বহুল আলোচিত ২০১৮-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র দু’দিন বাকি। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি নির্বাচনী এলাকায় ভোটারসহ সব প্রার্থী ও তাদের কর্মীদের মধ্যে নিরাপত্তাসহ আস্থার অবস্থানটি এখনো যথেষ্ট দুর্বল। গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে রিটার্নিং অফিসারের নিয়ন্ত্রণে সশস্ত্র বাহিনী দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলাসহ বিভিন্ন উপজেলাতে অবস্থান গ্রহণ করলেও খোদ বরিশাল বিভাগীয় সদরসহ বিভিন্ন এলাকাতে গোলযোগ হামলার ঘটনা ঘটেছেই। এ প্রতিবেদন লেখার দিনও দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকায় সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ অনুপস্থিত ছিল।
বরিশাল মহানগরীতে তিনদিন প্রচারণা বন্ধ রাখার পরে ২৪ ডিসেম্বর ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীর পক্ষে মাইক নামানো হলেও তার ৩টি মাইক ভেঙে ফেলার অভিযোগ ওঠেছে। নেতাকর্মীদের বাড়িতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত থাকার কথা জানিয়েছেন ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী মুজিবুর রহমান সারোয়ার। ওইদিনই আগরপুরে হামলা হয়েছে বরিশাল-১ আসনে ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী জহিরুদ্দিন স্বপনের প্রচারণায়। বরিশাল-৪ আসনের ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী মহাজোটের কর্মীদের হামলায় পা ভেঙে এলাকা ছেড়ে বরিশাল শহরে অবস্থান নিয়েছেন আরো দিন দশেক আগে। ভোলার ৪টি আসনের মধ্যে ৩টির প্রার্থীরা এখনো অনেকটা নিজ এলাকায় পরবাসীর মত যার যার ঘরেই আছেন।
বরিশাল মহানগরীসহ জেলার ৬টি স্থানে ২৪ ডিসেম্বরই সেনাবাহিনী অবস্থান নিয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলার মধ্যে ভোলা ও বরগুনাতে নৌ বাহিনী এবং বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ঝালকাঠীতে সেনাবাহিনী অবস্থান নিয়েছে। তবে পৌষের কনকনে ঠান্ডায় এবারের বহুল আলোচিত নির্বাচনকে ঘিরে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে উত্তেজনার পারদ শুরু থেকেই উপরে উঠছিল। ভোটের দিন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে সরকারি জোটের নেতা-কর্মীরা দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সর্বত্রই নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েমেও সক্ষম হয়েছেন।
একদিকে হামলা অপরদিকে বিভিন্ন ধরনের মামলায় বিরোধী জোটের মাঠ পর্যায়ে বেশীরভাগ নেতা-কর্মীই এলাকা ছাড়া হওয়ায় ভোটের মাঠে ক্রমশ একতরফা চষে বেড়ানো স্পষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি কোন কোন প্রার্থীর কর্মীদের মধ্যে ইতোমধ্যে বিজয় উৎসব পালনের মহড়াও লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে মনে করছেন রজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল।
তবে এখনো অনেক এলাকায় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা নিজের মত করে একা একা গণসংযোগ করছেন। প্রচার প্রচারণার শেষ পর্যায়ে এসে বিরোধী জোটের প্রার্থীদের পক্ষ থেকে শুধুমাত্র ‘ভোটারদের কেন্দ্রে যাবার আহ্বান’ জানানো ছাড়া আর তেমন কিছু করার আছে বলে মনে করছেন না মহলটি।
কিন্তু কোনো কোনো প্রার্থীর প্রচারণায় ‘নৌকায় ভোট দিলেই কেন্দ্রে যাবেন’ বলেও প্রচারণা চালানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায়। অথচ দীর্ঘ দশ বছর পরে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বচনে ভোট দেয়ার আকাঙ্খা নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের ৬১ লাখ ৩০ হাজার ভোটার অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন দীর্ঘদিন।
দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি আসনে ভোটের লড়াইয়ে এবার আওয়ামী লীগের ১৯, বিএনপির ২১, জাতীয় পার্টির ৯, ওয়ার্কার্স পার্টির ৩, ইসলামী আন্দোলনের ১৯ এবং জামায়াতে ইসলামীর একজন ছাড়াও কয়েকজন স্বতন্ত্রসহ ১২২ জন প্রার্থী থাকলেও ভোটের মাঠে একচ্ছত্র আধিপত্য এখনো মহাজোটের।
২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচনে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি আসনের মধ্যে ১০টিতে কোনো ভোট গ্রহণের প্রয়োজন হয়নি প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী না থাকায়। অন্য ১১টি আসনে মহাজোট এবং ঘরের বিরোধী দল সমঝোতার প্রতিদ্ব›দ্বীতার মহড়া প্রদর্শন করে একটি ‘ভোটারবিহীন’ নির্বচন সম্পন্ন করে।
শুধুমাত্র বরিশাল-৩ আসনে মহাজোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির মো. টিপু সুলতানের সাথে জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি গোলাম কিবরিয়া টিপু ভোট থেকে সড়ে দাঁড়াবার ঘোষণা দিয়েও প্রতিদ্ব›দ্বীতা করে হেরে যান। তবে কেন্দ্রগুলোতে প্রকৃত ভোটারের উপস্থিতি ছিল ১০%-এরও কম।
এছাড়া পিরোজপুর-৩ আসনে বিএনপির সাবেক এমপি ডা. রুস্তম আলী ফরাজী স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করার মহড়া প্রদর্শন করে নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেন। এবার রুস্তম আলী ফরাজী মহাজোট প্রার্থী। পটুয়াখালী-১ আসনে জাপার তৎকালীন মহাসচিব রুহুল আমীন হাওলাদার ও বরিশাল-৬ আসনে তার সহধর্মিণী রত্মা আমীন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েও পর্দার অন্তরালে থেকে নির্বাচনী মাঠে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পরাজিত করে এমপি হন। এসব আসনেও ভোটারের উপস্থিতি ছিল মাত্র ৫%-এর মতো।
২০০১-এর ৮ম সংসদ নির্বাচনে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলার ২৩টি আসনের নির্বাচনে বিএনপি ১৮টি, আওয়ামী লীগ ২টি এবং জামায়াতে ইসলামী, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জেপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ১টি করে আসন লাভ করে। ওই নির্বাচনে বিএনপিসহ ৪ দলীয় জোটের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল প্রায় ৪৫%।
অপরদিকে আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের ভোট ছিল ৪০%-এর কিছুটা কম। সেই নির্বাচনে বরিশাল বিভাগেই সর্বনিম্নতম সংখ্যক ৬৫.৮৩% ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করে।
২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর ১/১১ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ৯ম সংসদ নির্বাচনে বরিশাল বিভাগের সংসদীয় আসন সংখ্যা দুটি হ্রাস করে ২১টিতে নির্ধারণ করে নির্বাচন কমিশন। ভোলা ও ঝালকাঠী বাদে অন্য সবগুলো জেলার সংসদীয় আসন পুনঃবিন্যাস করা হয়। যা ছিল ওই নির্বাচন কমিশনেরই নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক। নির্বাচনের আগের প্রায় দুই বছর দক্ষিণাঞ্চলে বিএনপির বেশীরভাগ নেতা-কর্মীই ছিল করাবন্দী বা পলাতক। দক্ষিণাঞ্চলে বিএনপি’র বেশীরভাগ এমপিই কারারুদ্ধ হন। যাদের অনেকেই নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরে কারামুক্ত হন। সে নির্বাচনে দক্ষিণাঞ্চলে আওয়ামী লীগ ১৬টি এবং বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও বিজেপি ২টি করে আসন লাভ করে। ২০০৮-এর ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল প্রায় ৪৮%। আর বিএনপির ৩২%। তবে ৯ম সংসদ নির্বাচনে বরিশাল বিভাগে ভোট গ্রহণের হার ছিল ১৯৯১ পরবর্তী নির্বাচনগুলোর সর্বোচ্চ। অনেক কেন্দ্রেই অবিশ্বাস্যভাবে সকাল ১১টার মধ্যেই ৭৫%-এরও বেশী ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়।
তবে এর পরেও ২০০৮-এর নির্বাচনে সারা দেশের সর্বনিম্ন ৮৪.১৭% ভোটগ্রহণ হয় বরিশাল বিভাগের ২১টি আসনে। যা ছিল এযাবতকালের সর্বোচ্চ। ২০০৮-এর নির্বাচনে দক্ষিণাঞ্চলে মোট ভোটার ছিলেন ৪৬ লাখ ৪৯ হাজার ৫১৬ জন। এ হিসেবে গত ১০ বছর বরিশাল বিভাগে ভোটার বেড়েছে প্রায় পৌনে ১৫ লাখ।
এবারের নির্বাচনকে সামনে রেখে এতদিন দক্ষিণাঞ্চলে সব দলই ‘নতুন ভোটারদের মাধ্যমেই এবারের ফলাফল নির্ধারিত হবে’ বলে জানালেও এখন আর তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। মহাজোট মাঠের দখল রাখতে ব্যস্ত। আর ঐক্যফ্রন্ট নতুন পুরনো নয়, সব ভোটারকেই কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। সাধারণ মানুষ নিরাপদে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার আকাঙ্খা পোষণ করছেন দীর্ঘদিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন