ওহংঃৎঁপঃরড়হ, উরংঢ়ড়ংরঃরড়হ, ওহলঁহপঃরড়হ, ঙৎফবৎ, ডরষষ, জবয়ঁবংঃ.
সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ-এ ওসিয়্যাতের অর্থ করা হয়েছে, ভার অর্পণ, নির্দেশ। পারিভাষিক শব্দ হিসাবে শেষ ইচ্ছা, ইচ্ছাপত্র বা ইচ্ছাপত্র যোগে প্রদত্ত সম্পত্তি। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’ গ্রন্থে রয়েছে, ওসিয়্যাত শব্দের অর্থ উপদেশ, মিলানো অর্থাৎ কোন জিনিস অন্যদের পর্যন্ত পৌছানো। ‘ফাতাওয়া ও মাসাইল’ গ্রন্থে রয়েছে, ওসিয়্যাত শব্দের অর্থ কোন কাজের অঙ্গীকার গ্রহণ করা, নির্দেশ প্রদান করা।
ওসিয়্যাত এর পারিভাষিক অর্থ: ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ওসিয়্যাত বলা হয়, “কাউকে বিনিময়বিহীন কোন কিছুর মালিক বানানো, যা ওসিয়্যাতকারী ব্যক্তির মৃত্যুর পর কার্যকর হবে। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি তার সম্পত্তি বা এর আয় তার মৃত্যুর পর হতে চিরকালের জন্য অথবা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য অপর কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কোনরূপ বিনিময় ছাড়াই হস্তান্তর করাকে ওসিয়্যাত বলে। ‘ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’ গ্রন্থে রয়েছে, কোন বস্তু কিংবা তার মুনাফা সম্পর্কে বলে দেয়া অথবা লিখে দেয়া যে, আমার মৃত্যুর পর এটা অমুকের হবে। ইসলামী অনুশাসনে এরূপ অনুরোধকে ওসিয়্যাত বলা হয়। ওসিয়্যাতকারীকে ফিক্হ শাস্ত্রের পরিভাষায় ‘মূসী’ ওসিয়্যাতকৃত বস্তুকে ‘মূসা বিহি’ এবং যার অনুকূলে ওসিয়্যাত করা হয়, তাকে ‘মূসা লাহু’ এবং ওসিয়্যাতকারী ওসিয়্যাতকৃত সম্পত্তি পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি হিসাবে যাকে নিযুক্ত করে তাকে ‘ওসী’ বলে।
ওসিয়্যাতের শর্তাবলী: ইসলামী শরীয়তে কার্যকর করার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। ওসিয়্যাত সংক্রান্ত শর্তাবলী নিম্নে বর্ণনা করা হলো- ওসিয়্যাতকারী ব্যক্তি বিনিময়বিহীন দান করার অধিকার হতে হবে। সুতরাং শিশু বা উন্মাদের ওসিয়্যাত কার্যকর হবে না। শিশু বা উন্মাদের ওসিয়্যাত কার্যকর না হওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি এই যে, ওসিয়্যাত হচ্ছে স্বেচ্ছাদান আর শিশু স্বেচ্ছাদানের উপযুক্ত নয়। তাছাড়া শিশুর বক্তব্য অবশ্য সাব্যস্তকারী নয়। অথচা তার ওসিয়্যাতের সিদ্ধান্ত দানের অর্থ হলো তার বক্তব্যকে অবশ্য সাব্যস্তকারী বলে সিদ্ধান্ত দেয়া। যেহেতু মানুষের মৃত্যুর পর ওসিয়্যাত কার্যকর করার পূর্বে ঋন পরিশোধ করতে হয়, এজন্য ওসিয়্যাতকৃত বস্তু ঋনগ্রস্থ সম্পদের অন্তর্ভূক্ত হতে পারে না। কেননা দুটি প্রয়োজনের মধ্যে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে ঋণের বিষয়টি ওসিয়্যাতের চেয়ে অগ্রবর্তী হবে। ঋণ পরিশোধ করা হলো ফরজ আর ওসিয়্যাত হলো স্বেচ্ছাদান, আর সব সময় পর্যায়ক্রমে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দ্বারাই কাজ শুরু করা হয় কাজেই ঋণগ্রস্থ সম্পদের ওসিয়্যাত সিদ্ধ নয়। যার জন্য ওসিয়্যাত করা হবে সে ওসিয়্যাতের সময় জীবিত থাকতে হবে। চাই সে প্রকৃত পক্ষে জীবিত হোক অথবা জীবিতের হুকুমে হোক। সুতরাং মাতৃগর্ভের যে সন্তান এখনো রূহ প্রাপ্ত হয়নি, তার জন্য ওসিয়্যাত করা যাবে। এ ক্ষেত্রে ওসিয়্যাতের সময় মাতৃগর্ভে সন্তানের অস্তিত্ব প্রতীয়মান হতে হবে এবং ওসিয়্যাত সম্পাদনের ছয় মাসের মধ্যে ভূমিষ্ট হতে হবে। এই সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তার অনুকূলে কৃত ওসিয়্যাত কার্যকর হবে না।
যার জন্য ওসিয়্যাত করা হবে, ওসিয়্যাতকারীর মৃত্যুর সময় সে তার ওয়ারিস হতে পারবে না। অবশ্য এ শর্তটি তখনই প্রযোজ্য হবে, যখন ওসিয়্যাতকারীর অন্য কোন ওয়ারিস বিদ্যমান থাকে। অন্য কোন ওয়ারিস না থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ওয়ারিস হলেও তার জন্য ওসিয়্যাত করা যাবে। রাসূলুল্লাহ সা. বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেকের অধিকার যথাযথ ভাবে বর্ণনা করেছেন, সুতরাং ওয়ারিসগণের জন্য কোন ওসিয়্যাত নেই।” ওয়ারিস বিশেষের অনুকূলে ওসিয়্যাত করা হলে অপরাপর ওয়ারিসের স্বার্থহানী ঘটতে পারে। এর ফলে তাদের মধ্যে বিভেদ ও সম্পর্কচ্ছেদ ঘটবে। অথচ উভয়টিই হারাম। আল্লাহ তাআলা বলেন, “ফিতনা হত্যা অপেক্ষা গুরুতর অন্যায়।”
এছাড়াও রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, “কোন একজন নারী বা পুরষ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ঘাট বছর আমল করল। অতঃপর যখন মৃত্যু উপস্থিত হলো তখসন তারা ওসিয়্যাতের ক্ষেত্রে অন্যের অনিষ্ট করলো। তাহলে উভয়ের জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে যাবে। হাদীসটির সনদ যঈফ মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন তবে অন্যান্য ওয়ারিস যদি অনুমোদন করে তাহলে ওসিয়্যাত করা যাবে। এই নিষেধাজ্ঞা ছিল তাদের অধিকারের কারণে। সুতরাং তাদের অনুমোদন প্রদানের কারণে তা জায়িয হবে। ওসিয়্যাতকারীর মৃত্যুর পর ওসিয়্যাতকৃত বস্তুটি অপরের মালিকানায় দেওয়ার উপযুক্ত হতে হবে। চাই তা কোন সম্পদ হোক অথবা সম্পদ থেকে উপকৃত হওয়া যায় এমন কোন কিছু হোক তা তৎকালে বিদ্যামান থাকুক বা না থাকুক। মূসা বিহি বা ওসিয়্যাতকৃত সম্পদ অবশ্যই মূল্যবান সম্পন্ন জিনিস হতে হবে। যেমন কোন মুসলমানের জন্য মদ, শুকর ইত্যাদি মূল্যবান সম্পন্ন জিনিস নয়। সুতরাং এগুলোর ওসিয়্যাত বৈধ নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা যা উপার্জন কর এবং আমি যা ভুমি হতে তোমাদের জন্য উৎপাদন করে দেই, তন্মধ্যে যা উৎকৃষ্ট্ তা ব্যয় কর এবং এর নিকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করার সংকল্প করো না।
কোন মুসলিম ব্যক্তি অমুসলিম ব্যক্তির অনুকূলে এবং কোন অমুসলিম ব্যক্তি মুসলিম ব্যক্তির অনুকূলে ওসিয়্যাত করতে পারে। প্রথমটির ব্যাপারে কুরআনে এসেছে, “দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের স্বদেশ হতে বহিষ্কার করেনি, তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না, আল্লাহ তো ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালবাসেন।” আর দ্বিতীয়টি যুক্তি এই যে, যিম্মাচুক্তির মাধ্যমে মুআমালাতের লেনদেনের ক্ষেত্রে তারা মুসলিমদের সমান হয়ে পড়েছে। এ কারণেই জীবদ্দশায় উভয়পক্ষ হতে স্বেচ্ছাদান বৈধ রয়েছে। সুতরাং মৃত্যুর পরও তাই হবে।
যদি কোন ব্যক্তি একাধিক ওসিয়্যাত করে তাহলে দেখতে হবে যে, ওসিয়্যাতসমূহের সমষ্টি এক তৃতীয়াংশ হয়, তাহলে তা ওসিয়্যাতকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে। তবে কোন অবস্থাতেই এক তৃতীয়ংশের বেশি সম্পদের ওসিয়্যাত করা যাবে না। হাদীসে এসেছে- “এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা. এর কাছে জানতে চাইলো, আমি কি আমার পুরো সম্পত্তি ওসিয়্যাত করতে পারব? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, না। তারপর আবার বলল, অর্ধেক সম্পত্তি ওসিয়্যাত করতে পারব? রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, না। তারপর আবার বললো, আমি কি এক তৃতীয়াংশ সম্পত্তি ওসিয়্যাত করতে পারব? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, হ্যাঁ। এক তৃতীয়াংশই অনেক।”
ওসিয়্যাত চার প্রকার। যথা: এক: এমন ওসিয়্যাত যা কথা এবং কাজ উভয়ভাবে প্রত্যাহার করা যায়। যেমন- কথার মাধ্যমে প্রত্যাহার যথা- এ কথা বলা যে, আমি ওসিয়্যাত প্রত্যাহার করলাম। কাজের মাধ্যমে প্রত্যাহার যথা- ওসিয়্যাতকৃত বস্তুটি বিক্রয় বা অন্য কোনভাবে আপন মালিকানা থেকে বের করে দেওয়া। দুই: এমন ওসিয়্যাত, যা কথা বা কাজ কোন প্রকারেই প্রত্যাহার করা যায় না। যেমন- কেউ আপন গোলামকে শর্তহীনভাবে বলল, আমার মৃত্যুর পর তুমি আযাদ ও মুক্ত। অবস্থায় কোনভাবেই তার এ কথা প্রত্যাহার করা যাবে না। তিন: এমন ওসিয়্যাত, যা কথার দ্বারা প্রত্যাহার করা যায় কিন্তু কাজের মাধ্যমে প্রত্যাহার করা যায় না। যেমন- কারো জন্য এক তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশ সম্পদের ওসিয়্যাত করা। এক্ষেত্রে কথার মাধ্যমে ওসিয়্যাত প্রত্যাহার করা যায়। কাজের মাধ্যমে করা যায় না, সে যদি মূল সম্পদ থেকে এক-তৃতীয়াংশ পৃথক করে তবুও ওসিয়্যাত বাতিল হবে না, বরং অবশিষ্ট সম্পদের এক-তৃতীয়াংশে তা প্রযোজ্য হবে। চার: এমন ওসিয়্যাত যা কাজের মাধ্যমে প্রত্যাহার করা যায়। কিন্তু কথার মাধ্যমে প্রত্যাহার করা যায় না। যেমন- কেউ শর্ত সাপেক্ষ কোন গোলামকে বলল, আমার মৃত্যুর পর তুমি আযাদ। এই ক্ষেত্রে ইে গোলাম বিক্রয় করে দিলে ওসিয়্যাত বাতিল হয়ে যাবে। কোন কথা দ্বারা বাতিল করা যাবে না। শরীয়তের দৃষ্টিতে ওসিয়্যাত: ওসিয়্যাত কয়েক ধরনের হতে পারে। যেমন- ওয়াজিব: যথা গচ্ছিত রাখা সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার ওসিয়্যাত, অজ্ঞাত ঋন পরিশোধের ওসিয়্যাত, ছুটে যাওয়া সিয়ামের ফিদয়া ও কাফ্ফারা আদায়ের ওসিয়্যাত।
মুবাহ: যেমন- আত্মীয় ও অপরিচিত বিত্তবান লোকদের জন্য ওসিয়্যাত। এ ধরনের ওসিয়্যাত বৈধ। মাকরূহ: যেমন- এমন চরিত্রহীন ও অসৎ লোকদের জন্য ওসিয়্যাত করা যেখানে অধিক সম্ভাবনা থাকে যে, সে ব্যক্তি এ অর্থ খারাপ কাজে ব্যয় করবে। তাহলে সে ওসিয়্যাত মাকরূহ। ওসিয়্যাত যথার্থ ও বৈধ হওয়ার জন্য এর উদ্দেশ্য অবশ্যই শরীয়ত সম্মত হতে হবে। শরীয়ত বিরোধী কোন উদ্দেশ্যে ওসিয়্যাত করা বৈধ নয়। অবৈধ উদ্দেশ্যে ওসিয়্যাত করলে তা কার্যকর হবে না। বরং বাতিল বলে গণ্য হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “সৎকম ও তাকওয়ায় তোমারা পরস্পর সহযোগিতা করবে এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না। মুস্তাহাব: উর্পযুক্ত তিন ধরনের ওসিয়্যাত ছাড়া যাবতীয় ওসিয়্যাত মুস্তাহাব। ফকীহগণ কুরআন, হাদীস ও উম্মাতের ইজমার ভিত্তিতে ওসিয়্যাতের কল্যাণের দিকটি বিবেচনা করে ওসিয়্যাতকারীর যাকাত, রোযা, হজ্জ ও অনুরূপ অত্যবশ্যকীয় কর্তব্য অপূর্ণ না থাকার শর্তে এই মুসতাহাব ওসিয়্যাতকে অনুমোদন দিয়েছেন। এখানে একটি বিষয় আলোচনা করা জরুরী, সেটি হলো আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে কারও মৃত্যুকাল উপস্থিত হলে সে যদি ধন সম্পত্তি রেখে যায় তবে ন্যায়নুগ প্রথা মত তার পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনের জন্য ওসিয়্যাত করার বিধান তোমাদের দেয়া হল। এটা মুত্তাকীদের জন্য একটি কর্তব্য”।ইসলামের প্রাথমিক যুগে যতদিন পর্যন্ত ওয়াসিরগণের অংশ কুরআনের আয়াত দ্বারা নির্ধারিত হয়নি, ততদিন পর্যন্ত মৃত্যু পথযাত্রী তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ পরিমাণ পিতা-মাতা এবং আত্মীয়স্বজনের জন্য ওসিয়্যাত করে যেতেন। অবশিষ্ট সম্পত্তি সন্তানদের মধ্যে বন্টিত হতো। নির্দেশটির বিষয়েই এ আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। উক্ত এ আয়াতের দ্বারা ওসিয়্যাত ফরজ বুঝা যায়। অতঃপর ওসিয়্যাত সম্পর্কিত এ নির্দেশটি ‘মীরাস’ এর দ্বারা রহিত করে দেওয়া হয়েছে।
তাফসীরে মাযহারীতে উর্পযুক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এ আয়াত অবতীর্ণের পূর্বেই ইসলামের প্রথম যুগে আত্মীয়-স্বজনের জন্য ওসিয়্যাত করা ফরজ ছিল। পরে এ আয়াত রহিত হয়ে যায়। মীরাস সংক্রান্ত আয়াত এ আয়াতকে রহিত করেছে। মীরাস সম্পর্কিত আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, “পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছ, তা অল্প হোক অথবা বেশি হোক। এটা নির্ধারিত অংশ।” তবে আলিমগণের সর্বসম্মত অভিমত হচ্ছে, যেসব আত্মীয়ের জন্য মীরাসের আয়াতে কোন অংশ নির্ধারণ করা হয়নি, তাদের জন্য ওসিয়্যাত কর মৃত্যু পথযাত্রীর পক্ষে ফরজ বা জরুরী নয়। সে ফরজ রহিত হয়ে গেছে। এখন প্রয়োজন বিশেষে এটা মুস্তাহাবে পরিণত হয়েছে। ওসিয়্যাতের প্রতি গুরুত্বারোপ করে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘কোন মুসলিম ব্যক্তির ওসিয়্যাত করার মত সম্পদ থাকলে তার নিজের নিকট ওসিয়্যাতনামা ও লিখে দুই রাতও অতিবাহিত করা উচিত নয়’।
যে সব কথায় ওসিয়্যাত সাব্যস্ত হয় ঃ ‘ওয়াকফ সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, কেউ যদি অপর কোন ব্যক্তিকে বলে, তুমি আমার মৃত্যুর পর আমার উকিল, তখন সে ব্যক্তি তার ওসী হয়ে যাবে। আর যদি বলে, তুমি আমার জীবদ্দশায় আমার ওসী, তবে সে উকিল পরিগণিত হবে। আর যদি বলে, তুমি একশ টাকা মজুরি হিসাবে পাবে, এই শর্তে যে তুমি আমার ওসী হবে। তবে শর্ত বাতিল হবে এবং ওসিয়্যাত স্বরূপ সে একশ টাকা পেতে পারে এবং নির্ভরযোগ্য মত অনুসারে সে ওসী হবে। কেউ যদি লোকজনকে ডেকে বলে তোমরা সাক্ষী থাক যে, “আমি অমুকের জন্য এক হাজার টাকা ওসিয়্যাত করছি”, তাহলে তা ওসিয়্যাত হিসেবে পরিগণিত হবে। আর যদি বলে-“আমি ওসিয়্যাত করছি, অমুকের জন্য আমার সম্পদে এক হাজার টাকা রয়েছে”, তাহলে এ টাকা ওসিয়্যাত নয় বরং স্বীকারোক্তি হিসেবে পরিগনিত হবে।
কেউ যদি ওসিয়্যাত স্বরূপ বলে- “আমার বাড়ির এক-তৃতীয়াংশ অমুকের, আমি তা অনুমোদন করছি”, তবে তা ওসিয়্যাত হবে। আর যদি বলে- “আমুক ব্যক্তির জন্য আমার বাড়ির মাঝে এক ষষ্ঠাংশ রয়েছে”, তবে তা স্বীকারোক্তি হবে। অনুরূপ যদি ওসিয়্যাতের কথা উল্লেখ করে বলে- “অমুক ব্যক্তি আমার সম্পদ থেকে এক হাজার টাকা পাবে”, তবে তা ওসিয়্যাত হবে। কিন্তু যদি বলে- “আমার সম্পদে অমুক ব্যক্তির এক হাজার টাকার রয়েছে”, তবে তা স্বীকারোক্তি হবে। আবার কেউ যদি বলে- “আমার এই বাড়িটি অমুকের’, এ ক্ষেত্রে যদি ওসিয়্যাত জ্ঞাপক কথার উল্লেখ না থাকে এবং আমার মৃত্যুর পর এ কথা না বলে, তবে তা দান হিসেবে ধর্তব্য হবে। যদি এ দানকারী ব্যক্তির জীবদ্দশায় ঐ ব্যক্তি তা দখল করে নেয়, তবে তা সহীহ হবে। কিন্তু দানকারী ব্যক্তির ওফাতের পর দানের এ কথা বাতিল হয়ে যাবে। কোন অসুস্থ ব্যক্তি যদি অপরকে বলে ‘তুমি আমার ঋণ-পরিশোধ কর’, তবে সে ব্যক্তি ওসী হবে। যদি কেউ সুস্থ অথবা অসুস্থ অবস্থায় বলে, ‘যদি আমার কোন কিছু হয় তবে অমুক ব্যক্তি এত পাবে’, তাহলে তা ওসিয়্যাত হিসেবে ধর্তব্য হবে।
ওসিয়্যাত প্রত্যাহার করণ: ওসিয়্যাতকারীর জন্য ওসিয়্যাত প্রত্যাহার করা ইসলামী আইনে বৈধ। কেননা এটা হলো স্বেচ্ছা দান। যা এখনো পূর্ণতা লাভ করেনি। সুতরাং তা থেকে ফিরে আসা জায়িয হবে। হিবার ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে। তা ছাড়া আরেকটি কারণ এই যে, ওসিয়্যাত প্রাপ্ত ব্যক্তির ওসিয়্যাত কবুল করার বিষয়টি ওসিয়্যাতকারীর মৃত্যুর উপর নির্ভর করে। আর ইজাব বা প্রস্তাব কবুল করার আগে তা বাতিল করা যায়। বিক্রয়ের ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে।
ওসিয়্যাতকারী সুস্পষ্ট কথা অথবা কার্যকলাপের মাধ্যমে ওসিয়্যাত প্রত্যাহার করতে পারে। কথার মাধ্যমে প্রত্যাহার হলো যেমন ওসিয়্যাতকারী বলল, ‘আমি অমুক জিনিস অমুক ব্যক্তির জন্য ওসিয়্যাত করে ছিলাম। এখন অমুক ব্যক্তির পরিবর্তে অমুক ব্যক্তির জন্য ওসিয়্যাত করলাম।” আর কাজের মাধ্যমে প্রত্যাহার হলো যেমন, কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির অনুকূলে একটি মূল্যবান গাছের ওসিয়্যাত করলো। পরবর্তীতে সে ঐ গাছ কেটে নিজের গৃহ নির্মাণের কাজে ব্যবহার করল, এমতাবস্থায় তার ওসিয়্যাত প্রত্যাহার হয়ে গেল।
ওসিয়্যাত প্রত্যাহারের ব্যাপারে তিনটি মূলনীতি রয়েছে। যথা- ১। অপরের মালিকানাধীন কোন বস্তুতে যে ধরনের পরিবর্তন-পরিবর্ধন করলে মালিকের মালিকানা নিঃশেষ হয়ে যায়, ওসিয়্যাতকারী ব্যক্তি সে ধরনের কোন পরিবর্তন করলে সে তার ওসয়্যিাত প্রত্যাহার করেছে বলে গণ্য হবে। ২। অনুরূপ ওসিয়্যাতকৃত বস্তুর মধ্যে কিছুর সংযোগন, যা দ্বারা মূলবস্তুর মাঝে পরিবর্তন সাধন হয় এবং এ অতিরিক্ত বস্তু ব্যতীত মূলবস্তুটি প্রদান করা সম্ভবপর না হয়, এরূপ সংযোজন করা প্রত্যাহার বলে গণ্য হবে। ৩। ওসিয়্যাতকৃত বস্তুর মাঝে এমন কোন পদক্ষেপ, যা দ্বারা মালিকানা নিঃশেষ হয়ে যায়, তাও প্রত্যাহার হিসেবে ধর্তব্য হবে।
ওসিয়্যাতের অনুকূলে সাক্ষ্য: মৃত ব্যক্তির ওয়ারিসগণ ওসিয়্যাত অস্বীকার করলে তা প্রমাণের জন্য দুই জন সাক্ষীর সাক্ষ্য পেশ করতে হবে। মত বিরোধের ক্ষেত্রে ওসিয়্যাত প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সাক্ষীর প্রয়োজন, দুইজন লোক যদি সাক্ষ্য দেয় যে, অমুক ব্যক্তি অমুক ব্যক্তির অনুকূলে এই জিনিসের ওসিয়্যাত করেছে, এবং মূসা লাহুও (যার জন্য ওসিয়্যাত করা হয়েছে) এর দাবী করে তবে ওসিয়্যাত প্রামাণিত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“হে মুমনিগণ! তোমাদের কারও যখন মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন ওসিয়্যাত করার সময় তোমাদের মধ্য হতে দুইজন ন্যায়পরায়ন লোককে সাক্ষী রাখবে, তোমরা সফরে থাকলে এবং তোমাদের মৃত্যুর বিপদ উপস্থিত হলে তোমাদের ছাড়া অন্য লোকদের (অমুসলিমদের) মধ্য হতে দুইজন সাক্ষী মনোনীত করবে। ওসিয়্যাতনামার সত্যতা সাব্যস্থ হলেই তা গ্রহণযোগ্য হবে এবং সাক্ষ্য হলো এর প্রমাণ স্বরূপ।
ওসী নিয়োগ ও ওসীর যোগ্যতা: ওসিয়্যাতকারী ব্যক্তি তার কৃত ওসিয়্যাত সম্পাদন করার দায়িত্ব যার উপর ন্যস্ত করে শরীয়তের পরিভাষায় তাকে ওসী বলা হয়। যে কোন বিশ্বস্ত, মুসলিম, বালিগ ও সুস্থবুদ্ধির অধিকারী নারী বা পুরুষকে ওসী নিয়োগ করা যায়। তারা ওসিয়্যাতকারীর আত্মীয় হোক বা না হোক, তবে কোন অমুসলিমকে ওসী নিয়োগ করা বৈধ নয়। নিম্নে ওসীর যোগ্যতা ও ওসী নিয়োগ সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় বর্ণনা করা হলো:
প্রথমত: কোন অমুসলিম ব্যক্তি ওসী হতে পারে না। কারণ, এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ হলো, “আল্লাহ কখনও মুমিনদের উপর কাফিরদের কর্তৃত্ব করার অধিকার দেননি।
দ্বিতীয়ত: ওসীর দায়িত্ব পালনে অপরাগ ব্যক্তিকে যদি ওসী নিযুক্ত করা হয়, তাহলে কাযী তার সাথে অন্য একজনকে নিয়োগ দিবেন। দ্বিতীয়জন প্রথমজনকে ত্রæটিবিচ্যুতি থেকে রক্ষা করবে এবং সহযোগিতা করবে।
তৃতীয়ত: যদি দু’জনকে ওসী নিয়োগ করা হয়, তাহলে একজন অপরজনকে বাদ দিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। এবং কোন পদক্ষেপও গ্রহণ করতে পারবে না।
চতুর্থত: মৃত ব্যক্তির ওসিয়্যাত কার্যকর করার এবং তার নিকট অপরের অথবা অপরের নিকট তার প্রাপ্য ঋণ আদায় করার মত কোন যোগ্য ওয়ারিস বা ওসী নিয়োজিত না থাকলে আদালত এর ব্যবস্থাপনার জন্য ওসী নিয়োগ করতে পারে।
পঞ্চমত: কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিকে ওসী নিয়োগ করা যাবে না। কারণ অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের যোগ্যতা নেই। বরং তার হাতে সম্পদ ন্যস্ত করলে, সে তা নষ্ট করে ফেলতে পারে। এ বিষয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, “যখন তাদের মধ্যে বিচার-বুদ্ধির ক্ষমতা খুঁজে পাবে, তখন তাদের সম্পদ তাদের কাছে প্রত্যর্পণ কর।
উপসংহার: ওসিয়্যাত পুন্যলাভের একটি উপায়। ইসলামে ওসিয়্যাত কেবল বৈধই নয়, বরং এটি একটি প্রশংসনীয় কাজ। ইসলামের প্রাথমিক যুগে ওসিয়্যাত একটি অত্যবশ্যকীয় ইবাদত ছিলো। যদিও পরবর্তীতে মীরাসের আয়াত অবতীর্ণের ফলে সে বিধান রহিত হয়ে গেছে। ওসিয়্যাত এমন একটি কাজ যা দ্বারা নিজের প্রিয় সঞ্চয়কে নিজের পছন্দনীয় কাজে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করা যায়। মানুষকে যেহেতু মৃত্যুর স্বাদ অবশ্যই আস্বাদন করতে হবে, সেহেতু তাকে মৃত্যুর সময় এমন কিছু কাজ করে যাওয়া উচিত, যার দ্বারা সমাজের মানুষ উপকৃত হয় এবং পরকালে কঠিন বিপদের মুহুর্তে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট যা মুক্তির ওসীলা হিসেবে বিবেচিত হয়। সমাজের বিত্তশালীদের পরকালীন মুক্তির ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ওসিয়্যাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তাই নিজের পরকালীন মুক্তি এবং সমাজের সার্বিক উন্নতির জন্য সকলের নিজের সাধ্য এবং ক্ষমতা অনুসারে ওসিয়্যাত করা উচিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন