শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

দয়ার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১১ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মতো মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি সৃষ্টিকুলে আগমন করেনি। ভবিষ্যতে করবেও না। পৃথিবীতে পালনীয় কোনো নবীর দ্বীন পূর্ণাঙ্গ ছিল না, একমাত্র মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দ্বীন পূর্ণাঙ্গ। তিনি জগতের শেষ নবী। তাঁর পরে কোনো নবীর আগমন হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘স্মরণ করো, যখন মরিয়ম তনয় ঈসা আলাইহিস সালাম বলল, ‘হে বনি ইসরাঈল, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। আমার পূর্ববর্তী তাওরাতের সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন। তাঁর নাম আহমদ।’ [সূরা ছফ : ৬]

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে আবির্ভূত হন এমন এক কঠিন সময়ে যখন সমগ্র পৃথিবী আইয়ামে জাহেলিয়াতের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল। কোথাও শান্তি ছিল না, স্বস্তি ছিল না, ধর্মের নামে অধর্ম বিরাজ করছিল সর্বত্র। শিরক ও কুফরের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল সবাই। নারীদের সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হচ্ছিল অবলীলায়, কন্যাসন্তানকে দেয়া হচ্ছিল জীবন্ত কবর। মারামারি, হানাহানি, খুন-খারাবির উন্মোত্ততায় গোটা সমাজ ছিল টালমাটাল, পৃথিবীর সেই করুণ অবস্থা নিরসনের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সিরাজুম মুনিরা বা প্রদীপ্ত চেরাগরূপে প্রেরণ করলেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম ও অমুসলিম, অনুগত ও অবাধ্য, ছোট-বড়, নারী, পুরুষ, শিশু, ধনী, গরীব, বিভিন্ন রঙ, ভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাভাবনা, আক্বিদা ও স্থানের ভেদাভেদের উর্ধ্বে সকলের জন্যই রহমত। যারা তাঁর উপর ঈমান আনেনি তিনি তাদের জন্যও রহমত স্বরূপ প্রেরিত হয়েছেন। তাঁর রহমত শুধু মানবজাতির জন্য সীমাবদ্ধ নয়, বরং পশুপাখি ও জড়পদার্থের জন্যও তিনি ছিলেন রহমত। রাসূলের সারা জীবনের নানা ঘটনা ও অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে এ রহমত স্পষ্ট হয়। সার্বজনীন, সর্বকালীন বিশ্বমানবতার চিরকল্যাণকর চিরউন্নত আদর্শ মানব হচ্ছেন ইনসানে কামেল, খাতামুল মুরসালিন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যার নরম-কোমল পরশ ছোঁয়া, পরম হিতৈষী মনোভাব, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সহাবস্থান যুগে যুগে পংকিলতার ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত বিশ্ব সমাজ ও মানব গোষ্ঠীকে তার আদর্শ জীবনাদর্শ অনুসরণে উদ্ধুদ্ধ করে। অন্ধকারে থাকা পৃথিবী আর ধ্বংসের দোরগোড়ায় চলে যাওয়া মানবতাই কেবল নয়, বরং জাতি ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, দলমত নির্বিশেষে সবাই আলোকজ্জ্বল জীবনের দিক ও দিশা পেয়েছে তার ৬৩ বছরের কর্ম ও মহানুভবতা থেকে। তাই তিনি বিশ্ববাসী তথা ভূমন্ডলীর জন্য রহমত, আপাদমস্তক বরকত। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা মানবমুক্তির সংবিধান পবিত্র কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত করে প্রেরণ করেছি।’ [সূরা আম্বিয়া : ১০৭]

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গোটা জগৎ বাসীর জন্য অনুগ্রহ, দয়া বা করুনার প্রতীক করে প্রেরণ করেছেন। মানব, জ্বিন, জীবজন্তু, উদ্ভিদ, জড়পদার্থসমূহ সবই এর অন্তর্ভুক্ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবার জন্যই রহমতস্বরূপ ছিলেন। কেননা আল্লাহর যিকর ও ইবাদাত হচ্ছে সমগ্র সৃষ্টিজগতের সত্যিকার রূহ। এ কারণেই যখন পৃথিবী থেকে এ রূহ বিদায় নিবে, তখন পৃথিবীতে আর “আল্লাহ্ আল্লাহ” বলার কেউ থাকবে না। ফলে সব জীবের মৃত্যু হবে এবং কিয়ামত এসে যাবে। যখন জানা গেল যে, আল্লাহর ইবাদাত ও যিকর সকল বস্তুর রূহ, তখন রাসূল যে সব বস্তুর জন্যে রহমতস্বরূপ তা আপনা আপনি ফুটে উঠল। কেননা দুনিয়াতে কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর যিকর ও ইবাদাত তাঁরই প্রচেষ্টায় ও শিক্ষার বদৌলতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রহমত।’ [ইবনে আসাকির]

ইবনে উমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি আল্লাহর প্রেরিত রহমত, যাতে (আল্লাহর আদেশ পালনকারী) এক সম্প্রদায়কে গৌরবের উচ্ছাসনে আসীন করি এবং (আল্লাহর আদেশ অমান্যকারী) অপর সম্প্রদায়কে অধঃপতিত করে দেই।’ [মা‘রেফুল কুরআন : পৃ: ৮৯২]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাত বিশ্বজগতের জন্য। সেহেতু তিনি বিশ্বজগতের রহমত রূপে; অর্থাৎ নিজের শিক্ষা দ্বারা বিশ্ববাসীকে ইহ-পরকালের সুখের সন্ধান দিতে প্রেরিত হয়েছিলেন। কিছু উলামা তাঁকে এই অর্থেও বিশ্বজগতের জন্য করুণা বলেছেন যে, তাঁর কারণেই এই উম্মত (তাঁর দাওয়াত গ্রহণ অথবা বর্জনকারী মুসলিম অথবা কাফের সকলেই) নির্মূলকারী ব্যাপক ধ্বংসের হাত হতে রেহাই পেয়েছে। যেভাবে পূর্ববর্তী বহু জাতিকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে, উম্মাতে মুহাম্মাদিয়াকে ঐ রকম আযাব দিয়ে ধ্বংস করে নির্মূল করা হয়নি। বহু হাদীস দ্বারা জানা যায় যে, মুশরিকদের উপর বদ দু‘আ ও অভিশাপ না করাও ছিল তাঁর করুণারই একটি বিশেষ অংশ। তাঁকে তাদের উপর বদ দু‘আ করতে আবেদন করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি অভিশাপকারীরূপে প্রেরিত হইনি; আমি কেবল করুণারূপে প্রেরিত হয়েছি।’ [মুসলিম : ৪৭০৪, মিশকাত : ৫৮১২]

তাঁর রহমত শুধু বিভিন্ন অবস্থা ও ঘটনার সাথেই সীমাবদ্ধ ছিলনা। বরং ইহা ছিল আদেশ, শরিয়ত, পদ্ধতি ও আখলাক, যা তিনি মানুষের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মানুষের প্রতি রহমত, দয়া ও নম্রতার প্রতি উৎসাহ দিয়ে বলেছেন, ‘হে আল্লাহ, যে ব্যক্তি আমার উম্মতের দায়িত্বশীল হয় এবং তাদের সাথে কঠোরতা করে তুমিও তার প্রতি নির্দয় ও কঠোর হও। আর যে ব্যক্তি আমার উম্মতের শাসক হয় এবং তাদের সাথে সদয় ব্যবহার করে, তুমিও তার সাথে সদয় ব্যবহার কর।’ [সহীহ মুসলিম] অতএব রহমত হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান চরিত্র। ইসলাম ধর্মের মৌলিক ভিত্তি হলো রহমত ও শান্তি।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা দয়ালুদের উপর দয়া ও অনুগ্রহ করেন। তোমরা জমিনবাসীকে দয়া কর, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের উপর দয়া করবেন। দয়া রহমান হতে উদগত। যে লোক দয়ার সম্পর্ক বজায় রাখে আল্লাহ তা‘আলাও তার সাথে নিজ সম্পর্ক বজায় রাখেন। আর যে লোক দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহ তা‘আলাও তার সাথে দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করেন।’ [তিরমিজি : ১৯২৪]

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশ্বের সকলের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো ঃ তিনি যখন মক্কায় স্বজাতিকে তাদের উপর রহমত করে-দাওয়াত দিলেন, তারা তাঁকে মিথ্যারোপ করেছিল, মক্কা থেকে বিতাড়িত করেছে, এমনকি তাঁকে হত্যার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে রক্ষা করেন, তিনি তাদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর কাফেরেরা যখন প্রতারণা করত আপনাকে বন্দী অথবা হত্যা করার উদ্দেশ্যে কিংবা আপনাকে বের করে দেয়ার জন্য তখন তারা যেমন ছলনা করত, তেমনি আল্লাহও ছলনা করতেন। বস্তুতঃ আল্লাহর ছলনা সবচেয়ে উত্তম।’ [সূরা আনফাল : ৩০]

এতকিছুর পরেও তাদের প্রতি রাসূলের রহমত দিনে দিনে বেড়েই চলল, তাদের হিদায়েতের ব্যাপারে তিনি খুবই আশাবাদী ছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে বলেন, ‘তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।’ [সূরা তাওবা : ১২৮]

যুগে যুগে মানবজাতির হিদায়েতের জন্য আল্লাহ তা‘আলা আসমানি কিতাবসহ নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। তাঁদের মেহনত ছিল দাওয়াত, তাবলীগ, তা‘লীম, তারবিয়াত এর মাধ্যমে আল্লাহর এ ধরাতে তাঁর নাযিলকৃত ও মনোনীত দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা ও মেহনত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য শরয়ী বিধান নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যা তিনি নূহ (আ.) কে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং যে বিষয়ে আপনাকেও অহী করলাম, এ বিষয়ে আদেশ করেছিলাম ইবরাহীম, মূসা এবং ঈসা (আলাইহিমুস্ সালাম) গণের উপর, তোমরা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা কর, এ ব্যাপারে মতপার্থক্য লিপ্ত হয়ো না।’ [সূরা আশ্ শুরা : ১৩]

সকল নবী-রাসূলগণ দ্বীন প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠা করেছেন, সর্বশেষ নবী মুহাম্মদকেও আল্লাহ্ তা‘আলা একই বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি সর্বপ্রথম এ দায়িত্ব দা’ওয়াত ইলাল্লাহ্ দিয়ে শুরু করেছেন। শুধু তিনিই নন, যারা তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন সেই সাহাবাগণও একই কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। আল্লাহ্ তা‘আলা আদেশ সূচক আয়াত নাযিল করে এ দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘আপনি বলুন! এটাই আমার রাস্তা, আমি আল্লাহর দিকে আহ্বান করি দলীল-প্রমাণ সাপেক্ষে এবং শুধু আমিই নয়, যারা আমাকে মেনে নিয়েছে, অনুসরণ-অনুকরণ ও আনুগত্য করেছে তারাও। পবিত্রময় সত্তা আল্লাহ্। আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’ [সূরা ইউসুফ : ১০৮]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে সব ধর্মাবলম্বী একত্রিত হয়েই তাঁর দাওয়াতি কাজের বিরোধিতা করেছে। তাঁকে গালি দিয়েছে, মিথ্যাবাদি, যাদুকর, জ্যোতিষী, কবি এবং পাগল ইত্যাদি বলে সামাজিকভাবে বয়কট করেছে, মক্কার অবৈধ নাগরিক বলে ঘোষণা করেছে। শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় শেয়াবে আবু তালেবের মধ্য্যে ৩ বছর আটক থাকতে হয়েছে। এ অবস্থায় গাছের পাতা, গাছের ছাল ইত্যাদি খেয়েও জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। বায়তুল্লাহর আঙ্গিনায় লাঞ্ছিত হয়েছেন, কখনো সিজদাবস্থায় আবু জাহল মাথায় আঘাত করে মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে দিয়েছে। এত কষ্ট দেয়ার পরও তিনি মক্কাবাসীদের প্রতি বিরক্ত হননি। বরং তাদের প্রতি রহমতের হাত প্রসারিত করে দিয়েছেন। আর মক্কা বিজয়ের পর সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।

সময়ের প্রয়োজনে সাধারণভাবে সাময়িক সমাজবিপ্লব হতেই পারে; কিন্তু একটা জাতির সব ব্যক্তি মানুষকে বিশ্বাস ও চরিত্রে আমূল বদলে দিয়ে ভেতর থেকে নতুন করে গড়ে তোলে জীবন-সমাজ-রাষ্ট্রবিপ্লব সাধন করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটি সার্থকতার সঙ্গেই করেছেন, বিশ্ববিপ্লবের সূচনা করে গিয়েছেন। আল্লাহর সাহায্যের পাশাপাশি মুখ্য যে কারণটি এর মূলে সক্রিয় ছিল, তা হলো রাসূলের বিন¤্র স্বভাব, সৃষ্টির প্রতি দয়া ও মানুষের জন্য মমতা। কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, ‘অতএব আল্লাহর অনুগ্রহেই তুমি তাদের প্রতি কোমলচিত্ত; যদি রুক্ষভাষী ও কঠোর হতে, তবে তারা তোমাকে ছেড়ে দূরে চলে যেতো।’ [সূরা আলে ইমরান : ১৪৯]

আসলে সৃষ্টির প্রতি দয়া আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা ইসলামের মূল শক্তি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুর্গত মানুষের সাহায্যকে সবচেয়ে বড় ইবাদাত বলেছেন। তিনি বলেছেন, যে প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে তৃপ্তির সঙ্গে খায়, সে মুসলমান নয়। তিনি আর্তজনের সেবা, অসুস্থকে দেখতে যাওয়া, বিপন্নকে উদ্ধার করা, ঋণগ্রস্তকে সাহায্য করা, অভাবী ও ইয়াতীমকে আশ্রয় দেয়া, প্রতিকারের শক্তি থাকা সত্তে¡ও শত্রæকে ক্ষমা করা ইত্যাদি মানবিক চরিত্রের পূর্ণতা সাধন করে গিয়েছেন।

নিন্মোক্ত বিষয়গুলির দিকে তাকালে আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দয়ার পরিধি আরো কত ব্যাপক তা বুঝতে পারি-
১. মানুষের প্রতি দয়া
জারির ইবনে আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না।’ [মুসলিম : ২৩১৯]

২. ছোটদের প্রতি দয়া
আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ নাতি হাসান রাদিআল্লাহু আনহুকে চুমু খেলেন। সে সময় তাঁর কাছে আকরা বিন হারেস রাদিআল্লাহু আনহু উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, আমি দশ সন্তানের জনক। কিন্তু আমি কখনও তাদের আদর করে চুমু খাইনি। তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যে দয়া করে না, তার প্রতিও দয়া করা হয় না।’ [ বোখারী : ৫৬৫১]

৩. দুর্বলদের প্রতি দয়া
বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘একদা আমি আমার এক দাসকে প্রহার করছিলাম, হঠাৎ আমার পিছন দিক থেকে শব্দ শুনতে পেলাম ঃ জেনে রাখ হে ইবনে মাসউদ! আল্লাহ তার পক্ষ হয়ে তোমার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে অনেক বেশি শক্তিশালী। আমি পিছনে লক্ষ্য করতেই দেখলাম, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! সে আযাদ, আমি তাকে মুক্ত করে দিলাম। উত্তরে তিনি বললেন, যদি তুমি এ কাজ না করতে তাহলে জাহান্নামের আগুন তোমাকে স্পর্শ করতো।’ [সহীহ মুসলিম]
৪. ইয়াতীমদের প্রতি দয়া

আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার অন্তরের কঠোরতার অভিযোগ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন, ইয়াতীমদের প্রতি সহানুভূতিশীল হও এবং গরীবদের আহার করাও।’ [আহমাদ]
৫. মিসকীনদের প্রতি দয়া

আবূ সাঈদ খুদরী রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা মিসকীনদের ভালবাস’। কেননা আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর দু‘আয় বলতে শুনেছি, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মিসকীন রূপে জীবিত রাখ, মিসকীন রূপে মৃত্যুদান কর এবং মিসকীনদের দলভুক্ত করে হাশরের ময়দানে উত্থিত কর।’ [ইবনু মাজাহ হা/৪১২৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩০৮]
৬. ঋণগ্রস্থের প্রতি দয়া

বুরায়দা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: যে ব্যক্তি কোন অভাবী ঋণীকে অবকাশ দিবে। তার বিনিময়ে প্রতিদিন সাদকার সাওয়াব পাবে। বুরায়দা বলেন, আমি রাসূল হতে আরো শুনলাম যে, যে ব্যক্তি কোন অভাবী ঋণীকে অবকাশ দিবে। সে প্রতিদিন দ্বিগুণ সাওয়াব পাবে। অতঃপর বুরায়দা বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি এমন কথা বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন অভাবী ঋণীকে অবকাশ দিবে। তাকে প্রতিদিন দ্বিগুণ সাওয়াব দেওয়া হবে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন; ঋণ পরিশোধের আগ পর্যন্ত প্রতিদিন সাদকার সাওয়াব পাবে, আর মাফ করে দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিদিন দ্বিগুণ সাওয়াব পাবে।’ [মুসনাদে আহমাদ : ২২৫৩৭] (চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন