প্রিয়নবী (স) এর প্রতি আদব-শিষ্টাচার প্রদর্শন তাঁর জীবদ্দশায় যেমন ওয়াজিব ছিল তেমনি তাঁর ইন্তেকাল-পরবর্তী সময়েও তা ওয়াজিব। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল শরীয়তবিশেষজ্ঞগণের এক্ষেত্রে এটাই সিদ্ধান্ত। নিম্নে কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হল:
উদাহরণ-০১: হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা) মসজিদে নববীর কাছে পার্শ্ববর্তী কোন বাড়ীঘরে যদি পেরাক-তারকাটা লাগানোর শব্দ শুনতেন,তাৎক্ষণিক কাউকে পাঠিয়ে বলতেন,“রাসূলুল্লাহ (স)-কে যেন কষ্ট দেয়া না হয়।”(ওফাউল-ওয়াফা)
উদাহরণ-০২ : হযরত আলী (রা)এর নিজ ঘরের দরজা বানানোর প্রয়োজন দেখা দিল। এতে তিনি মেস্তরীর সঙ্গে শর্ত করলেন,তিনি দূরে কোথাও থেকে তা বানিয়ে নিয়ে আসবেন,যাতে করে দরজাটি প্রস্তুতকালীন ঠুসঠাস শব্দ ইত্যাদির কারণে প্রিয়নবী (স) এর কষ্ট না হয়। তা পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার পর কেবল যথাস্থানে এন লাগিয়ে দেবে।
উদাহরণ-০৩ : হযরত সায়েব ইবন ইয়াযীদ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মসজিদে-নববীতে শায়িত ছিলাম এমতাবস্থায় কে যেন আমার প্রতি ছোট একটি পাথর নিক্ষেপ করল। আমি মাথা উঠিয়ে তাকিয়ে দেখি,হযরত উমর ফারূক (রা) দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি দু’জন লোকের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “ওই দু’জনকে ডেকে নিয়ে এসো”। তারা কাছে এলে হযরত উমর (রা) জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা কারা? কোথা থেকে এলে”? তারা জবাবে বলল, তায়েফ থেকে। তিনি বললেন,“তোমরা যদি এ মদীনার বাসিন্দা হতে,তাহলে তোমাদের আমি বেত্রাঘাত করতাম। তোমরা রাসূলুল্লাহ (স) এর মসজিদে জোরে জোরে কথা বলছো!”(বুখারী শরীফ)
উদাহরণ-০৪ : হযরত নাফে‘ (রা) বর্ণনা করছেন, একদা ইশার সময় হযরত উমর (রা) মসজিদে নববীতে উপস্থিত ছিলেন। আকস্মিক কারও জোরে হাসার শব্দ শোনা গেল। তিনি তাকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার পরিচয়”? সে জবাবে বলল, আমি বনু-সাকীফ গোত্রের লোক। তা শুনে হযরত উমর (রা) জিজ্ঞাসা করলেন,“তুমি থাকো কোথায়”? সে উত্তরে বলল, তায়েফ অঞ্চলে। তিনি বললেন, “তুমি যদি এ মদীনার লোক হতে,তাহলে তোমাকে অবশ্যই আমি শাস্তি দিতাম। স্মরণ রাখবে,এ মসজিদে জোরে কথা বলা যায় না।”(ওফাউল-ওয়াফা)
উদাহরণ-০৫ : ইবন হুমাইদ থেকে বর্ণিত, খলীফা আবূ জা‘ফর মনসূর আব্বাসী ইমাম মালেক (র)এর সঙ্গে মসজিদে নববীতে, কোন বিষয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। সে-সময়ে খলীফার সঙ্গে পাঁচশত তলোয়ারধারী বিশেষায়িত সৈনিক,নিরাপত্তা প্রহরী বিদ্যমান ছিলেন। বাক্য বিনিময় কালীন খলীফার আওয়াজ কিছুটা উচ্চস্বরে শোনা যাচ্ছিল।তখন ইমাম মালেক (র) বললেন,:হে আমীরুল মুমিনীন! এ মসজিদে নিজের কথা উচ্চ শব্দে বলবেন না.......। প্রিয়নবী (স)এর প্রতি আদব ও সম্মান প্রদর্শন বিষয়টি তাঁর ইন্তেকালের পরেও ঠিক তেমনি জরুরী যেমনটি তাঁর জীবদ্দশায় অপরিহার্য ছিল। তা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আবূ জা‘ফর স্বীয় কন্ঠ নিচু করে ফেলেন।
উদাহরণ-০৬ : হযরত ইমাম মালেক (র) নিজের পুরো জীবন মদীনায় কাটিয়ে দিয়েছেন। যখন প্রস্রাব-পায়খানার প্রয়োজন দেখা দিত তিনি মদীনার বাইরে- মদীনার প্রান্তিক সীমানায় চলে যেতেন এবং এমনভাবে বসে প্রয়োজন সারতেন যে,তাঁর দেহ থাকতো মদীনার সীমার ভেতরে আর মল-মুত্র পতিত হতো মদীনার সীমার বাইরে। কেউ জিজ্ঞাসা করলে,জবাবে বললেন:“আমার ভয় হচ্ছে, আমার মৃত্যু আবার কিনা মদীনার বাইরে সংঘটিত হয়ে যায়!” একদিকে প্রেমাষ্পদের বাড়ী-ভুমির প্রতি এতো মহব্বত-ভালোবাসা, আবার অন্যদিকে এমন চূড়ান্ত পর্যায়ের আদব-শিষ্টাচার যে,স্বীয় দেহের ময়লা-নাপাকী মদীনার পবিত্র ভূখন্ডে পতিত হোক, তা-ও সহ্য হচ্ছে না! প্রেম-ভালোবাসা ও আদব-শিষ্টাচারের প্রতি যত্মবান থাকার এমন দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল!
উদাহরণ-০৭: হযরত ইমাম মালেক (র) এর এমন অভ্যাস ছিল যে, তিনি মদীনা শরীফের অলি-গলিতে চলাকালীন রাস্তার একপাশ দিয়ে চলতেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হলে, তিনি উত্তরে বললেন:“হয়তো এ রাস্তার মধ্যে প্রিয়নবী (স)এর পা মুবারকের পদচিহ্ণ বিদ্যমান অথচ তাতে আমার পা লেগে যাবে! আর তাতে আমার মারাত্মক বেআদবী হয়ে যাবে!
উদাহরণ-০৮: ইমাম শাফেয়ী (র) একবার ইমাম মালেক (র)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কাছে বাহনযোগ্য শ্রেষ্ঠ ঘোড়া বিদ্যমান;কিন্তু আপনি মদীনায় ঘোড়ায় আরোহণ করেন না কেন? তিনি জবাবে বললেন,আমার কাছে এমনটি অশোভনীয় মনে হয় যে,যে-পবিত্র ভূমিতে আমার মাহবূব-মনিবের পদ স্পর্শ্ব করেছে-তা আমার ঘোড়ার পা দ্বারা দলিত-মথিত হোক! শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলবী (র) ‘জযবুল-কূলূব’ গ্রন্থে লিখেছেন,“ইমাম মালেক (র) মহানবী (স)এর আদবের প্রতি লক্ষ রেখে মদীনা শরীফে ঘোড়ায় আরোহণ করতেন না।”
উদাহরণ-০৯: একদা জনৈক ব্যক্তি প্রাসঙ্গিকভাবে বলেছিল,“মদীনা শরীফের মাটি খারাপ!” ইমাম মালেক (র) তা শুনে ফাতওয়া দিয়ে দিলেন,“লোকটিকে ত্রিশটি বেত্রাঘাত করতে হবে এবং কিছুদিন জেলেও বন্দী রাখতে হবে।” কেউ জিজ্ঞাসা করলো, এতো কঠোরতা কেন? তিনি উত্তর দিলেন, “এ লোক তো এমন শাস্তিযোগ্য যে,তাকে হত্যা করা উচিত! তার কারণ, যে-ভূমিতে আল্লাহ তা‘আলার প্রিয়নবী (স) শুয়ে আরাম করছেন, সে মাটি বিষয়ে তার ধারণা,তা কিনা নষ্ট-খারাপ!”(শিফা)
জনৈক কবি কতই না উত্তমভাবে তার হৃদয়নিঙড়ানো ভাব প্রকাশ করেছে এভাবে-
“আকাশের নিচে মহান আল্লাহর মহা আরশের চেয়েও অধিক স্পর্শ্বকাতর এ(রওযা শরীফ) আদবস্থল!
এখানে এসে জুনায়দ ও বায়েযীদ-এর মত মনীষীরাও শ্বাস বন্ধ করে হাযিরা দিয়ে থাকেন”।
অনেকটা যেন এ পবিত্র দরবারে জোরে নিঃশ্বাস নেওয়াও বেআদবির নামান্তর!
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন