মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

তারুণ্যের প্রত্যাশা এবং একাদশ নির্বাচনী ইশতেহার

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১২ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

ফাইল ফটো


একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের মাইলফলক কাল হিসেবে প্রত্যাশা করেছিল দেশের তরুণ সমাজ। ঐক্যফন্টের সাথে সংলাপে কোন রাজনৈতিক সমঝোতা না হওয়ায় তা শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে। তারপরও এক জটিল বাস্তবতায় দেশের সব রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীনদের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বিএনপির শীর্ষনেতা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে, বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশের বাইরে রেখে এবং বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মীর উপর হাজার হাজার মামলার খড়গ নিয়ে চলমান নির্বাচনী কার্যক্রমে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট প্রচারনায় একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। সরকারের সাজানো নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমের সমন্বিত আয়োজনে অসমতল নির্বাচনী মাঠে খেলা একতরফা হতে বাধ্য। এ দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ এমন নির্বাচন আর চায়না। বিশ্বের যে সব দেশ বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার অংশীদার, যারা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দেখতে চায় পশ্চিমা বিশ্বের সে সব দেশও বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে একটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়। মূলত ১৯৯৪ সাল থেকেই প্রতিটি নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা এবং স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে। সরকার এবং প্রধান বিরোধিদলের মধ্যে আপস ও সমঝোতা না হওয়ায় তা সফল হয়নি। নব্বইয়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিন জোটের রূপরেখা অনুসারে নির্বাচনকালীন তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল একটি অস্থায়ী বা সাময়িক ব্যবস্থা। তদস্থলে একটি স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার কোন বিকল্প নাই। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন সমঝোতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন ১৯৯৪ সালে কমনওয়েল্থ মহাসচিবের বিশেষ দূত, এক সময় অস্ট্রেলিয়ার গর্ভনর জেনারেল স্যার নিনিয়ান স্টেফান বিএনপি ও আওয়ামীলীগের মধ্যে সংলাপে মধ্যস্থতাকারীর ভ‚মিকা পালন করে কোন সমঝোতায় পৌছাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো দুই দলের মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতার উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছেন। গত ২ দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক জটিল, বড় বড় রাজনৈতিক সমস্যা বিবদমান দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে নিরসন হওয়ার বেশ কিছু দৃষ্টান্ত রয়েছে। এর মধ্যে তিউনিসিয়ায় গণআন্দোলনের মুখে ২৩ বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসক জাইন উদ্দিন বেন আলী দেশ চেড়ে পালানোর পর সেখানে যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছিল যা ক্রমশ একটি গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছিল, সে অবস্থা থেকে দেশকে রক্ষা করতে প্রথমে ট্রুথ এন্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করে একটি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন সে দেশের সরকার। এরপরও যখন শান্তি ও সহাবস্থানের সমঝোতায় পৌঁছাতে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হচ্ছিল তখনি বিশেষ ভ‚মিকা নিয়ে এগেই আসে সে দেশের ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধি, লেবার অর্গানাইজেশন, মানবাধিকার সংস্থা এবং আইনজীবী ও নাগরিক সমাজের নেতৃবন্দ। চারটি সংগঠনের প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত ‘তিউনিসিয়ান ডায়ালগ কোয়ার্ট্রটে’ নামে পরিচিতি লাভ করা এই উদ্যোগ অবশেষে দেশে শান্তি ও বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সহাবস্থান নিশ্চিত করতে সফল হয়। এই কৃতিত্বের জন্য ২০১৫ সালে ‘তিউনিসিয়ান ডায়ালগ কোয়োর্ট্টেটকে’ নোবেল পুরস্কারে ভ‚ষিত করা হয়। আমরা দক্ষিন আফ্রিকার রাজনৈতিক সংকটের সমাধানের ইতিহাস জানি, শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ অবসান এবং রাজনৈতিক সমঝোতার ইতিহাসও আমাদের জানা আছে। জনসংখ্যা এবং ভ‚-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সভ্য হিসেবে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই তিউনিসিয়া বা শ্রীলঙ্কার চেয়ে কম গুরুত্ব বহন করেনা। তা’ ছাড়া যে দেশ বৈষম্যহীন সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পথ ধরে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাখো প্রাণের বিনিময় স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সে দেশের মানুষ দশকের পর দশক ধরে বিভক্তি, বৈষম্য ও অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাধীনে থাকতে পারে না। এ দেশের নতুন প্রজন্ম দীর্ঘদিন ধরেই একটি পরিবর্তনের প্রত্যাশা করছে।
রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার পথ ধরে আসা এক-এগারো সরকারের নানামাত্রিক ভেল্কিবাজির নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নাকি দেশিবিদেশী কুশীলবদের গোপণ সমঝোতার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই গোপণ সমঝোতা এক সময় আর গোপন থাকেনি। সাবেক মার্কিন ফাস্টলেডি ও ফরেন সেক্রেটারী হিলারী ক্লিন্টন এবং ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিসহ নানাজনের লেখা ও বক্তব্য থেকে সে সব বিষয় জানতে পেরেছে জনগন। অর্থাৎ ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ক্ষমতারোহণ ছিল একটি দেশি-বিদেশি সমঝোতার ফসল! সে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে ভরাডুবির শিকার বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা অনির্বাচিত সরকারের চেয়ে নির্বাচিত সরকারের গ্রহণযোগ্যতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। গোপণ সমঝোতা বা যাই হোক, নির্বাচনটি সংঘটিত হয়েছিল সেনাবাহিনীর প্রভাবাধীন বিশেষ সরকার ও তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এ কারণেই সে নির্বাচন নিয়ে তেমন কোন রাজনৈতিক বিতর্ক হয়নি। তবে ১৯৯৬ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের আগে যে তত্বাবধায়ক সরকারের দাবী আদায়ের জন্য আওয়ামীলীগ শতাধিক দিন হরতাল করেছিল, সংসদ থেকে পদত্যাগ করে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছিল এবং অবশেষে বিএনপি তাদের দাবী মেনে ১৫ ফেব্রæয়ারীর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদে নির্বাচনকালীন তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান সংযুক্ত করে মাত্র তিনমাসের মধ্যে সংসদ ভেঙে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছিল। তখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সব সংস্থার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সরকারী বাহিনীর শক্তি দিয়ে মোকাবেলা ও নির্মূলের ঘটনা ঘটেনি। এর মধ্য দিয়েই দেশে নির্বাচনকালীণ অনিশ্চয়তা এবং জ্বালাও পোড়াও রাজনীতির পরিসমাপ্তি ঘটবে বলে দেশের মানুষ প্রত্যাশা করেছিল। বিশ্বের সব দেশেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে, তারা জনগণের জানমালের নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও সাংবিধানিক-গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় তাদের আইনগত ক্ষমতা ও শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় করে থাকে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে গত সপ্তাহে ফ্রান্সের রাজধানীতে বড় ধরনের সংঘাতপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হতে দেখা গেছে। বিক্ষোভকারীরা রাস্তা অবরোধ করেছে, গাড়ীতে আগুন দিয়েছে। তাদেরকে সরাতে পুলিশ শক্তি প্রয়োগ করলেও তা এমন নয় যে শত শত মানষকে আহত করা হয়েছে। রাস্তায় গাড়ী পোড়ানোর মামলা দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে আসামী ও ধরপাকড় করে ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করা হয়নি। নাশকতা ও অপ্রীতিকর ঘটনার পরও জনগনের ন্যায্য দাবীর প্রতি সম্মান জানিয়ে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে ফ্রান্স সরকার। উন্মুক্ত সেটেলাইট মিডিয়া, তথ্যপ্রযুক্তির কল্যানে বিশ্বের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তাৎক্ষনিকভাবেই জানতে পারছি আমরা। এ ক্ষেত্রে এ দেশের তরুন সমাজের দৃষ্টি অনেক বেশী সজাগ ও সক্রিয়। বিশ্ব্রে অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে আমাদের দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনী সংস্কৃতির ব্যাপক পার্থক্য দেখে আমাদের নতুন প্রজন্ম ক্রমে হতাশ ও রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ছে। বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার আক্ষেপ রয়ে গেছে সে সময়ের প্রায় দেড়কোটি নতুন ভোটারের। এবারের নির্বাচনে সে সংখ্যা আরো প্রায় এককোটি বেড়েছে।
প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দেশে সর্বমোট প্রায় ১০ কোটি ৪২ লাখ ভোটারের মধ্যে ২২ শতাংশ ভোটারের বয়েস ১৮ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। এদের অর্ধেকই এবার নতুন ভোটার, বাকিরাও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। এবারের নির্বাচনে প্রায় আড়াই কোটি নতুন ভোটার রাষ্ট্রযন্ত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চলেছেন বলে নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এরা নিজের ভোট নিজ হাতে দিয়ে সেই পরিবর্তনে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে অংশ নিতে চান। এর ব্যত্যয় হলে নিশ্চিতভাবেই তারা ভোটের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অংশ নিবে। বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা তাদের ৭ দফা দাবী ও ১১ দফা লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে সে আন্দোলনের অংশ হিসেবেই তারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে বলে তারা ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হলে আবারো সর্বাত্মক আন্দোলনে নামবে ২৩দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সামগ্রিক বিচারে নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ ও জনমতের প্রতিফলনযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। শুধুমাত্র ভোটের দিনে শান্তিপূর্ণভাবে ভোটদানের পরিবেশ থাকলেই তাকে গণতন্ত্র বলা যায় না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একটা বহুমাত্রিক বিষয়। যেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষীণ, যেখানে নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং জনপ্রশাসন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নয়, যেখানে একপক্ষের প্রার্থীরা অঢেল টাকাপয়সা নিয়ে সরকারী সুযোগ সুবিধা করায়ত্ব রেখে ভোটের মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, অন্যপক্ষ হাজার হাজার মামলায় জর্জরিত হয়ে তখনো কেউ জেলে, কেউ আদালতে দৌড়ঝাঁপে ব্যস্ত থেকেই নির্বাচনের মূল্যবান সময় পার করছেন। এমন অসমতল মাঠে কোন উপভোগ্য খেলা না জমলেও মানুষ সুযোগ পেলে এই অগণতান্ত্রিকতা ও অসমতার জবাব ব্যালটেই দিবে। বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা সেই বিরল সুযোগের অপেক্ষায় নির্বাচনী বৈতরণীতে উঠেছেন। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলনের সম্ভাবনা নেই বললেও চলে। এমনকি পাকিস্তানের সামরিক শাসন ইয়াহিয়া খানের অধীনেও এ দেশের মানুষ ভোট দিয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর আমরা যখন উন্নয়নের বাহবা কুড়াতে চাচ্ছি, তখন দেশের মানুষের উপর নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা ভীতিকরভাবে চেপে বসেছে। জনগণ ভোটের অধিকারের মত মৌলিক অধিকার নিয়ে শঙ্কিত-সন্ত্রস্ত বোধ করছে। তথ্য ও সামাজিক যোগাযোগ প্রযুক্তির হাত ধরে গত দুই দশকে মানুষের মনোজগতে এক ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। দেশের তরুণ সমাজ এখন গণতান্ত্রিক বিশ্বের নির্বাচন, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অধিকারের আন্দোলন সম্পর্কে যথেষ্ট খোঁজ খবর রাখছে। নিজ দেশের অবস্থা দেখে তারা ক্রমশ হতাশ ও হতদ্যোম হয়ে পড়ছে। সরকার দেশকে মধ্য আয়ের দেশের স্তরে নিয়ে যেতে চলেছে বলে ব্যাপক প্রচার হলেও গত ৫ বছরে দেশে শিক্ষিত বেকারের হার আগের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে। কর্মসংস্থান না থাকায় বেকার তরুণরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আগের মত রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম ও সেশসজটের সমস্যা না থাকলেও প্রতিবছর ক্রমবর্ধমান হারে হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে চলে যাচ্ছে। দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান না থাকলেও বছরে দেশ থেকে লক্ষকোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোম ও বিনিয়োগ করে সেখানে ‘মন্ত্রীপাড়া, ‘বেগম পাড়া’ ইত্যাদি নামের নিজস্ব জগত গড়ে তুলেছেন। অর্থাৎ তরুণ শিক্ষার্থী, বেকার যুবক, লুটেরা আমলা, ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিবিদরা পর্যন্ত এখন দেশে নিরাপদ বোধ করছেন না। দেশকে এমন অনিরাপদ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে কাঙ্খিত উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি নির্মান করা সম্ভব নয়। তরুন প্রজন্ম দেশকে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। নির্বাচনের ইশতেহারে সে প্রত্যাশার প্রতিফলন যেমন দেখতে চায়। নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষপাতমুক্ত এবং কালোটাকার প্রভাবমুক্ত, অবাধ নির্বাচনী পরিবেশ সে প্রত্যাশার প্রথম সোপান বলে বিবেচিত হচ্ছে।
ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত মহাজোট ও ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারের খসড় থেকে এবারের নির্বাচনে কারা কিসের উপর জোর দিতে চাচ্ছে তা কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। মহাজোট বিগত নির্বাচনে নতুন প্রজন্মের কাছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শ্লোগান তুলে ধরেছিল। তবে নতুন প্রজন্ম ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার চাইতে নিরাপদ বাংলাদেশ দেখতে চায়। নিরাপদ সড়কের দাবীতে গত আগস্টে দেশের লাখ লাখ কিশোর-তরুন যখন রাজপথে নেমে এসেছিল তাদের প্লাকার্ডে সে প্রত্যাশা ফুটে উঠেছিল। তারা রাষ্ট্রের মেরামত চেয়েছে। নিজেরাই রাস্তায় নেমে জাতির সামনে রাষ্ট্রের ভিআইপিদের অনিয়ম-দুর্নীতির মুখোশ উন্মোচিত করে দিয়েছিল। আমরা বলি, এরা ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্ম।ওরাই নিজ হাতে প্লাকার্ড লিখেছিল- ‘আমরা ৯ টাকায় ১ জিবি চাই না, আমরা বাঁচতে চাই’। একইভাবে কোটা আন্দোলনের তরুনরা কর্মসংস্থানে মেধার মূল্যায়ণ ও বৈষম্যহীনতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তাদের দাবী মেনে নেয়ার পরও এসব আন্দোলনকারীদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা কারো অজানা নয়। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, পারস্পরিক বিদ্বেষ-অনাস্থা, ভোটারবিহিন নির্বাচন এবং জনগনের স্বার্থে প্রত্যাশিত ভ‚মিকা পালনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অভাবনীয় ব্যর্থতার পরও গত দু’তিন বছরে এই দলনিরপেক্ষ নতুন প্রজন্মের হাতে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র প্রবলভাবে ধাক্কা খেয়ে আলোড়িত হয়েছে। এবারের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে কয়েক কোটি তরুণ ভোটারের সিদ্ধান্ত দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনে অনেক বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে। মহাজোট ও ঐক্যফ্রন্ট এই নতুন ভোটারদের প্রত্যাশার প্রতি লক্ষ্য রেখেই তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করবে বলে অনুমান করা যায়। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের ইশতেহার নিয়ে ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইশতেহারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মহাজোট তরুন ভোটারদের আকর্ষণ করতে ‘স্যাটেলাইট বাংলাদেশ, গ্রাম হবে শহর, উন্নয়নের মহাকাশে বাংলাদেশ’ ইত্যাদি স্লোগানকে সামনে তুলে ধরতে যাচ্ছে। বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্যতম শরিক দল সিপিবি তাদের ৩০ দফা নির্বাচনী ইশতেহারে গুম-খুন, বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড বন্ধ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মত কালাকানুন বাতিলের শ্লোগানকে সামনে নিয়ে এসেছে। অন্যদিকে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তাদের ইশতেহারে সুশাসন, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, বিভক্তি নয় জাতীয় ঐক্য ও মানবিক বাংলাদেশের অঙ্গিকার তুলে ধরতে চায়। একদিকে আওয়ামী লীগের ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প অন্যদিকে খালেদা জিয়ার ভিশন ২০৩০ এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ১১ দফা লক্ষ্য বাস্তবায়নের অঙ্গিকার সামনে রেখে নৌকা ও ধানের শীষের নির্বাচনী লড়াইয়ে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গণতন্ত্রকামী, নিরাপদ বাংলাদেশের প্রত্যাশী নাগরিকরা রায় দেবেন। এ রায়কে যারা বাধাগ্রস্ত করবে, তারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।
bari_zamal@yahoo.com

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন