এক পক্ষের এবড়ো থেবড়ো নির্বাচনী মাঠ। আর অন্যপক্ষের থরে থরে সাজানো গোছানো ব্যবস্থা। একপক্ষ দুঃশাসনের অবস্থান আর জনগণের ভোট ভাতের অধিকার আদায়ের স্লোগান নিয়ে মাঠে। অন্যপক্ষে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য ক্ষমতার মসনদ ধরে রাখার প্রস্তুতি। এমনি অবস্থার মধ্যদিয়ে রাজশাহী অঞ্চলে চলছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের খেলা।
ক্ষমতায় থাকার সুবাদে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সবক্ষেত্রে ব্যাবহার করে বাধা বিঘ্নহীন রাজসিক প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। আর বিপক্ষে বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট চরম দমন নিপীড়ন পদে পদে বাধা বিঘ্ন মাঠ খালি করার জন্য প্রতিদিন এক পেশে গ্রেফতার, হুমকি ধামকি। নির্বাচনী অফিস ভাংচুর অগ্নিসংযোগ। প্রতিপক্ষের জন্য নির্বাচনের মাঠ মোটেই অনুকূল নয়। তারপরও শত বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে মাটি কামড়ে পড়ে আছে বিরোধী জোট।
মঈন উদ্দিন-ফখরুদ্দিনের ওয়ান ইলেভেনের রাজনৈতিক সিডরে ক্ষত বিক্ষত বিএনপি। এ অঞ্চল তাদের দীর্ঘদিনের দুর্গ থাকলেও সিডরের আঘাতে তছনছ হয়ে গেছে। এরপরও আরো দশ বছরে একেবারে চিড়েচ্যাপটা অবস্থা। এবার তাদের জন্য সুযোগ এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর। বিপন্ন অস্তিত্বকে জাগিয়ে তোলার। হারানো দুর্গকে পুনরুদ্ধারের। ব্যাতয় ঘটলে মহাবিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এখনি যেমন দমন নিপীড়ন চলছে। নির্বাচনে অন্য রকম কিছু হলে বিএনপিকে বাটি চালান দিয়ে খুঁজে পাওয়া যাবেনা এমন আস্ফালন শঙ্কার কারণ বটে। আবার একই সাথে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে দেশে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে এমন কথায় সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন।
ভোটের সময় ঘনিয়ে আসছে। আর মাত্র দুদিন পর নির্বাচন। কদিন হলো মাঠে সেনা মাতায়েন করা হয়েছে। তফসিলের শুরু থেকে নির্বাচনী মাঠে যে তুলকালাম কান্ড চলছিল তা কিছুটা হলেও কমেছে। মাঠের খেলা কমলেও অভ্যন্তরের খেলা শুরু হয়েছে এমন অভিযোগ করছেন বিএনপি প্রার্থী আর তার লোকজন।
প্রতিদিন তাদের নেতাকর্মীদের আটক করা হচ্ছে। ভয়ভীতি দেখানো অব্যাহত রয়েছে। কোথাও কোথাও থানার অতিউৎসাহী বড় বাবুরা অস্থির করে তুলেছেন বিপক্ষের লোকজনকে। চলছে গায়েবি মামলার পর এখন নাশকতার ছক কষছিল এমন অভিযোগে আটক। ধরা ছাড়া নিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে। বিএনপি প্রার্থীরা বলছেন আমরা এসব বিষয় নিয়ে রিটার্নিং অফিসারের কাছে অভিযোগ দিতে ক্লান্ত হয়ে লাভ নেই বলে আর দিচ্ছিনা। আল্লা আল্লা করে ভোটের একটা দিন পার হলেই হয়।
রাজশাহী-১ আসনের প্রার্থী ব্যারিষ্টার আমিনুল হক তার এলাকার প্রিজাইডিং অফিসারের তালিকা তুলে ধরে বলেন সব আওয়ামী লীগের লোকজন। ওরা দলের বিভিন্ন পদে রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। এ অবস্থা শুধু গোদাগাড়ি তানোর নয় প্রত্যেক আসনে। পুলিশ ওদের চৌদ্দ গুষ্টির খবর নেবার পর তাদের মনোনয়ন দিয়েছে। লক্ষ্য একটাই ভোটের উল্টাপাল্টা কাম।
রাজশাহীর ৬টি আসনের প্রার্থীরা বার বার সাংবাদিক সম্মেলন করে তাদের উপর হামলা নির্যাতনের বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। গত সোমবার দুপুরে জেলা রিটার্নিং অফিসারের সাথে মত বিনিময়কালে ফের তাদের উদ্বেগ উৎকন্ঠার কথা তুলে ধরেন। এমনকি আইনের মারপ্যাচে রাজশাহী আসনের প্রার্থীকে কারারুদ্ধ ও শেষ পর্যন্ত তার প্রার্থীতা স্থগিতের পরও তার পরিবারের লোকজনের উপর হামলা ও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।
নাটোরের বিএনপির এক প্রার্থী অনুরোধ করে বলেছিলেন ভাই নাটোরে এসে দেখে যান কি দুঃসহ অবস্থা। আমাদের প্রচার প্রচারণায় নামতে দেয়া হচ্ছে না। বের হলেই হামলা মামলার শিকার। হাড় গোড় ভেঙ্গে সোজা হাসপাতালে। আবার উল্টো মামলা দিয়ে কারাগারে। পুরো নাটোর যেন উম্মুক্ত কারাগার হয়ে গেছে। রিটানিং অফিসার, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ সবাই আমাদের নিয়ে খেলছে। আমরা নির্যাতিত আর পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছি এসব নিয়ে প্রতিকারের জন্য ওদের কাছে যাচ্ছি। ওরা শুধু দেখব দেখছি বলে ভাঙ্গা রেকর্ড বাজিয়ে চলেছে। কোন প্রতিকার নেই।
এলাকার সাংবাদিকরাও ভয়ে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে ভয় পাচ্ছে। দু’জন সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন ভাই বিবেকের দংশনে দংশিত হচ্ছি। ভয়ে সত্যি কথাটা লিখতে পারছি না। আমার হাড়গোড় ভাঙলে রক্ষা করবে কে? নাটোরের চারটি আসনজুড়েই এমন অবস্থা। প্রার্থীরা নিজেদের জীবন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তারপরও সাহস করে ভয়কে জয় করে নেতাকর্মীদের নিয়ে সীমিত তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভোটারদের সাথে আলাপকালে তাদের মধ্যে বেশ শঙ্কা দেখা যায়। ভোট নিয়ে কোন কথা বলতে চান না। গত রোববার নাটোর নীচা বাজারে এক চায়ের দোকানে ভোট নিয়ে কথা তুলতেই বলে ওঠেন ভাই ওসব বাদ দেন। চা সিঙ্গাড়া খান চলে যান। দুজন মুরব্বী গোছের লোকের সাথে আলাপকালে বলেন বাপের জম্মে এমন ভোট দেখিনি। গন্ডগোল না হলে ভোট দিতে যাব নইলে নয়।
নাটোর থেকে ফেরার পথে রাজশাহীর পুঠিয়া বানেশ্বর বাজারে নেমে ভোটের খবর নিতে গিয়ে জানাগেল বিএনপি প্রার্থীর প্রতীক নিয়ে আদালতের রায়ে ফেঁসে গেছেন। বিএনপি নাদিম-নজরুল বেড়াজালে ঘুরপাক খাবার পর গত সোমবার নজরুলের পক্ষে রায় মিলেছে। বিএনপি জামায়াত নেতাকর্মীরা রয়েছেন গ্রেফতার আতঙ্কে। রাত হলেই বিপক্ষের বাড়ি বাড়ি চলছে অভিযান।
এ নির্বাচনী এলাকার আরেকটি উপজেলা দুর্গাপুর সেখানে অর্ধশত মটর সাইকেল নিয়ে দিনে ক্যাডার বাহিনী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর রাতে পুলিশ। সব নাশকতার অজ্ঞাত আসামি ধরা ছাড়া নিয়ে রাতভর দেন দরবার বাণিজ্যের অভিযোগ মুখে মুখে। বিএনপির লোকদের ভয় দেখানো হচ্ছে ভোটের আগে এলাকা ছেড়ে যাবার।
পাশের উপজেলা বাঘা-চারঘাট নিয়ে রাজশাহী-৬ আসন। বানেশ্বর থেকে চারঘাটে গেলে দেখা যায় ভোট নিয়ে মানুষের মুখে বিষাদের ছায়া। সারদা বাজারে ভোটের খবর কি জানতে চাইলে কজন বলে ওঠেন এখানে ভোট নেই। কাকে ভোট দেব। ভোটের দরকার নেই। সরকার দলীয় প্রার্থী এমনিতে পাশ হয়ে গেছে।
এমন কথার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। বিএনপির প্রার্থী ছিলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আবু সাঈদ চাঁদ। এলাকার খুব প্রিয় ও শক্তিশালী প্রার্থী। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে কোথাও হারেননি। এবার প্রার্থী হয়েছিলেন এমপির। বিধিবাম একের পর এক মামলা, গায়েবী মামলা দিয়ে তাকে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাবার মুহুর্তে গায়েবী মামলা দিয়ে তার কারামুক্তি আটকে দেয়া হয়েছে। মনোনয়নপত্র নিয়ে চলে নাটকীয়তা। পরিবার পরিজন মাঠে নামে প্রচারণায়। পদে পদে বাধা এতেও বোধ হয় শঙ্কা কাটেনি প্রতিপক্ষের।
শেষ পর্যন্ত আদালতের আদেশে তার প্রার্থিতা স্থগিত হয়ে যায়। এজন্য বিএনপি ও এলাকার মানুষের অভিযোগের আঙুল আওয়ামী লীগের প্রার্থীর দিকে। যদিও একেবারে এসব বাজে কথা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন শাহরিয়ার আলমের লোকজন। তারা বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন।
গত সোমবার থেকে সেনাবাহিনী মাঠে নেমেছে। মানুষ সেনাবাহিনী মোতায়েনে প্রত্যাশা করছে ভোটের মাঠ কিছুটা হলেও মসৃন হবে। গত সোমবার নাটোরের তেবাড়িয়া হাটে বিএনপির নেতাকর্মীরা মিছিল করতে গেলে হামলার শিকার হয়। সোমবার সকালে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের বাসভবন ঘিরে রাখে সাদা পোষাকের পুলিশ বাহিনী। এনিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিএনপির প্রার্থী মিজানুর রহমান মিনু। সবারই প্রত্যাশা ধীরে ধীরে সেনাবাহিনী নির্বাচনের পুরো মাঠ নিয়ন্ত্রনে নেবে। মানুষ নিরাপদে ভোট দেবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন