কুতবুল আলম সুলতানুল আউলিয়া হযরত শাহ সুফি আলহাজ্ব মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মজিদ চাঁটগামী (রহ.);(প্রকাশ গারাংগিয়া বড় হুজুর কেবলা)। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে ২১ অক্টোবর শুক্রবার সকালে গারাংগিয়াস্থ নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ১৩১৪ হিজরি ১৩০১ বাংলা সনের মাঘ মাসে গারাংগিয়াস্থ নিজ বাড়িতে তাঁর জন্ম। তাঁর মহান পিতার নাম হযরত সুফি মুহাম্মদ আলা উদ্দিন মিয়াজী এবং তাঁর পূণ্যবতী মাতার নাম মুছাম্মৎ রাহাত জান বেগম মতান্তরে মোছাম্মৎ রাহাতুন্নেছা বেগম।
হযরত সুফি আলাউদ্দিন মিয়াজী একজন দুনিয়া বিমুখ সাধারণ জীবন যাপনকারী আল্লাহর ওলী ছিলেন। তাঁর বহু করামত রয়েছে। তিনি ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৩৫১ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। অপরদিকে, হযরত হুজুরদ্বয়ের আম্মাজান ইন্তেকাল করেন ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ১৩৫৭ হিজরি। উভয়ে গারাংগিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে চির নিদ্রায় শায়িত।
হযরত বড় হুজুর কেবলা নিজ বাড়িতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে পার্শ্ববর্তী মির্জাখীল গ্রামস্থ হযরত আবদুল লতিফ (রহ.) এর নিকট সকালে দ্বীনি শিক্ষা লাভ করতেন। সাথে সাথে মির্জাখীলস্থ হযরত শাহ সুফি মাওলানা আবদুল হাই (রহ.) এর নিকটও গমন করতেন ধর্মীয় জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির লক্ষ্যে।
অতঃপর বড় হুজুর পশ্চিম পটিয়ার শিকলবাহা মাদ্রাসায় কিছু দিন লেখাপড়া করেন। এরপর আরও উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্য চট্টগ্রাম মহানগরীর দারুল উলুম আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং তৎসংলগ্ন মোহসেনিয়া মাদ্রাসা (বর্তমান হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ) থেকে ফাজিল পাস করেন। ঐ সময় কৃতি ছাত্র বিধায় দারুল উলুম মাদ্রাসায় কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন। এরপর কামিল/টাইটেল পড়ার জন্য ভারতে গমনের উদ্যোগী হন। কিন্তু তিনি বাড়ির অভিভাবক বিধায় দূরে কোথাও চলে গেলে ছোট ছোট সন্তান-সন্ততি নিয়ে তাঁর পুণ্যবতী মাতা অসহায় অনুভব করে তাঁকে বারণ করেন। ফলে হুজুরের উস্তাদ মির্জাখীলস্থ হযরত ছাহেব কেবলা হুজুরকে পরামর্শ দেন ঘর বাড়ি, ছোট ছোট ভাই বোন ছেড়ে অতিদূরে টাইটেল পড়তে না গিয়ে ঘরের নিকট মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
ফলে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে গারাংগিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে গারাংগিয়া মাদ্রাসা আলিম মানের সরকারী স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে স্বীকৃতি লাভ করে ফাযিল । হযরত বড় হুজুর কেবলার ইন্তেকাল পরবর্তী হযরত ছোট হুজুর কেবলার প্রচেষ্ঠায় কামিল অনুমতি লাভ করে ১/৭/১৯৮১খ্রিস্টাব্দে এবং কামিল মঞ্জুরী লাভ করে ১/৭/১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের উত্তর প্রদেশের আজমগড়ী হযরত চট্টগ্রাম শহর থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের চুনতী তাশরীফ আনলে চুনতীর হযরত শাহ ছাহেব কেবলার দাদার বাড়ি ইউসুফ মঞ্জিলে আজমগড়ী হযরতের হাতে ত্বরীকতে দাখিল হন। সে হতে হযরত বড় হুজুর কেবলা মাদ্রাসার খেদমতের পাশাপাশি দেশে ও আজমগড় গমন করে আজমগড়ী হযরত এর সংস্পর্শে থেকে ত্বরীকতের উচ্চস্তরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। আজমগড়ী হযরত চট্টগ্রাম তাশরীফ আনলে তাঁর নিকটে থাকতে তৎপর থাকতেন। সাথে সাথে জীবনে বহুবার আজমগড় গমন করেছিলেন পীর ছাহেব কেবলার নিকটে সময় কাটাতে।
১৩৬৬ হিজরিতে আরাকানি হযরত সহ আজমগড় গমন করলে তথায় অবস্থানকালে আজমগড়ী হযরত হযরত বড় হুজুর কেবলাকে খেলাফত দানে ভূষিত করেন। ১৩৬৬ হিজরি অর্থাৎ ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে। খেলাফত লাভের পর আজমগড়ী হযরত এর নিদের্শে সেরহিন্দে হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.) এর যেয়ারতে গমন করেন। অতঃপর উভয়ে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরার পর থেকে হযরত বড় হুজুর কেবলা তাবলীগে ত্বরীকতের সফর শুরু করেন। অনেক সময় আরাকানী হযরত এর সাথেও সফর করেন।
হযরত বড় হুজুর কেবলা ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম হজ্বব্রত পালন করেন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ৪৯ জন সফর সাথী নিয়ে ছফিনায়ে মুরাদ জাহাজযোগে দ্বিতীয়বার হজ্বব্রত পালন করেছিলেন।
তিনি মাদ্রাসার খেদমতের পাশাপাশি তাবলীগে ত্বরীকতের খেদমতে দেশের বিভিন্ন স্থানে গমন করতেন। ফলশ্রুতিতে মাদ্রাসার মাধ্যমে যেমন অসংখ্য ছাত্র দ্বীনি ইলম লাভ করেছেন তেমনি ত্বরীকতে দাখিল হয়ে অসংখ্য লোক আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (স.) এর নৈকট্য লাভে সক্ষম হয়েছিলেন।
বড় হুজুরের দুনিয়াবিমুখ দৃষ্টিভঙ্গি,সুন্নতের উপর দৃঢ়তা,তাকওয়া-পরহেজগারীর কারণে দেশের সব আকিদার ধর্মীয় আলেমগণের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে যান। সর্ব আকিদার ধর্মীয় বিজ্ঞ ব্যক্তিত্বগণ তাঁর সাথে মোলাকাত করে দোয়াপ্রার্থী হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে গারাংগিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৭১/৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ৫০/৫২ বছর সর্ব মহলে হযরত সুপারিন্টেনন্ডেন্ট ছাহেব হুজুর হিসেবে পরিচিত হন। তখন তথা পাকিস্তান আমল পেরিয়ে বাংলাদেশ আমলের আশির দশক পর্যন্ত মাদ্রাসা প্রধানগণকে সুপারিন্টেনন্ডেন্ট বলা হত।
হুজুর জীবনে অসংখ্য যোগ্য ছাত্র রেখে যান। তেমনি ৭৮ জন ব্যক্তিত্বকে খেলাফত দানে ভূষিত করেন। তিনি সরাসরি অথবা তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় শতের কাছাকাছি সরকারী মঞ্জুরীকৃত মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তাছাড়া অসংখ্য ইবতেদায়ী মাদ্রাসা,ফোরকানিয়া মাদ্রাসা,এতিমখানা,মসজিদ,খানকাহ,হেফজখানা রয়েছে যা গণনা করা কষ্টসাধ্য।
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হযরত বড় হুজুর কেবলা চট্টগ্রাম শহরে তাশরীফ আনলে যে মুরীদের ঘরে অবস্থান করুক না কেন তথায় লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত। যেমনি ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার,শিক্ষাবিদ,ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা থাকত তেমনি বিভিন্ন আকিদার ধর্মীয় ব্যক্তিগণের সংখ্যা কম থাকত না। তখন প্রচার মাধ্যম অনুকূল ছিল না। কিন্তু বড় হুজুর চট্টগ্রাম শহরে তাশরীফ আনলেই লোকমুখে প্রচার হয়ে যেত। বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বা মুরীদের বাড়িতে তাশরীফ নিলে হুজুরের দোয়া পেতে শত শত লোক গিজগিজ করত। মাঝে মধ্যে ঢাকায় তাশরীফ নিলে সেখানেও একই অবস্থা দৃষ্টিগোচর হত।
হযরত বড় হুজুর কেবলার দীর্ঘদিনের ফসল স্নেহের ছোট ভাই হযরত ছোট হুজুর কেবলার নিকট গারাংগিয়া মাদ্রাসা প্রধানের দায়িত্বভার অর্পন করে দেন ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে। জীবনের শেষের দিকেও তাবলীগে ত্বরীকত তথা মানব কল্যাণে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৯৭৫/৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সফর জারি রেখেছিলেন। অতঃপর ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের ২১ অক্টোবর ৭ জিলক্বদ ১৯৩৭ হিজরি ৪ কার্তিক ১৩৮৪ বাংলা শুক্রবার সকালে গারাংগিয়াস্থ নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। ( ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ইন্তেকালের সময় হুজুরের বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। এইদিন বাদে আসর তাঁর প্রাণাধিক ছোট ভাই হযরত ছোট হুজুর কেবলার ইমামতিতে জানাযার পর গারাংগিয়া মাদ্রাসা মসজিদ সংলগ্ন দাফন করা হয়।
১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে মোবাইল ত ছিলই না ল্যান্ড টেলিফোনেরও সীমাবদ্ধতা ছিল। ঐ সময় হযরত বড় হুজুর কেবলার ইন্তেকালের সংবাদ বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিস্তৃত অঞ্চলে পৌঁছে যায়। সকাল ৯ টা বা ১০ টার মধ্যে মুরীদগণ মাইক ব্যবহার বের করে ইন্তেকালের সংবাদ প্রচার করতে থাকে।
দুপুরের দিকে গারাংগিয়ার পানে মানব ঢল শুরু হয়। কে কোন দিক দিয়ে গারাংগিয়া আসছে তার ইয়ত্তা নেই। দুপুর থেকে গারাংগিয়ায় সমাগম বাড়তে থাকে। এ সমাগম জনসমুদ্রে রূপ লাভ করে। গারাংগিয়া মাদ্রাসা ময়দান, মাদ্রাসার দালানাদি, রাস্তা, বাড়িঘরের উঠান, ঢলু খালের বালির চর,ঢলু খালের পূর্ব পাশের রাস্তা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। এ জনসমুদ্রের জানাযায় কত জিন্নাত, কত ফেরেশতা,কত মানব যোগদান করেছেন তার হিসাব মহান আল্লাহপাকের কাছে।
তাঁর মহান পীর আজমগড়ী হযরত বলে গেছেন;“ মেরে মজিদ কা খীমা ওয়াসী’ নজর আতা হে”। অর্থাৎ হযরত বড় হুজুর কেবলার মাঝে শরীয়ত ও ত্বরীকতের বিশালত্ব দেখতেছেন বলে পীর ছাহেব আজমগড়ী হযরত এ বাক্য বলেছিলেন। বাস্তবেই গারাংগিয়া বড় হুজুর কেবলার শরীয়ত কেন্দ্রীক ত্বরীকতের বিশাল আনজাম ভাববার বিষয়। তিনি সৃষ্ঠ অসংখ্য অতি উঁচুমানের আলেম, মুফতি, মুহাদ্দেস, সুফি, দরবেশ রেখে গেছেন-আরও রেখে গেছেন লক্ষ লক্ষ মুরিদ। শতের মত দাখিল থেকে কামিল পর্যন্ত বড় মাদ্রাসা বাদেও তাঁর ওসিলায় প্রতিষ্ঠিত কত মসজিদ, ফোরকানিয়া, খানকাহ, এতিমখানা ও হেফজখানা রয়েছে যা গণনা করে নির্ণয় করা সহজসাধ্য নয়। শুধু তাই নয়, হযরত বড় হুজুর কেবলার এত বেশি করামত রয়েছে যে, এই নিয়ে একাধিক গ্রন্থ রচনা করা যাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন