সাহাবী শব্দের অর্থ সঙ্গী, সাথি বা বন্ধু। প্রবাদ আছে দুঃসময়ের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। ইসলামের দুঃসময়ে সহাবায়ে কেরামকে রাসূল সাথি বা বন্ধু হিসাবে পেয়েছিলেন। শরীয়তের পরিভাষায় সাহাবী সেই ব্যক্তিকে বলা হয়, যিনি রাসূল (সা.) এর উপর ঈমান এনেছেন এবং ঈমানের উপরই মৃত্যু বরণ করেছেন। এভাবেও বলতে পারি যে, সাহাবায়ে কেরাম হলেন ঐ সকল ব্যক্তি, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা রাসূল (সা.) এর সঙ্গীরূপে নির্বাচিত করেছেন।
সাহাবায়ে কেরামদের সম্মান ও ভালবাসা ঈমানের অংশ বিশেষ। কুরআনে কারিমের সূরাতুল ফাতাহ এর ২৯ নং আয়াতে সাহাবায়ে কেরামদের পরিচয় ও মর্যাদা নিয়ে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সাথে যারা আছে তারা কাফেরদের উপর অত্যান্ত কঠোর । পরস্পরের প্রতি দয়াশীল আপনি তাদের কে রুকু করা সিজদা করা অবস্থায় দেখতে পাবেন। তারা আল্লাহর করুনা ও সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করছে। তাদের পরিচয় হচ্ছে, তাদের চেহারায় সিজদার আলামত আছে।
ইরশাদ হচ্ছে, যারা আল্লাহর রাসূলের সামনে নিজেদের কন্ঠস্বর নিচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য বাছাই করে নিয়েছেন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহা পুরস্কার (সূরা হুজরাত- ৩)
সহিহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীস, হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বণির্ত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা আমার সাহাবাদের মন্দ বলো না, কেননা তোমাদের মধ্যে কেউ যদি পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহর রাস্তায় দান করফ, তবুও তাদের দানের সমতুল্য হবে না।
প্রখ্যাত সহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, যে আমার সাহাবী কে কষ্ট দিল, সে যেন আমাকে কষ্ট দিল। যে আমাকে কষ্ট দিল, সে যেন আল্লাহকে কষ্ট দিল। আর যে আল্লাহকে কষ্ট দিল তাকে আল্লাহ পাকড়াও করবেন। (মুসনাদে আহমেদ) রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, যে মুসলিম হিসেবে আমাকে দেখেছে এবং আমি যাদের দেখেছি, তাদেরকে দোযখের আগুন স্পর্শ করবে না। (তিরমিজী শরীফ- ৩৮০১)
একটি হাদিসে তিনি আরো বলেন, আমার কোনো সাহাবী কোনো স্থানে ইন্তেকাল করলে, আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের দিন ঐ এলাকার নেতা হিসাবে উঠাবেন।
ইমাম কুরতুবি রহ. বলেন, সাহাবায়ে কেরাম হচ্ছেন ইসলামের নক্ষত্র । আল্লাহ তাআলা তাদেরকে দীন কায়েমের উদ্দেশ্যে নবীজির সোহবতে থাকার জন্য বাছাই করেছেন। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, যারা সাহাবাগণের সমালোচনা করবে, তাদের উপর আল্লাহ, ফেরেশতা ও মানবকুলের লানত নেমে আসবে তাদের ফরজ ও নফল কোন আমলই আল্লাহ তাআলা কবুল করবে না। (কুরতুবি ৮/১৯৬)
ইসলামে সাহাবায়ে কেরামদের অবদান অপরিসীম। তম্মধ্যে কুরআন শরীফ একত্রীকরণ ও সংরক্ষণে অবদান অতুলনীয়। রাসূল (সা.) সাহাবীদের কুরআন হিফজ করতে উৎসাহ দিতেন। তাই রাসূলের জিবদ্দশায় বহু সংখ্যক সাহাবী কুরআন শরীফ মুখস্ত হিফজের মধ্যমে সংরক্ষণ করেন। শুধু তাই নয়, রাসূল (সা.) কুরআন মাজীদ লিপিবদ্ধ আকারেও সংরক্ষণের জন্য, উত্তম সাহাবীদের মধ্য থেকে ৪০ জনের একটি লেখক দল মনোনীত করেন, যাদেরকে কাতেবে ওহী বলা হয়। যাদের মধ্যে খোলাফায়ে রাশেদীনসহ আবু বকর, উমর, আলী, ওসমান , মুয়াজ বিন জাবাল , যায়েদ বিন সাবেত আমিরে মুআবিয়া (রা.) উল্লেখযোগ্য।
হাদীস সংরক্ষণে সাহাবাদের অবদান অনেক । রাসূল (সা.) এর জীবদ্দশায় সাহাবীগণ হাদীসসমূহ মুখস্থ করে স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করেন। আবার অনেক সাহাবী রাসূলের অনুমতিতে হাদীস লিপিবদ্ধ করতেন।
রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের পর শিয়া খাওয়ারেজ, মুনাফিকরা হাদীস বিকৃত করে রাসূল (সা.) এর নামে চালিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করলে অসংখ্য সাহাবী অতন্দ্র প্রহরীর মত হাদীসসমূহ রক্ষা করেন। হাদীস বর্ণনাকারী বা মুহাদ্দীস সাহাবীগণের মধ্যে, হযরত আবু হুরাইরা (রা.) এর বর্ণনাকৃত ৫৩৭৪ হাদীস, আয়েশা (রা.) ২২১০ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ২৬৬০, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) ২৬৩০, আনাস বিন মালেক ২৬৮৬, আবু সাঈদ খুদরী ২২৭০ হাদীস রেওয়ায়েত করেন। এছাড়াও প্রায় লক্ষাধিক সাহাবী হাদীস সংরক্ষণে ঐতিহাসিক অবদান রাখেন।
ইসলামের খাতিরে সাহাবায়ে কেরামদের হিজরত একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। রাসূল (সা.) এর নির্দেশে হযরত ওসমান (রা.) তার স্ত্রী রোকাইয়াসহ মোট ১৫ জনের সাহাবীর একটি দল আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। এটিকে ইসলামের প্রথম হিজরত বলে। কাফিরদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ৬২২ সালে, রাসূল (সা.) এর অনুমতিক্রমে সাহাবায়ে কেরাম নিজের বাড়ী ঘর সহায়-সম্পত্তি মাতৃভ’মি ও আপন জনের মায়া ত্যাগ করে মদিনা শরীফ হিজরত করেন । মদিনায় আনসার সাহাবীগণও মুহাজিরদের আনন্দচিত্তে বরণ করেন এবং সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেন। দীন প্রচারের জন্য কায়স ইবনে হুযাইফা , উরওয়া ইবনে আছাছাসহ কিছু হাবশি মুসলমান নিয়ে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে চীনের পথে রওয়ানা হন পথিমধ্যে তাদের জাহাজ চট্টগ্রামেও নোংগর করার কথা ইতিহাস থেকে পাই। কারণ এটি জাহাজ চলাচলের একটি নিরাপদ ট্রানজিট। এভাবে রাসূলের হাতেগড়া সাহাবায়ে কেরাম ইসলামের প্রচার প্রসারে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে হিজরত করেন।
আল্লাহর রাস্তায় দানের ক্ষেত্রেও এই দলের অবদান নজিরবীহিন। ইসলামের দূদির্নে, মুসলমানের অভাব অনটনে, যে কোন দূভির্ক্ষে ও যুদ্ধ বিগ্রহে পরস্পরের মধ্যে দান খয়রাত নিয়ে প্রতিযোগীতা আরম্ভ হয়ে যেত। আল্লাহ তাআলা খুশি হয়ে সূরা বাইয়িনায় ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাদের উপর রাজি তারাও আল্লাহর উপর রাজি ।
যুদ্ধের ময়দানে সাহাবায়ে কেরামদের অবদান অপরিসীম। রাসূল ((সা.)) জীবনে সাহাবায়ে কেরামদের নিয়ে প্রায় ২৭ টি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। রাসূল (সা.) যখনি যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন, সাহাবায়ে কেরাম ইসলামের খাতিরে আপন জীবন ও পরিবারকে বিসর্জন দিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়েছেন। বদর যুদ্ধে ১৪ জন, উহুদ যুদ্ধে ৭০, খায়বার যুদ্ধে ১৬, মুতার যুদ্ধে ১২ সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। এছাড়াও বানু নযীরের যুদ্ধে, খন্দকের যুদ্ধে, হুনায়ন যুদ্ধে, তাবুক যুদ্ধে হুদায়বিয়ার সন্ধিসহ ও মক্কা বিজয়েও সাহাবারা ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
ইসলাম গ্রহণের জন্য সাহাবায়ে কেরামদের নিযার্তনের ইতিহাস শুনলে গা শিউরে উঠে। প্রখ্যাত সাহাবী হযরত বিলাল হাবশী (রা.) যিনি মসজিদে নববীর স্থায়ী ও ইসলামের শ্রেষ্ঠ মুয়াজ্জিন ছিলেন। ইসলামের চিরশত্রæ আবু জেহেল ও উমাইয়া ইবনে খালাফ দিনের বেলায় তাকে উত্তপ্ত বালিতে শোয়ায়ে ভারি পাথর তার বুকের উপর চাপিয়ে দিতো তবুও বিলাল (রা.) এ করুন পরিস্থিতিতেও বলতেন, আহাদ আহাদ তথা আমার প্রভু একমাত্র আল্লাহ ।
একদা খলীফা হযরত উমর রা খুবাইব (রা.) কে নির্যাতন ভোগের কথা জিজ্ঞাস করলেন। হযরত খুবাইব বলেন, ইসলাম গ্রহণ করার কারণে জ্বলন্ত লোহা গরম করে আমাকে আঘাত করত, লোহার পোশাক পরিয়ে প্রচন্ড গরমে ফেলে রাখত, লোহার গরম আর প্রচন্ড তাপে আমার শরীরের গোশত খষে পড়ত। প্রজ্জলিত কয়লার উপর আমাকে টানা-হেচড়া করত। আমার গায়ের রক্ত ও চর্বি ঝরে আগুন নিভে যেত, তবুও আমি ইসলাম ছাড়িনি। এভাবে হযরত খুবাইবকে কাফের সম্প্রদায় বলেছিল যে, মুহাম্মদ ((সা.)) কে অসিকার করতে, তিনি রাজি না হওয়ায়, তীর বর্ষা ও খন্জরের আঘাতে তাকে জর্জরিত করা করা হলে তিনি কালেমা পড়তে পড়তে শাহাদাত বরণ করলেন। ইসলাম ও রাসূলের প্রতি খুবাইব (রা.) এর এই ভালবাসা দেখে সায়িদ বিন আমেরসহ আরো অনেকে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেন । সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে সাহাবায়ে কেরামদের সম্মান ও ভালবাসা নিয়ে তাদের নমুনায় আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন