হেভিওয়েট প্রার্থীদের নিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আসন্ন নির্বাচনী আলোচনা ধীরে ধীরে জমতে শুরু করলেও এখনো দুই প্রধান জোটেই একাধিক প্রার্থী নিয়ে বিভ্রান্ত মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মী থেকে আমজনতা। অপরদিকে নির্বাচন কতটা কলুষমুক্ত হবে তা নিয়েও জোর জল্পনা-কল্পনা দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে। সরকারী মহাজোট এবার পর্দা সরিয়ে জাতীয় পার্টিকে নিজের জোটে অন্তর্ভুক্ত করে কতটি আসন নিজেরা রাখবে, আর কতটি বিরোধী জোটকে দেবে এসব আলোচনাও শুরু হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলে। আসন্ন সংসদেও কি জাতীয় পার্টিকে ঘরের বিরোধী দলের মর্যাদা দেয়া হবে, নাকি অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে যে ফলাফল হয় তাই মেনে নেবে সরকারী দল, তাও অন্যতম আলোচিত বিষয় এ অঞ্চলে।
মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে জাতীয় পার্টির রুহুল আমীন হাওলাদার ও মাসুদ পারভেজ এবং বিএনপির গোলাম মাওলা রনির মনোনয়নপত্র বাতিল সত্তে¡ও দুই জোটে প্রায় প্রতিটি আসনে একাধিক প্রার্থী রয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রায় চূড়ান্ত করার পরেও এখনো যারা আছেন, তারা সব বিদ্রোহী প্রার্থী বলে দাবি দলের দায়িত্বশীলদের। আর বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের যেসব বিকল্প প্রার্থী এখনো রয়েছেন, তারা দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্ধারিত দিনের আগেই সরে যাবেন বলে বলা হচ্ছে। তবে বিষয়টি নিয়ে পরিপূর্ণ আশ্বস্ত নন মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। জনমনেও বিভ্রান্তি ও কৌতূহল রয়েছে।
আমীর হোসেন আমু, তোফায়েল আহমদ, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, আ স ম ফিরোজ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, মুজিবুর রহমান সারোয়ার, জহিরুদ্দিন স্বপন, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন, সেলিমা রহমান, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর ও বিএইচ হারুনসহ আরো বেশ কয়েকজন নামি-দামি নেতা এবারো দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। এসব নেতা অতীতেও সংসদে দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন একাধিকবার। আসন্ন নির্বাচনে এসব তারকা-প্রার্থীদের নিয়ে ইতোমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়েছে।
আমীর হোসেন আমু ১৯৯১-এর নির্বাচনে ঝালকাঠী ও পিরোজপুর-বরিশালের দুটি আসনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে হেরে যান। তবে ১৯৯৮ সালে দল ক্ষমতায় থাকাকালীন ঝালকাঠী-২ আসনের উপ-নির্বাচনে তিনি মরহুম এমপি জুলফিকার আলী ভুট্টোর স্ত্রী ইসরাত জাহান ইলেন ভুট্টোকে প্রায় ৬০ হাজার ভোটে পরাজিত করে সংসদ ভবনে প্রবেশ করেন। কিন্তু ২০০১-এর নির্বাচনে ইলেন ভুট্টোর কাছেই প্রায় ৬৮ হাজার ভোটে পরাজিত হন আমুু। আবার ২০০৮-এর নির্বাচনে প্রায় ২২ হাজার ভোটে ইলেন ভুট্টোকে পরাজিত করেন আমু। ২০১৪-এর নির্বাচনে তার কোন প্রতিদ্ব›দ্বী ছিল না। এবারো তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থী। আর বিএনপি প্রার্থী রয়েছেন ইলেন ভুট্টো ছাড়াও জেবা আমীন খান। ফলে দলীয় কর্মীরা এখন বিব্রত।
ভোলায় তোফায়েল আহমদ নিজ বাড়ী ভোলা-২ আসনটি ছেড়ে জেলা সদরের এক নম্বর আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এবার। ’৯১-এর নির্বাচনে এ আসনে তোফায়েল আহমদ জাপা প্রার্থী নাজিউর রহমানের অনুপস্থিতিতে তাকে ৫ হাজার ভোটে এবং ভোলা-২ আসনে ১৫ হাজার ভোটে পরাজিত করেন। ’৯৬ সালে ভোলা-১ আসনে বিএনপি প্রার্থী মোশাররফ হোসেন শাহজাহানকে ৩ হাজার ভোটে এবং দুই নম্বর আসনে বিএনপি’র হাফিজ ইব্রাহিমকে ৮ হাজার ভোটে পরাজিত করেন। তবে ২০০১-এর নির্বাচনে তোফায়েল আহমদ ভোলা-১ আসনে বিএনপি প্রার্থী মোশাররফ হোসেন শাহজাহানের কাছে প্রায় ৩৮ হাজার ভোটে, নিজ বাড়ীর দুই নম্বর আসনে বিএনপি প্রার্থী হাফিজ ইব্রাহিমের কাছে প্রায় ২৯ হাজার ভোটে এবং ভোলা ৩ নম্বর আসনে বিএনপি’র মেজর (অব.) হাফিজের কাছে প্রায় ৪৮ হাজার ভোটে পরাজিত হন। ২০০৮-এর নির্বাচনে তোফায়েল আহমদ পুনরায় নিজ বাড়ীর ভোলা-২ আসনে সীমাবদ্ধ থেকে বিএনপি’র বিকল্প প্রার্থী আশিকুর রহমানকে ২৫ হাজার ভোটে পরাজিত করেন। এবার তিনি শুধু ভোলা-১ আসনেই সীমাবদ্ধ আছেন। প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী ঐক্যফ্রন্টের বিজেপি প্রার্থী আন্দালিব রহমান পার্থ ও বিএনপির গোলাম নবী আলমগীর। শেষ পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী কে থাকেন তার ওপরই তোফায়েল আহমদের ভাগ্য নির্ভরশীল হতে পারে। তবে নির্বাচন কতটা অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে তার ওপরই বিষয়টি নির্ভরশীল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।
বরিশাল-১ আসনে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর প্রতিদ্ব›দ্বী বিএনপি’র দুই প্রার্থী সদ্য ঘরে ফেরা জহিরুদ্দিন স্বপন ও ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবাহান। ১৯৯১ ও ’৯৬-এর নির্বাচনে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ বিএনপি প্রার্থী কাজী গোলাম মাহবুবকে যথাক্রমে ৭ হাজার ও ২ হাজার ভোটে পরাজিত করেন। ঐ দুটি নির্বাচনেই জামায়াত প্রার্থী প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ভোট পায়। তবে ২০০১-এর নির্বাচনে হাসনাত প্রায় ১৪ হাজার ভোটে বিএনপি প্রার্থী জহিরুদ্দিন স্বপনের কাছে হেরে যান। একাধিক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে পলাতক থাকায় ২০০৮-এর নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে না পারলেও ২০১৪-এর ভোটার ও প্রতিদ্ব›দ্বীহীন নির্বাচনে তিনি পুনরায় বরিশাল-১ আসনে এমপি হন। এবারো তিনি প্রার্থী।
রাশেদ খান মেননের বোন সেলিমা রহমান তার পৈত্রিকভূমী বরিশাল-৩ আসনে এবারো প্রার্থী। এখনো প্রতিদ্ব›দ্বী মহাজোটের দুই শরিক দলের দুই টিপু। মহাজোটের পক্ষ থেকে এ আসনটি ওয়ার্কার্স পার্টিকে ছেড়ে দেয়ায় দলের প্রার্থী বর্তমান এমপি টিপু সুলতান। কিন্তু জাতীয় পার্টি থেকেও সাবেক এমপি গোলাম কিবরিয়া টিপুও প্রার্থী। অপরদিকে বিএনপি থেকেও সুপ্রিীম কোর্ট বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিনকেও মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। ২০০৮-এর নির্বাচনে ঐ আসনে সেলিমা রহমান ৬০ হাজারের বেশি ভোট পেলেও ৬ হাজারের ব্যবধানে হেরে যান। দলের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়নুল আবেদিন ঐ নির্বাচনে ২০ হাজারেরও বেশি ভোট পেয়েছিলেন।
পটুয়াখালী-১ আসনে এবারো বিএনপি প্রার্থী সাবেক মন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও তার স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার চৌধুরী। আলতাফ চৌধুরী ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী শাহজাহান মিয়াকে ১৫ হাজার ভোটে পরাজিত করেন। তবে ২০০৮-এ শাহজাহান মিয়ার কাছেই প্রায় ২২ হাজার ভোটে পরাজিত হন। এবার তিনি ঐ আসনে দলের প্রার্থী। তবে গত এক দশকে সরকারী প্রশাসন যন্ত্রের নানা অনৈতিক কর্মকান্ডে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের মত পটুয়াখালীতেও বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা ততটা মজবুত না থাকায় এ স্বল্প সময়ে আলতাফ চৌধুরী কতটা কী করতে পারবেন তা এখনো বলা যাচ্ছে না।
ঝালকাঠী-১ নম্বর আসনে মহাজোট থেকে এবারো প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান এমপি বিএইচ হারুন। তিনি ২০০১-এর নির্বাচনে ২০ হাজার ৪১৩ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থান লাভ করলেও ২০০৮-এ ২১ হাজার ভোটে বিএনপি প্রার্থী সাবেক এমপি শাহজাহান ওমরকে পরাজিত করেন। ২০১৪-এর ভোটার ও প্রতিদ্ব›দ্বীবিহীন নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে এবারো তিনি আওয়ামী লীগসহ মহাজোট প্রার্থী। তবে তার আসনে বিএনপির বিকল্প প্রার্থী ছাড়াও মহাজোট শরিক জাতীয় পার্টি, জেপি এবং ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী রয়েছেন।
পটুয়াখালী-২ আসনে মহাজোট প্রার্থী আওয়ামী লীগের আ স ম ফিরোজের অন্যতম প্রতিদ্ব›দ্বী বিএনপির সাবেক এমপি শহিদুল আলম তালুকদারের মনোনয়পত্র বাতিল হবার পর তার স্ত্রী প্রতিদ্ব›িদ্বতায় টিকে আছেন। তবে ঐ আসনে আ স ম ফিরোজের অন্যতম প্রতিদ্ব›দ্বী তার নিজ দলেরই অপর প্রার্থী কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সম্পাদক সামসুল হক রেজা। আ স ম ফিরোজ ১৯৯১ ও ’৯৬-এর নির্বাচনে বিজয়ী হলেও ২০০১-এর বিএনপি প্রার্থী সহিদুল আলমের কাছে ১৭ হাজার ভোটে পরাজিত হন। ২০০৮-এর নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীকে প্রায় ৪০ হাজার ভোটে পরাজিত করে প্রথমে হুইপ এবং ২০১৪-এর ভোটারবিহীন নির্বাচনে আবারো এমপি হয়ে চীফ হুইপ-এর দায়িত্ব পালন করছেন।
পিরোজপুর-২ আসনে ১৯৯১ এবং আগে-পরের সবগুলো নির্বাচনেই আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এমপি নির্বাচিত হয়ে আসছেন। তবে এবার তার আসনটির সাথে ইন্দুরকানী উপজেলা যুক্ত হওয়ায় কিছুটা দুশ্চিন্তা সৃষ্টি হতে পারে তার জন্য। জামায়াতের দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পুত্র শামীম সাঈদী ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে এবার মঞ্জুর প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী। তিনটি উপজেলা নিয়ে গঠিত পিরোজপুর-২ আসনে ভান্ডারিয়ার ভোট আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জন্য সংরক্ষিত ধরে নেয়া হলেও কাউখালীর ভোট প্রায় অর্ধেকই ভাগ হবার সম্ভাবনা রয়েছে। অপরদিকে ইন্দুরকানীর সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম সাঈদী সেখানকার সিংহভাগ ভোট লাভ করলে মঞ্জুর জন্য যথেষ্ট দুশ্চিন্তা কাজ করবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।
তবে এসব কিছুই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের পরিপূর্ণ পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। সে ব্যাপারে জনমনে এখনো আস্থার যথেষ্ট সঙ্কট রয়েছে বলে মনে করছেন মহলটি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন