শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৩ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক উন্নয়ন-অগ্রগতির পাশাপাশি বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক সামরিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দশম জাতীয় নির্বাচনের পর ভারত-চীনের মত আঞ্চলিক শক্তিগুলোর অবস্থান এবং পশ্চিমাদের অবস্থানে সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। একাদশ নির্বাচনের পরও সেই ভূমিকারই ধারাবাহিকতাই লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারত এবং বৃহত্তম বিনিয়োগকারী ও উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে চীনের ভ‚মিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে বাংলাদেশের যে কোনো ধরণের সরকারের সাথে কাজ করতে প্রস্তুত। একই কথা পশ্চিমাদের ক্ষেত্রেও অনেকটা প্রযোজ্য। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, বাণিজ্য, উন্নয়ন অংশীদারিত্ব এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিষয়ে এখনো পশ্চিমারাই মূল নীতি নির্ধারক ও প্রভাবকের ভ‚মিকায় অধিষ্ঠিত। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ধরনের প্রত্যাশা ও বিবৃতি প্রকাশ করে আসছিল তার বেশীরভাগই ব্যর্থ হয়েছে। অবশ্য নির্বাচনটি সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হওয়াকে তারা এক ধরনের গণতান্ত্রিক অগ্রগতি হিসেবেই দেখেছে। একইসঙ্গে নির্বাচন পরবর্তী বিবৃতিতে তারা ব্যাপক অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগগুলোকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছে। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অভিন্ন অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের তরফে দেয়া বিবৃতিতে নির্বাচনে বিরোধীদলের প্রার্থীদের বাঁধা প্রদান, গ্রেফতার-হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানাবিধ অনিয়ম সম্পর্কে তারা অবহিত আছে বলে জানিয়েছে। সেই সাথে ভোটের দিন ভোটারদের বাঁধাদানসহ অনিয়ম-সহিংসতার অভিযোগগুলো বিশ্বাসযোগ্য বলে তারা মনে করেছে এবং এসব অনিয়মের স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও সমাধান দাবী করেছে। ২৮ জাতির ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও একাদশ জাতীয় নির্বাচনের ইতি ও নেতিবাচক বিষয়গুলোকে তুলে ধরার পাশাপাশি অনিয়মের স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত দাবী করেছে। বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিকদল এবং সাধারণ মানুষও দেশে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশা করেছিল। বাহ্যত পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন,স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশা করলেও বাংলাদেশের সরকার ও সব রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছা ও কার্যকর ভ‚মিকাই কেবল এই প্রত্যাশা পুরণ করতে পারে। নির্বাচনে অবিশ্বাস্য- অভাবনীয় ফলাফল প্রকাশের পর যে সব অনিয়ম, জালিয়াতি ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ বিরোধীদলের পক্ষ থেকে এবং গণমাধ্যমে উঠে এসেছে তা অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ নেই। আগামী দিনের বিনিয়োগ বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন অক্ষুন্ন রাখা এবং সরকারের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা অর্জনের স্বার্থে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এমন অভিযোগগুলোর স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও রাজনৈতিক সমাধান জরুরী। পশ্চিমা রাষ্ট্র এবং প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো একাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যে সব মতামত, প্রতিবেদন ও বিবৃতি প্রকাশ করেছে, তার বেশীরভাগই নেতিবাচক। সেই সঙ্গে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবী জানিয়েছে। এমতাবস্থায়, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থেই সরকারকে নির্বাচনসহ সামগ্রিক রাজনৈতিক বিষয়ে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য একটি সমাধানের পথে আসতে হবে।
অবকাঠামো উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিক থেকে বিগত এক দশকে দেশ যথেষ্ট এগিয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ছিল আরো অনেক বেশী। চীন ও ভারত শত শত কোটি ডলারের বিনিয়োগ করলেও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই পশ্চিমা বিনিয়োগে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। সেই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা বাতিল, তৈরী পোশাক খাতসহ বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য, এভিয়েশন ও ইমিগ্রেশন নতুন নতুন সংকটের সম্মুখীন হয়। গত কয়েক বছর ধরে দেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতেও নেতিবাচক ধারা চলছে। নির্বাচন পরবর্তী বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত নাগরিকদের স্বার্থসহ পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। নির্বাচন পরবর্তী বিবৃতিতে জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও নির্বাচনে সন্ত্রাস, প্রাণহানী, অনিয়ম দুর্নীতির স্বচ্ছ ও আইনগত সমাধানের তাগিদ দেয়ার পাশাপাশি নির্বাচন পরবর্তি সহিংসতা পরিহার এবং বিরোধীদের সভা-সমাবেশের অধিকার নিশ্চিতকরণ ও সবাইকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানানো হয়েছে। নির্বাচন যেমনই হোক, মানুষের জানমালের নিরাপত্তা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নির্বাচনে প্রায় দু’ ডজন মানুষের প্রাণহানী ও শত শত মানুষের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি –জামায়াত নেতাকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছে। এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। একজন নারী ভোটারের গণধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণের খবর জনমনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। এমনকি নির্বাচনের প্রতিবেদন প্রকাশের ক্ষেত্রে ভুলভ্রান্তির অভিযোগে একজন সাংবাদিককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে দাগী আসামীদের মত হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ হেফাজতে নেয়ার ঘটনাও নির্বাচনের পরে ঘটেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে দেশের গণমাধ্যম কর্মীদের মধ্যে যে তীব্র প্রতিবাদ ও আশঙ্কার বিষয়গুলো প্রকাশিত হয়েছিল,এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তাই সত্যে পরিনত হল। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের আইন এবং রাজনৈতিক কারণে সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত থাকতে পারে না। দেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং টেকসই উন্নয়নের সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই নির্বাচনের অস্বচ্ছতা এবং মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার লঙ্ঘনের হুমকি দূর হওয়া প্রয়োজন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন