শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংসদ নির্বাচন

নির্বাচন ঘিরে উৎকণ্ঠা

আবদুল্লাহ আল মামুন | প্রকাশের সময় : ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারাদেশে রাজনৈতিক সহিংতা বেড়েই চলছে। ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে সহিংসতা ততোই প্রকোট আকার ধারণ করছে। দুটি প্রধান দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেও ঘটছে সহিংসতা। এসব ঘটনায় প্রতিপক্ষ ও নিজ দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি অনেক সাধারণ মানুষও নিহত ও পঙ্গুত্বের শিকার হচ্ছেন।

মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য মতে, চলতি বছরের থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় সারাদেশে ৭৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন তিন হাজার ৮২৬ জন। নিহত ও আহতদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। এছাড়া এসব দলের অঙ্গ সংগঠনের নিজেদের কোন্দলেও অনেকের মৃত্যু ও অঙ্গহানির ঘটনা ঘটেছে।

অধিকারের তথ্যমতে, রাজনৈতিক সহিংসতায় জানুয়ারি মাসে ৯ জন নিহত ও ৬১৯ জন আহত হয়। একইভাবে ফেব্রুয়ারিতে নিহত ৫ ও আহত ৪২৪, মার্চে নিহত ৯ ও আহত ৩৩৫, এপ্রিলে ১১ নিহত ও ৪২৮ আহত, মে’তে ১৩ নিহত ও আহত ২৯৭, জুনে নিহত ২ ও আহত ১৫৩, জুলাইয়ে নিহত ৩ ও আহত ২১৬, অগাস্টে ২ জন নিহত ও আহত ২৫২, সেপ্টেম্বরে নিহত ৪ ও আহত ২৬১ এবং অক্টোবরে ১০ জন নিহত ও ৩৮০ জন আহত হয়। এছাড়া খোদ নভেম্বর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১১ জন নিহত ও ৪৬১ জন আহত হয়।

আরেক মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ছাড়াও পুলিশ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ২০৯টি। এতে ২৬ জন নিহত ও দুই হাজার ৮৪৭ জন আহত হয়। প্রতিপক্ষ ছাড়াও নিজেদের মধ্যে অন্তকোন্দলে এসব সহিংসতা ঘটে।

মানবাধিকার সংগঠনটি আরও বলছে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গত ১০ মাসে সহিংসতার ঘটনা ঘটে ১৭৮টি। এসব ঘটনায় ১৯ জন নিহত ও দুই হাজার ৩৮০ জন আহত হন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্ব›েদ্ব ১৪ জন নিহত হয়েছে। বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ দ্ব›েদ্ব মারা গেছে ৪ জন। এছাড়া ২০১৭ সালে ৩৬৪টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ৫২ জন মারা যায় ও আহত হয় চার হাজার ৮১৬ জন। ২০১৬ সালে ৯০৭টি ঘটনায় ১৭৭ জন নিহত ও আহত ১১ হাজার ৪৬২ জন। ২০১৫ সালে ৮৬৫টি ঘটনায় ১৫৩ জন নিহত ও আহত হয়েছে ছয় হাজার ৩১৮ জন। আসকের তথ্যে দেখা গেছে, গত ১০ মাসে আ.লীগ ও বিএনপির মধ্যে ১২টি সংঘর্ষে একজন নিহত ও ১৩৪ জন আহত হয়। এছাড়া আ.লীগ-জাসদ সংঘর্ষে তিন, আ.লীগ-জাপা সংঘর্ষে ১০, ছাত্রলীগ-যুবদল সংঘর্ষে সাত, ছাত্রলীগ-বিএনপি সংঘর্ষে ১৫, ছাত্রলীগ-বামপন্থীদের সংঘর্ষে তিন ও বিএনপি-জাপার মধ্যে সংঘর্ষে দুইজন আহত হয়।

একইভাবে গত ১০ মাসে শুধু আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে ৭৪টি। এসব ঘটনায় ১৬ নেতা-কর্মী নিহত ও এক হাজার ২৩১ জন আহত হয়। এছাড়া আ.লীগ-যুবলীগের তিনটি সংঘর্ষে একজন নিহত ও আহত ১১, ছাত্রলীগ-যুবলীগের ১০টি সংঘর্ষে একজন নিহত ও ১২৪ আহত, আ.লীগ-ছাত্রলীগের দুটি সংঘর্ষে তিনজন আহত, শুধু যুবলীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধে ১০টি সংঘর্ষে একজন নিহত ও ৮৭ আহত এবং শুধু ছাত্রলীগের নিজেদের ২২টি সংঘর্ষে একজন নিহত ও ১৭৫ জন আহত হয়। এ সময়ে বিএনপির মধ্যে ৩ সংঘর্ষে ১ নিহত ও ৬৩ আহত, বিএনপি-ছাত্রদলের দুটি সংঘর্ষে একজন আহত, স্বেচ্ছাসেবক দলের একটি সংঘর্ষে একজন নিহত ও তিনজন আহত, শুধু ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ বিরোধে চারটি সংঘর্ষে একজন নিহত ও ২৩ আহত এবং যুবদলের মধ্যে একটি সংঘর্ষে একজন নিহত ও ১০ জন আহত হয়।

এদিকে, একই সময়ে পুলিশ-বিএনপির ৩৮ সংঘর্ষে ৫৭৩, ছাত্রদল-পুলিশ ৮ সংঘর্ষে ২৩৭, আ.লীগ-পুলিশ ১ সংঘর্ষে ১৫ এবং সিপিবি-বাসদ-পুলিশ ১ সংঘর্ষে ৫০ জন আহত হয়। এছাড়া এই ১০ মাসে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৩ সংঘর্ষে ১ নিহত ও ১১ আহত, পৌর নির্বাচনে ৩ সংঘর্ষে ৩২ আহত ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৫ সংঘর্ষে ২৪ জন আহত হয়।

রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে রাজনৈতিক সহিংসতা ততোই বাড়ছে। নিজ দলের ভেতরে আধিপত্য ধরে রাখা এবং প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে বেশিরভাগ সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় মামলা হলেও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও হস্তক্ষেপের কারণে মামলা বেশিদূর এগুতে পারে না। যার ফলে মামলা হলেও ভুক্তভোগীরা বিচারের আশায় ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে একসময় নিস্তেজ হয়ে পড়েন।

তারা মনে করেন, দলীয় শৃঙ্খলা, সুশাসনের অভাব ও লুটপাটের অর্থনীতি চলমান থাকা এবং সর্বোপরি দলীয় নেতা কর্মীদের ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়ছে।

পুলিশ সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, অধিকাংশ সহিংসতা ও হত্যাকান্ডের ঘটনায় মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত এসব মামলা আলোর মুখ দেখতে পারে না। কর্মকর্তাদের মতে, রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে হওয়া মামলাগুলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করা যায় না। নেতা-কর্মীরা বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করায় একসময় এসব মামলার কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ে। যার কারণে থেমে থেমে হত্যাকান্ড ও সহিংসতা ঘটলেও বেশিরভাগের তদন্ত অসমাপ্ত থেকে যায়।

আসকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, এক দল অন্য দলের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া ছাড়াও নিজ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে অন্তকোন্দলে বেশিরভাগ সহিংসতা ঘটছে। বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থাকলেও তারাও মাঝে-মধ্যে কোন্দলে জড়িয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সুশাসনের অভাব থাকায় এবং দেশে লুটপাটের অর্থনীতি চলমান থাকায় রাজনৈতিক সহিসংসতা ছাড়াও সব ধরনের সহিংসতা বেড়ে চলছে।

অধিকারের পরিচালক এএসএম নাসির উদ্দিন এলান বলেন, মূলত ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়ছে। ক্ষমতাসীন দলে এই কোন্দল এখন বেশি হচ্ছে। বিএনপির মধ্যেও অভ্যন্তরীণ কোন্দল হচ্ছে, তবে আওয়ামী লীগের তুলনায় তা অনেক কম।

দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ইনকিলাবকে বলেন, সারাদেশে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে যে মতবিরোধ রয়েছে, তা কমাতে আমরা কাজ করছি। দেশের ৮টি বিভাগে ৮টি প্রতিনিধিদল করা হয়েছে। তারা দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সহিংসতা ও নেতা-কর্মীদের ভুল বোঝাবুঝি নিরসনের পাশপাশি সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি দেখভাল করবে।
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ইনকিলাবকে বলেন, বিএনপির মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলে ‘নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা ও ভুল বোঝাবুঝি’ একটি স্বাভাবিক ঘটনা। তবে তা কখনো সহিংসতার পর্যায়ে রূপ নেয়নি। তিনি বলেন, অনেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকেন। তবে সমকক্ষ কেউ মনোনয়ন পেলে অন্যদের কিছুটা খারাপ লাগতে পারে। তবে তা বড় ধরণের কোন খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করেনি। এই নেতা বলেন, বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া বর্তমানে কারাগারে আছেন। যার কারণে কিছুটা মনোমালিন্য থাকলেও ধানের শীষ প্রতীককে বিজয়ী করতে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে কাজ করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আ স ম আমানুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নেই। এ কারণেই সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, বর্তমানে আদর্শিক রাজনীতির চরম সঙ্কট চলছে। এছাড়া রাজনীতির উদ্দেশ্য জমি দখল, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি হওয়ার কারণে রাজনীতির আড়ালে মূলত দূর্বৃত্তায়ন হচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন