ইসলাম মানুষের স্বভাব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল পরিপূর্ণ একটি জীবনবিধান। এর বিধানবলি যেমন সহজ সাবলীল, তেমনি তা সুষ্ঠূ রুচি সম্পন্ন বটে। এ ব্যবস্থা মানবজাতির দেহ ও মনের সুস্থ বিকাশ সাধনে সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছে। যারই প্রেক্ষিতে মানুষের জীবনে নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পাশাপাশি চিত্ত বিনোদনের ব্যাপারেও সঠিক ও যথার্থ নির্দেশনা পেশ করেছে। অত্র প্রবন্ধে বিনোদনের পরিচয়, এ ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি, ইসলাম প্রদত্ত বিনোদন ব্যবস্থার বৈশিষ্ঠ্য ও মূলনীতি এর সীমারেখা এবং রাসূল স. ও সাহাবা কিরাম রা. এর সময়কাল বিনোদনের বিভিন্ন ধরণ পদ্ধতি সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রবন্ধটি মূলত বর্ণনা ও বিশ্লেষন মূলক ধারায় সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রবন্ধটি থেকে ইসলাম অনুমোদিত বিনোদনের বিবরণ জানার পাশাপাশি ও সুস্থ ও রুচিশীল বিনোদনমূলক কর্মকান্ড চর্চা, এবং বিনোদনের নামে সমাজে প্রচলিত নানা অশ্লীল ও অনৈতিক কাজকর্ম বর্জনে অণুপ্রেরণা পাওয়া যাবে।
ইসলাম মানবজাতির জন্যে আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত সর্বজনীন ব্যবস্থার নাম। জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের রয়েছে ইসলাম প্রদত্ত সুন্দর, শাশ্বত কল্যানময় পথ নির্দেশনা। যেগুলো একদিকে যেমন মানবকল্যাণধর্মী, অন্যদিকে তা মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব ও চাহিদার অনুকূলে। এগুলো মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সাথে যেমন সম্পৃক্ত, তেমনিভাবে তা তার আধ্যাত্বিক জীবনকে ও পরিশুদ্ধ করে তোলে। এ অমোঘ বিধান তার জীবনকে যাবতীয় অশুচি, অসুন্দর ও অশালীন কথা, কাজ ও পরিবেশ থেকে পরিচ্ছন্ন, শালীন ও নির্মল করে তোলে। তবে ইসলাম মানব জীবনের সুখ দু:খ আনন্দ নিরানন্দ সর্বক্ষেত্রে একটি সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে। মানুষ দুঃখ যন্ত্রণা ও নানা প্রতিকূলতায় যেমন মানসিক চাপ অনুভব করে, তেমনি ভাবে নানা উৎসব অনুষ্ঠাণে একটু খুশি ও আমোদিত হয়ে মানসিক চাপমুক্ত হয়। দুঃখ দুর্দশায় ব্যথিত হওয়া কিংবা কারো মৃত্যুতে শোকাতুর হওয়া মানুষের স্বভাবজাত প্রবণতা। ইসলাম এটিকে অস্বীকার করে না; বরং নির্ধারিত সীমারেখা মেনে চললে ইসলামের দৃষ্টিতে এটি বৈধ। অন্যদিকে খুশি বা আনন্দ প্রকাশে ও ইসলাম সীমা ঠিক করে দিয়েছে, যা মেনে চলা একজন মুমিনের ঈমানের দাবি। এক কথায়, মানব জীবনের আদি অন্ত সবকিছুর ব্যাপারেই সুন্দর নির্দেশনা ইসলামে রয়েছে। এ হিসেবে মানুষের চিত্ত বিনোদনের বিষয়টি ও ইসলামে উপেক্ষিত নয়; বরং বিনোদন ব্যবস্থা সম্পর্কে ইসলাম মানব জাতির জন্যে খুবই সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ রীতিনীতি শিক্ষা দিয়েছে, যা নিঃসন্দেহে সুস্থ সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিনোদনের ব্যাপারে আমাদের সমাজে পরস্পর বিরোধী দুটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে। কেউ কেউ এর প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করেন এ যুক্তিতে যে, এতে অহেতুক মানুষের মূল্যবান সময়ের অপচয় হয় এবং তা মানুষের মাঝে নানারকম অন্যায় ও অশালীন প্রবণতা সৃষ্টি করে, ক্ষেত্রবিশেষ তা মানব চরিত্রকে কলুষিত করে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে যায়। এ কারণে বিনোদন মানুষের জন্য কোনো মতেই উপকারী কিংবা প্রয়োজনীয় হতে পারে না। বিপরীত পক্ষে দ্বিতীয় ধারণা মতেই বিনোদনমূলক কর্মকা মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতায় বিনোদনমূলক উপায় উকরণ গ্রহণ ও চর্চা বড়ই উপকারী, অনেক সময় তা মানুষের সামগ্রিক সুস্থতা ও জীবনের ভারসাম্য রক্ষায় আবশ্যিক হয়ে পড়ে। বর্তমানে বিনোদনের ব্যাপারে অনেক বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্গন পরিলক্ষিত হয়। বিনোদনের নামে অনেক ক্রিয়াকলাপ সংঘটিত হয়, যা একদিকে যেমন রীতি নৈতিকতা পরিপন্থী, তেমনিভাবে তা ইসলামের বিধি বিধানের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিকও। এতে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে নানা অনাচার ও অশ্লীল কর্মকান্ডের ব্যাপক প্রচলন ঘটে। সমাজে বহুরকম অরাজকতা ও আশালীনতার সয়লাব বয়ে যায়। তার কুপ্রভাবে মনুষ্যত্ব, মানবিকতা ও লজ্জাবোধ সমাজ থেকে লোপ পায়। সাথে সাথে তা সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে স্বস্তি, শান্তি ও নির্মলতার পরিবর্তে নানা অশান্তি, অস্তিরতা ও অবিশ্বাসের বীজ বপিত হয়। বিনোদনের নামে এ সব অনৈতিক কাজের চর্চার ফলে পারিবারিক জীবনে নেমে আসে আস্থাহীনতা ও অশান্তির কালোছায়া। ছিন্ন হয়ে যায় পারিবারিক বন্ধন। যুব সমাজ হয়ে উঠে মেধাহীন ও জ্ঞান চর্চার মহান ব্রত থেকে বিচ্যূত। এ কারণে একজন মুসলিম ব্যক্তির উচিত, কোন ধরনের বিনোদন ব্যবস্থা তার জীবনকে সুন্দর, শালীন ও শান্তিময় করবে, দূর করবে মনের অশান্তি, অস্থিরতা এবং জীবনকে করে তোলবে গতিময় তা যথার্থভাবে অবগত হওয়া। পক্ষান্তরে কোন ধরণের বিনোদন চর্চায় তার জীবনে নেমে আসবে অশান্তির অমানিমা তাও অবগত হওয়া উচিত। এক কথায় বিনোদানের ব্যাপারে ইসলাম উপস্থাপিত দিক নির্দেশনা ও বিধি বিধান মাধ্যমেই সম্ভব অসুস্থ ও রুচিহীন বিনোদনের করালগ্রাস থেকে নিজেকে এবং গোটা সমাজকে রক্ষা করা। যাতে সুস্থ ধারার বিনোদলমূলক কর্মকান্ড চর্চার মাধ্যমে জীবনের অবসাদ, ক্লান্তি ও হতাশা বিদূরিত করে জীবনকে সুখময় করা যায়। এর মাধ্যমে মানুষ সর্বপ্রকার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সজাগ ও সচেতন থাকতে পারে। সর্বোপরি ইসলাম প্রদত্ত বিনোদনের উপায়গুলো চর্চার মাধ্যমে মানুষ মহান আল্লাহ প্রদত্ত জীবনকে সুস্থ ও সবল রেখে তাঁরই ইবাদতে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারে। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে বিনোদনের পরিচয়, মানুষের জীবনের বিনোদনের প্রয়োজনীয়তা, সীমারেখা ও মূলনীতি প্রভূতি বিষয় তোলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
অভিধানিক দৃষ্টিতে বিনোদন এর বিভিন্ন অর্থ পরিলক্ষিত হয়। যেমন, সানন্দে কাল যাপন, কষ্ট অপনোদন, আমোদিত করণ, তুষ্টি সাধন ইত্যাদি। ইংরেজীতে বিনোদন বুঝাতে একাধিক শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন উরাবৎঃরড়হ [চিত্ত বিনোদন], জবপৎবধঃরড়হ [বিশ্রাম বিনোদন], ঝঢ়ড়ৎঃ [ক্রীড়া কৌতুক]
আরবীতে বিনোদনকে তাফরীহ বলা হয়। এর মূল অর্থ আনন্দ দান। মানুষ জীবন পরিক্রমায় নানাবিধ কাজ ও দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে। ফলে তাকে একটু বিশ্রাম বা আনন্দ উপভোগ করতে হয়। এভাবে কঠোর পরিশ্রমান্তে আত্মাকে সতেজকরণ ও নবশক্তি দানই হলো বিনোদন। আরবী ভাষায় বিনোদন বুঝাতে তারবীহ শব্দটি ও ব্যবহৃত হয়। এটি রাওহোন শব্দ থেকে নির্গত। এর অর্থ হলো আত্ম। সুতরাং বলা যায়, বিনোদন আত্মার সাথে সম্পর্কিত একটি বিষয়, যার মাধ্যমে তৈরি হবে আত্মার প্রশান্তি, মনের সতেজতা, হ্রদয়ে কর্মোদ্দীপনা, যা মানব মনের ক্লান্তি ও উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দূর করে, অবসন্ন মনকে প্রফুল্ল ও আমোদিত করে।
গবেষকগণ বিনোদনের বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উপস্থাপন করা হলো: “যা মানব মনকে ক্লান্তিমুক্ত করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করার মাধ্যমে মনকে প্রফুল্ল ও আমোদিত করে।” “বিনোদন হলো, ব্যক্তি অবসর সময়ে চর্চা করে এমন উপভোগ্য ইচ্ছামূলক কর্মতৎপরতা”। “বিনোদন হলো, খেলাধুলা ও আনন্দ উপভোগের বৈধ উপায়ে আত্মাকে আনন্দিত করা ও মনে প্রাণচঞ্চল সৃষ্টি করা। “মানুষের অবসর সময়কে এমন সুন্দরভাবে কাজে লাগানো, যা তার মাঝে শারীরিক ও চিন্তাগত নতুন শক্তি সঞ্চার এবং প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।”
উপর্যুক্ত ৩য় সংজ্ঞা থেকে বোঝা যায় যে, বিনোদনের যে সব ব্যবস্থা বা উপায় অবলম্বন বৈধ নয়, তা বিনোদন হতে পারে না। যেমন, সেসব বিনোদনমূলক কর্মকান্ড যা ব্যক্তির নিজের বা সামাজিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং যা দ্বারা বিনোদনের যে আসল উদ্দেশ্য তা অর্জিত হয় না।
অতএব, যে সব কর্মকান্ডে মনের অস্থিরতা বাড়ে,মানুষ হ্রদয়হীন হয় অথবা দায়িত্ব পালনের অনাগ্রহী হয়ে পড়ে কিংবা কর্মস্পৃহা হারিয়ে নেতিবাচক চিন্তায় জড়িয়ে পড়ে, তা বিনোদন হতে পারে না।
বিনোদনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাঃ বিনোদন মানব জীবনের প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। তা মানব প্রকৃতির স্বাভাবিক দাবি। এতে ব্যক্তির কাজে গতি ফিরে আসে, মানসিক চাপ কমে এবং জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলে। মানুষ কাজের ফাঁকে ফাঁকে যদি একটু আনন্দ বা বিনোদন লাভ করতে পারে, তাহলে তার পুরো জীবনটাই আনন্দময় হয়ে উঠে। পক্ষান্তরে মানুষ যখন কাজের ভারে নানা ভাবে জর্জরিত হয়ে অশান্ত ও অস্থির হয়ে উঠে, তখন তা তার জীবনকে দু:খ ভারাক্রান্ত করে তোলে। তাই অবসর সময়ে নির্ধারিত সীমারেখা মেনে বিনোদনমূলক কর্মকান্ডের চর্চা করা মানুষের জন্য খুবই দরকার। এক কথায়, মানুষের প্রশান্ত ও আনন্দ আহ্ল্লাদপূর্ণ জীবনযাপনে সুস্থ বিনোদনের গুরুত্ব অপরিসীম। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য জীবনের চেয়ে মানুষের রয়েছে স্বতন্ত বৈশিষ্ট্য। আক্বল ও মেধা মানুষকে করেছে অনন্য। বুদ্ধি ও চেতনায়, রুচি ও বৈশিষ্ঠ্য অন্যান্য সৃষ্টির ওপর মানব জাতরি শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- “নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের শক্তি দান করেছি, তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ দান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্টত্ব দান করেছি”।
মানবজাতিকে আল্লাহ তাআলা যে আক্বল তথা বোধশক্তি দান করেছেন, সে মেধা ও বিবেক বুদ্ধিকে বিকাশ করতে হলে প্রয়োজন সুস্থ রুচিসম্পন্ন ও মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল বিনোদন। সুন্দর বিনোদন ব্যবস্থা মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে অনেকাংশে সহায়ক ভূমিকা রাখে। সুস্থ ধারার বিনোদন মানুষের আত্মিক, মানসিক ও শারীরিক চাহিদার মাঝে সমন্বয় সাধন করে। মানুষ যদি শারীরিক ও মানসিকভাবে সবল ও সুস্থ না হয়, তাহলে তার জীবনে নানা অসংগতি ও বৈপরীত্য দেখা দিতে পারে। এ কারণেই মানব জীবনে বিনোদন প্রয়োজন, যা তার কর্মময় জীবনকে গতিশীল রাখবে। সাথে সাথে তা এনে দিবে আত্মার প্রশান্তি, বিবেকের সুস্থতা ও সচলতা এবং শারীরিক নিরাময়তা। একজন মুমিন ব্যক্তি যেন তার জীবনকে ভারসাম্য পূর্ণ করে ঢেলে সাজায়, এ জন্য রাসূলুল্লাহ স. মানুষকে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদের্শনা দিয়েছেন। রাসূল স. তাঁর সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনিল আছ রা.কে লক্ষ্য করে বললেন: নিশ্চয় তোমার শরীরের জন্য তোমার ওপর হক আছে, তোমার আত্মার জন্য তোমার ওপর হক আছে তোমার স্ত্রীর জন্য তোমার ওপর হক আছে।
উক্ত হাদিস থেকে বুঝা যায় যে, পরিবার পরিজনের প্রতি যেমন ব্যক্তির দায়দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি নিজ দেহ ও আত্মার প্রতি ও কিছু কর্তব্য তার ওপর অর্পিত আছে। দেহের যত্ন নেওয়া অনাকাঙ্কিত ক্ষতি থেকে অঙ্গ প্রতঙ্গকে রক্ষা করা, শরীরকে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম দেওয়া এসব কিছুই শরীরের হক হিসাবে গণ্য। অন্যদিকে আত্মাকে আনন্দ ও প্রফুল্ল রাখা, অহেতুক দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত রাখা আত্মার হকের মধ্যে পড়ে। কারণ, দুঃখ ও বিষন্নতা উদ্বেগ-উৎকন্ঠা ব্যক্তিকে গতিহীন করে, নানাবিধ হতাশা ও আশঙ্কায় জীনকে দুর্বিষহ করে তোলে। তাই প্রয়োজন সুস্থ বিনোদনের, যা মানুষের মাঝে প্রসন্নতা এনে দেবে। এ ক্ষেত্রে রাসূল স. এর শিখানো নিম্নের দুআটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। সাইয়িদুনা আনাস ইবনু মালিক রা. থেকে বর্ণিত রাসূল স, ইরশাদ করেন- হে আল্লাহ দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি থেকে আমি আপনার কাছে আশ্রয় কামনা করছি। (চলবে)
সুতরাং সুস্থ ও নির্মল বিনোদন মানুষের জন্য অত্যবশ্যক, যে বিনোদন ব্যবস্থায় থাকবে খুশি ও আনন্দ প্রকাশে শালীনতা, আনন্দ আহ্লাদ ও খুশি কিংবা রসাত্মক কথামালার মাধ্যমে মানুষের অবসর সময় উপভোগ ও উদযাপনের সুনির্দিষ্ট সীমারেখা। সুস্থ বিনোদনের মাধ্যমে মানুষের একগুয়েমি ভাব দূর হয় এবং তা মানুষকে সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন উদার ব্যক্তিরূপে গড়ে তুলে। সুস্থ বিনোদন চর্চার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে চিন্তাভাবনায় ইতিবাচক দিক সৃষ্টি হয়, হরেক রকম অশুভ ও আশালীন কাজের প্রবণতা দূর হয়। এককথায় মানুষের কর্মময় এ জীবনে আত্মিক সজীবতার জন্য বিশ্রাম ও বিনোদন খুবই প্রয়োজন। আজকাল মনোবিজ্ঞানীরা মানুষের সুস্থতার জন্য আনন্দ ও চিত্ত বিনোদনকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছেন। বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও আনন্দ ও চিত্ত বিনোদনকে ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অনেক মনোবিজ্ঞানী বলেছেন, চিত্ত বিনোদন, হাসি খুশি এমন এক অনৈচ্ছিক প্রতিক্রিয়া, যার ফলে মুখের ১৫টি মাংসপেশি একই সময়ে সংকুচিত হয় এবং দ্রæত শ্বাস প্রশ্বাস ঘটে। এছাড়াও মানুষ যখন হাসি ও প্রফুল্লতার মধ্যে সময় অতিবাহিত করে, তখন শরীরের রক্তপ্রবাহ দ্রæত সঞ্চালিত হয়। যার কারণে রক্তে এড্রেনালিন বেড়ে যায়। ফলে মানুষ সজীবতা ও আনন্দ অনুভব করে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন যে, মানুষ মানসিক উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা ও আবেগের ভারসাম্যহীনতার কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। এ হিসেবে আমরা বলতে পারি যে, মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য বিনোদনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।
বিনোদনের ধরন প্রকৃতিঃ বিনোদন বা আনন্দ উপভোগ মানুষ নানারূপ ও ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে করে থাকে। কখনো তা হয় ক্রীড়া কৌতুকে। আবার কখনো হয় অন্য রূপে। মানুষের স্বভাব প্রকৃতি সকলেই একই রকম নয়। নানা স্বাদ ও রুচি মানুষের মাঝে বিরাজ করে। মনের আনন্দ ও প্রশান্তি লাভ একটি আপেক্ষিক বিষয়। কেউ কোন জিনিস দেখে কিংবা সম্পাদন করে আনন্দ লাভ করে। আবার কারো কাছে হতে পারে একই জিনিষটি দুঃখ বেদনার। সুস্থ রুচিবোধের অভাবে মানুষ অনৈতিক কাজেও আনন্দ উপভোগ করলে তা কিন্তু বিনোদন বরং; তা হলো বিনোদনের নামে এক প্রকার নৈরাজ্য। বিনোদনের বহুবিধ মাধ্যম এমন রয়েছে, যা আত্মার প্রশান্তি ও মনের স্থিরতা বয়ে আনে না; বরং তা মনে উত্তেজনা সৃষ্টি করে মানুষকে মানসিকভাবে অস্তির করে তোলে। সাথে সাথে দেহ মনও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এতে মানুষ হয়ে পড়ে নীতিহীন। জীবনে নেমে আসে নান রক্ষম অবক্ষয় । প্রাশান্তির পরিবর্তে অস্থিরতা পেয়ে বসে। এ রকম কর্মকান্ড কোন মতেই বিনোদন হতে পারে না। বিনোদন হবে এমন যা মনকে প্রফুল্ল করে অন্তরে প্রশান্তি ও স্থিরতা ডেকে আনে। মানুষ জন্মের পর থেকেই আনন্দপ্রিয়। আনন্দময় জীবন লাভ তার স্বভাবের দাবি। মানুষ তারুণ্যে পদার্পণের সাথে সাথে আনন্দ উপভোগ বা বিনোদন যাপনের আগ্রহ বেড়ে যায়। বিনোদনের ধরন প্রকৃতি মানুষের রুচি, পরিবেশ ঐতিহ্য ও চিন্তা চেতনার আলোকে বিকশিত হয়। পরিবেশ দ্বারা মানুষ প্রভাবিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, (হে রাসূল) আপনি বলে দিন, প্রত্যেকই নিজ রীতি অনুযায়ী কাজ করে। অত:পর আপনার পালনকর্তা বিশেষরূপে জানেন যে, কে সর্বাপেক্ষা নির্ভূল পথে আছে।
এখানে শাকিলতুন শব্দের ব্যাখ্যায় স্বভাব, অভ্যাস, প্রকৃতি, নিয়ত, রীতি ইত্যাদি বিভিন্ন উক্ত বর্ণিত রয়েছে। সবগুলোর সারমর্ম পরিবেশ। অভ্যাস, প্রথা ও প্রচলনের দিক দিয়ে প্রত্যেক মানুষের একটি অভ্যাস ও মানসিকতা গড়ে উঠে। এ অভ্যাস ও মানসিকতা অনুযায়ী তার কাজ কর্ম হয়ে থাকে। এ আয়াতে মহান আল্লাহ মানুষকে সর্তক করেছেন যে, মন্দ পরিবেশ মন্দ সংসর্গ ও মন্দ অভ্যাস থেকে বিরত থাকা দরকার। মানব জাতির প্রতি আল্লাহ তাআলার অবারিত করুণা ও দয়ায় মানুষ সৃষ্টির সেরা হওয়ার গৌরব লাভ করেছে। এ হিসেবে মানুষের গতিবিধি অপরাপর কর্মকান্ড, আনন্দ আহ্লাদ এমন হওয়া উচিত, যা তার মর্যাদার সাথে সংঙ্গতিপূর্ণ। বিনোদন হবে শোভন, মনোহর ও সুস্থ রুচিসম্পন্ন এবং নৈতিকতার সীমারেখা মেনে শালীনতা বজায় রেখে। শুধু তাই নয় বিনোদনে চারিত্রিক মূল্যবোধ ও অটুট রাখা আবশ্যক। কারণ, মানুষের কাজকর্ম ও আনন্দ উপভোগ যদি নৈতিকতা না থাকে বরং চারিত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে, তাহলে মানুষের সব আয়োজন পাশবিকতার রূপ লাভ করবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণী বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি ইরশাদ করেন- শপথ প্রাণের এবং তিনি যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন তাঁর। অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম জ্ঞান দান করেছেন। যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয় এবং সে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়।
উপর্যুক্ত আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, মানুষের মাঝে আল্লাহর আনুগত্য ও নাফরমানী করার উভয়ই প্রবণতা বিরাজমান। মানুষ যখন নিজের সামগ্রিক বিষয়ে আল্লাহর আনুগত্য অবলম্বন করে নিজেকে পাপাচার থেকে বাঁচিয়ে রাখে, তখনই তার জীবন সফলতায় উন্নীত হয়। আত্মপরিশুদ্ধির জন্য রাসূল স. দু’ আ শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি যখন কুরআনের পবিত্র কুরআনের উপর্যুক্ত আয়াত তিলাওয়াত করতেন, তখন নিম্নোক্ত দু’আ পাঠ করতেন: হে আল্লাহ! আমার আত্মায় তোমার ভয় সৃষ্টি করে দাও! আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে দাও, আল্লাহ তুমিই সর্বোত্তম পরিশুদ্ধকারী, তুমিই তার বন্ধু এবং অভিভাবক। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন