আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লার ১১টি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন পেতে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। শেষ মুহূর্তে এসে এখন প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে লবিং-তদবির-দৌড়ঝাঁপ-দেনদরবারে ব্যস্ত তারা। প্রভাবশালী নেতাদের বাসা-বাড়িতে এখন রীতিমত উপচে পড়া ভিড় করছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে ‘তুষ্ট’ করার জন্য হেন চেষ্টা নেই, যা তারা করছেন না। কুমিল্লায় কে হচ্ছেন নৌকা ও ধানের শীষের প্রার্থী সে দিকে তাকিয়ে আছে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
কুমিল্লার ১৭টি উপজেলা সমন্বয়ে গঠিত ১১টি সংসদীয় আসন। ৩০৮৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রায় ৬০ লাখ জনসংখ্যার প্রাচীন এ জেলা রাজনৈতিকভাবে কুমিল্লা উত্তর ও দক্ষিণে বিন্যস্ত। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ অন্য রাজনৈতিক দল থেকে কুমিল্লার ১১টি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে ইতিমধ্যে জমাও দিয়েছেন। সূত্র জানায়, এরই মধ্যে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের গ্রহণযোগ্যতা ও বিভিন্ন বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে খোঁজ খবর নিয়ে তালিকা করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে প্রেরণ করেছে। এদিকে প্রায় প্রতিটি আসনে উভয় দল ও জোটের একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী মাঠে রয়েছেন। এদের মধ্যে নতুন মুখও রয়েছে। তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা নিজ নিজ এলাকায় ফুরফুরে মেজাজে প্রচারণায় সরব হলেও মামলা-হামলার ভয়ে বিএনপির প্রার্থীরা অনেকটা নীরবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কুমিল্লা-১ : দাউদকান্দি ও মেঘনা উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়েছেন বর্তমান এমপি মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়া, দলের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সবুর, উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মাদ আলী মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন এখানে বিএনপি থেকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও তার ছেলে মারুফ খন্দকারও মনোনয়ন পত্র নিয়েছেন। তবে তিনি মামলায় বা আইনি জটিলতায় আটকে গেলে তার ছেলে ও দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মারুফ হোসেন প্রার্থী হতে পারেন বলে এলাকায় প্রচারণা রয়েছে।
কুমিল্লা-২ : হোমনা ও তিতাস উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়েছেন অধ্যক্ষ আবদুল মজিদ ও তিতাস উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান পারভেজ আলম সরকার। এ আসনে বিএনপি থেকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন মনোনয়ন নিয়েছেন এবং জাপার (এরশাদ) বর্তমান এমপি আমির হোসেন মনোনয়ন প্রত্যাশী।
কুমিল্লা-৩ : মুরাদনগর আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন নিয়েছেন বর্তমান এমপি শিল্পপতি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন, কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম সরকার। অপরদিকে, বিএনপির সাবেক মন্ত্রী কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, বিএনপি থেকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া মনোনয়পত্র নিয়েছেন।
কুমিল্লা-৪ : দেবিদ্বার আসনে আওয়ামী লীগ থেকে দলের কুমিল্লা উত্তর জেলা সহ-সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী এবিএম গোলাম মোস্তফা, বর্তমান এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুল, রোশন আলী মাস্টার। এখানে বিএনপি থেকে মনোনয়ন নিয়েছেন সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী, তিনি আইনি জটিলতায় আটকে গেলে তার স্ত্রী মাজেদা আহসান মুন্সীও মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন এবং জাতীয় পার্টি (এ) থেকে দলের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
কুমিল্লা-৫ : বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া নিয়ে গঠিত এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক আইনমন্ত্রী ও বর্তমান এমপি অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন স্বপন, আবদুছ ছালাম বেগ। এ আসনে বিএনপির সাবেক সাংসদ অধ্যাপক ইউনুস, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ, জসিম উদ্দিন, মিজানুর রহমান, ডাক্তার নজরুল ইসলাম শাহীন মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন।
কুমিল্লা-৬ : সদর উপজেলার এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে বর্তমান এমপি হাজী আ.ক.ম বাহাউদ্দিন বাহার, কেন্দ্রীয় কৃষকলীগের সহ-সভাপতি ও কুমিল্লা জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক মো. ওমর ফারুক, এফবিসিসিআই’র পরিচালক মাসুদ পারভেজ খান ইমরান, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি কবীর শিকদার মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। বিএনপি থেকে দলের কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পাদক ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার সাধারণ সম্পাদক হাজী আমিন উর-রশিদ ইয়াছিন।
কুমিল্লা-৭ : চান্দিনা আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ এবং দলের কুমিল্লা উত্তর জেলা সহ-সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। এখানে বিএনপির প্রার্থী হতে শাওন ও মফিজুল ইসলাম, কাজী শাখাওয়াত মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন। তবে এ আসনে ২৩ দলের শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী ড. রেদোয়ান আহমেদ মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন।
কুমিল্লা-৮ : বরুড়া আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি নাছিমুল আলম চৌধুরী নজরুল, কুমিল্লা জেলার শিল্প বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক মিয়াজী, জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক মো. কামরুল ইসলাম, বর্তমান এমপি জাতীয় পার্টির অধ্যাপক নুরুল ইসলাম মিলন মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। এখানে বিএনপি থেকে সাবেক এমপি ও দলের কেন্দ্রীয় কর্মসংস্থান বিষয়ক সম্পাদক জাকারিয়া তাহের সুমন, যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়ার সহসভাপতি মোতাজ্জুল করিম বাদরুল মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
কুমিল্লা-৯ : লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে বর্তমান এমপি মো. তাজুল ইসলাম, বিএনপি থেকে সম্ভাব্য প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক এমপি কর্নেল (অব.) আনোয়ারুল আজিম, দলের কেন্দ্রীয় শিল্প বিষয়ক সম্পাদক ও লাকসাম উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শিল্পপতি আবুল কালাম (চৈতী কালাম) মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন।
কুমিল্লা-১০ : নাঙ্গলকোট, সদর দক্ষিণ ও লালমাই এলাকা নিয়ে গঠিত এ আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি ও পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল) এবং কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক শিল্পপতি সালাহউদ্দিন আহমেদ মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। এখানে বিএনপি থেকে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক এমপি মো. মনিরুল হক চৌধুরী, সাবেক এমপি আবদুল গফুর ভূঁইয়া ও নাঙ্গলকোট উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোবাশ্বের আলম ভূঁইয়া মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন।
কুমিল্লা-১১ : চৌদ্দগ্রাম আসনে আওয়ামী লীগ থেকে রেলপথ মন্ত্রী বর্তমান এমপি ও দলের কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা সাধারণ সম্পাদক মুজিবুল হক মুজিব, বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের সভাপতি বজলুল রশিদ ভুলু, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা জসিম উদ্দিন। কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপি সহ-সভাপতি কাজী নাছিমুল হক নাছিম, চৌদ্দগ্রাম উপজেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক মো. কামরুল হুদা, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সভাপতি নিয়াজ মাখদুম মাসুম বিল্লাহ, পৌর বিএনপির আহ্বায়ক জি.এম তাহের পলাশী মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। এ আসনে ২৩ দলের শরিক জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতার সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান এইচ.এন.এম. শফিকুর রহমান, উপজেলা জাতীয় পার্টি সভাপতি আলহাজ খায়েজ আহাম্মদ ভূঁইয়া, চৌদ্দগ্রাম পৌর জাতীয় পার্টির সভাপতি রফিকুল ইসলাম মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা যায়। বর্তমানে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্র্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান করায় কেন্দ্র্র সরব হয়ে উঠলেও সংসদীয় আসনে নীরবতা বিরাজ করছে।
ফরিদপুরে দলীয় কোন্দলে
জর্জরিত মহাজোট
ফরিদপুর জেলা সংবাদদাতা : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ফরিদপুরের সবকটি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল চরমে। বিপদগামীতে আছে সাধারণ তৃণমূল নেতাকর্মীরা। অনেক নেতাকর্মীরা আছে আতঙ্কের মধ্যে। ভোটাররা কে কখন কার সাথে কথা বলবে তা নিয়েও চিন্তা ভাবনা করতে হয়। কার সাথে কথা বললে কেন নেতা অখুশি হবে এ নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছে দলীয় নেতাকর্মীরা। সবচেয়ে বেশী আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন সালথা-নগরকান্দার নেতাকর্মীরা।
ফরিদপুর -১ (সালথা-নগরকান্দা) আসনে সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নির্বাচনী আসন। এ আসনে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর দুই পুত্র আয়মন আকবর চৌধুরী ও শাহাদাব চৌধুরী লাবলু এই দুই ভাইয়ের গ্রুপিং-এর কারণে এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়ে অনেকই ফরিদপুর শহরে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এ পর্যন্ত সালথা, নগরকান্দায় প্রায় ১০ জন খুন হয়েছেন। দুই শতাধীক ঘরবাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। মামলা হয়েছে কয়েকশত। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এলাকাবাসীসহ সাধারণ জনগণ।
সালথার বাসিন্দা সামসুর রহমান জানান, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর দুই ছেলের ক্ষমতার লড়াইয়ে আমরা আজ নিঃস্ব। তিনি আরো বলেন, এদের নির্যাতন থেকে আমরা মুক্তি চাই। আমাদের নগরকান্দা সালথার সমস্যাগুলি প্রধানমন্ত্রীসহ উক্ত এলাকার আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাকর্মীরা অবগত থাকা সত্বেও আমাদের প্রতি কেউ সহানুভ‚তি দেখাননি।
অপরদিকে, ফরিদপুর ৪ (ভাঙ্গা-চরভদ্রাসন-সদরপুর) এ আসনেও দলীয় কোন্দলের কারণে নেতাকর্মীরাও দিশেহারা। (আলফাডাঙ্গা-মধুখালী-বোয়ালমারী) আসনটিতে বর্তমান সাংসদ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান। তিনি তার ক্ষমতাবলে ব্যাপক উন্নয়ন করলেও দলের কিছু সুবিধাবাদী লোক তাকে অসাধু বানিয়ে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন উপজেলার তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি যেন মনোনয়নপত্র না পান এ বিষয়েও একাধিক নেতাকর্মীরা যৌথভাবে মিছিল মিটিং করে বেড়াচ্ছেন। এ বিষয়গুলো মেনে নিতে পারছেন না আলফাডাঙ্গা, মধুখালী ও বোয়ালমারী আওয়ামীলীগের সাধারণ নেতাকর্র্মীরা। এ দলীয় কোন্দলের কারণে এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রভাব পড়তে পারে বলে জানান সাধারণ আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন