ইসলামে বৈধ উপার্জনের গুরুত্ব অপরিসীম। হালাল রুজি ছাড়া কোন দোয়া, ইবাদত কবুল হবে না। আল্লাহ পাক সূরা বাকারার ১৮৮নং আয়াতে ঘোষণা করেন- ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না এবং মানুষের ধনসম্পত্তির কিছু অংশ জেনে বুঝে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিচারককে উৎকোচ দিও না।’ নবী করিম (সা.) বলেছেন- ‘যে দেহে হারাম খাদ্যে উৎপন্ন গোশত রয়েছে তা জান্নাতে যাবে না।’ নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন- ‘হালাল জীবিকা সন্ধান করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ।’ (তাবরানি ও বায়হাকি)। কথিত আছে যে, মূসা (আ.) একদা চুল, দাড়ি পেকে সাদা হয়ে যাওয়া অতিবৃদ্ধ ব্যক্তির দেখা পেলেন। যিনি দিনভর নফল রোযা রাখেন ও দীর্ঘ সময় নফল নামাজে অতিবাহিত করে আল্লাহর কাছে হাত তুলে দোয়া-মোনাজাতে এত বেশি কাঁদছিলেন যে, তার চোখের পানিতে গাল ও দাঁড়ি ভিজে পানি ফোঁটায় ফোঁটায় জমিনে পড়ছিল।
বৃদ্ধের ইবাদত সাধনা ও কান্না দেখে মূসা (আ.) এর খুব মায়া হল।
তুর পাহাড়ে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ওই বৃদ্ধের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে আল্লাহ জবাবে বললেন- ওই বৃদ্ধের কোন দোয়া ও ইবাদত কবুল হচ্ছে না, কারণ তার দেহে হারাম খাদ্যে সৃষ্ট গোশত বিদ্যমান ও তার পরনে হারাম উপার্জনের পোষাক। পরের সম্পদ অবৈধ ভক্ষণের মতো ফুফু, বোন, কন্যা বা অন্যান্য দুর্বল ওয়ারিশদের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার পরিণাম সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ওয়ারিশকে মিরাস থেকে বঞ্চিত করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ ওই ব্যক্তিকে জান্নাতের উত্তরাধিকারী থেকে বঞ্চিত করবেন’ (ইবনে মাজাহ)। হালাল রুজির বিষয়ে অতীতের মনীষীরা অনেক সতর্ক ছিলেন যা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। কথিত আছে আবুল কাদের জিলানী (র.)- এর পিতা ক্ষুধার জ্বালায় নদীতে ভাসমান একটি আপেল খেয়ে ফেলেন। পরে মালিকের খোঁজ করে দায়মুক্তি চাইলে মালিক ১২ বছর তার চাকর হিসেবে নিযুক্তির শর্ত দিলে তিনি তা মেনে নেন। কেননা দুনিয়ার ১২ বছর আখেরাতের তুলনায় খুব অল্প সময়।
ইমাম আবু হানিফা (র.) কাপড়ের ব্যবসা করতেন। একবার একটি বান্ডিলের কাপড়ের এক জায়গায় একটু ত্রুটি থাকায় তিনি কর্মচারীকে বললেন, ত্রুটি দেখিয়ে এর মূল্য কম নিও।
পাইকাররা এলে কর্মচারী তা ভুলে গিয়ে সব বান্ডিল একই দামে বিক্রি করে দিল। ইমাম আবু হানিফা বিষয়টি জেনে কর্মচারীকে বললেন, অন্যান্য বান্ডিলের টাকা এ বান্ডিলের টাকাসহ একত্র করে ফেলেছ সুতরাং পুরো টাকাটি গ্রহণ করা ঠিক হবে না। এই বলে তিনি ওই সময়ের বিক্রির সব টাকা দান করে দিলেন।
আবু বকর (রা.) সারাদিন রোযা রেখে ইফতারের জন্য বসেছেন, এমন সময় তার চাকর একটু খাদ্য এনে ওনার সামনে রাখলো, তিনি এক লোকমা খেয়ে চাকরকে জিজ্ঞাসা করলেন- এ খাদ্য কোথা থেকে এনেছ? সে বলল- জাহেলিযুগে আমি গণকের কাজ করতাম, কিন্তু আমি গণনার নামে মানুষকে ফাঁকি দিতাম। ওই সময়ে একজন আমার নিকট বাকীতে ভাগ্য গণনা করেছিল। আজকে সে টাকা পরিশোধ করলে আমি তা দিয়ে খাদ্য কিনে আনলাম।
আবু বকর (রা.) তৎক্ষনাৎ উঠে গিয়ে গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি করার চেষ্টা করলে, কিন্তু তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, বমি হচ্ছিলনা। তখন জনৈক ব্যক্তি বলল- আপনার পেট খালি, আপনি পানি পান করুন তারপর বমির চেষ্টা করুন। আবু বকর (রা.) তা করে বমি করে ঐ খাদ্য ফেলে দিলেন। অতঃপর বললেন নবী (সা.) বলেছেন- হারাম খাদ্যে সৃষ্ট গোশত জান্নাতে যাবে না জাহান্নামই তার উত্তম ঠিকানা। আমি মরে গেলেও এ অবৈধ খাদ্য বমি করে বের করতাম।
বাগানের মালিক বাগানের কর্মচারীকে বাগান থেকে মিষ্টি দেখে কমলা আনতে বললে, সে কমলা নিয়ে এল। কিন্তু কমলাগুলো টক।
মালিক জিজ্ঞাসা করলে সে বলল, আমাকে বাগানের কাজে নিয়োগ করেছেন, খাওয়ার অনুমতি দেননি, তাই আমি কখনো খেয়ে দেখিনি, কি করে বুঝবো কোন গাছের কমলা মিষ্টি। নবী (স.) বলেছেন- বৈধ উপার্জনের সঙ্গে অবৈধ অল্প উপার্জনও যদি একত্র হয়, তখন পুরো উপার্জন অবৈধ বলে গণ্য হবে। যিনি যে বিভাগে কর্মরত তিনি যদি কর্মে ফাঁকি দেন, তবে তার বেতন বৈধ হবে না।
অনেকে মনে করেন আমার অল্প বেতন কাজ বেশি তাই অবৈধ আয়ের সুযোগ খোঁজেন। তিনি চাকুরি নেয়ার আগে কাজ ও বেতনের বিষয়টি জেনেই যোগদান করেছেন। তাই অবৈধ আয়ের কোন সুযোগ নেই। এমনকি সরকারি চাকুরিজীবিদের সম্মানী, উপহার ইত্যাদি গ্রহণ বৈধ নয়। সুদ, ঘুষ, পরের সম্পদ আত্মসাৎ, খাদ্যে ভেজাল, চুরি-চিনতাই, কাজে ফাঁকি দেয়া, দায়িত্বে অবহেলা, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি মানুষের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ এর পরিণতি মারাত্মক ভয়াবহ সম্পদের নেশায় সে কথাটি ভুলে যাচ্ছি।
ক্ষনস্থায়ী দুনিয়া ছেড়ে আমাদেরকে অবশ্যই প্রস্থান করতে হবে। তখন সম্পদ আমার কোন কাজে আসবে না। ওয়ারিশরা সম্পদ ভাগ করে ভোগ করবে। অবৈধ সম্পদ গড়ে গেলে তার জন্য শাস্তি আমাকেই ভোগ করতে হবে, তাই আমরা সাবধান হই। রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত দেই। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হলে তা ফেরত দেই।
ব্যক্তিকে পাওয়া না গেলে তার নামে দান করে দেই। অফিস, আদালতে যার যার দায়িত্ব কোন ধরণের উৎকোচ গ্রহণ ব্যতিত সম্পন্ন করি। নির্ধারিত সময় পর্যন্ত কর্মস্থলে অবস্থান করি। আল্লাহর কাছে খাঁটিভাবে তওবা করি। তারপরেই আমাদের দোয়া ও ইবাদত কবুল হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন