২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশজুড়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল। সে সময় পূর্ণিমা নামের এক কিশোরী কতিপয় দুর্বৃত্তের লালসার শিকার হয়েছিল। সে সময় অভিযোগ করা হয়েছিল, পূর্ণিমার পরিবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এবং তারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিল বলেই তাকে বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের নৃশংসতার শিকার হতে হয়েছিল। কিশোরী পূর্ণিমার ধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল সারাদেশে। নিন্দা জানিয়ে ঘটনার হোতাদের শাস্তি দাবি করেছিল বিভিন্ন সংগঠন। মানবাধিকারের চরম লংঘনের সে ঘটনার দায় নেয়নি কেউ। দুর্বৃত্তরা ধরা পড়েছিল কিনা, তাদের শাস্তি হয়েছিল কিনা তাও আর কারো জানা হয়নি। আঠারো বছর আগের সেই বর্বরোচিত ঘটনার কথা এখনো মুছে যায়নি কারো স্মৃতি থেকে। গ্রামের এক অসহায় কিশোরির ওপর চালনো পাশবিক অত্যাচারের খবরে আঁৎকে উঠেছিল মানবিক মূল্যবোধসমপন্ন প্রতিটি মানুষ। পূর্ণিমা আজ ভালো আছে। কিন্তু একটি নৃশংস ঘটনার জীবন্ত সাক্ষী হয়ে আছে সে। মর্মান্তিক এই ঘটনাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টাও কম হয়নি। ওই ঘটনায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল ওই নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। এ নিয়ে রাজনৈতিক ব্লেম গেম আমরা দেখেছি। পরষ্পরবিরোধী পক্ষগুলো তা নিয়ে মেতে উঠেছিল রাজনৈতিক খেলায়। কে কার ওপর দোষ চাপাবে তা নিয়ে চলেছিল প্রতিযোগিতা। তবে, রাজনৈতিক খেলা তারা খেললেও পূর্ণিমার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নির্মম অমানবিক ঝড় কিন্তু মিথ্যা ছিল না। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে পূর্ণিমাকে হাজির করা হয়েছিল টিভি পর্দায় বিজ্ঞাপনের মডেলের ন্যায়। অনেকের মতে, ওই প্রচারণায় স্ব-মুখে তাকে দিয়ে ঘৃণ্য সে ঘটনার কথা বলানোর মাধ্যমে মেয়েটিকে দ্বিতীয়বার অপমানিত করা হয়েছে।
আঠারো বছর পরে ঠিক তেমনি আরেকটি ঘটনা ঘটেছে নোয়খালী জেলার সুবর্ণচরে। ‘ধানের শীষে’ ভোট দেওয়ার অপরাধে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের দ্বারা ধর্ষিতা হয়েছে পারুল নামে দুই সন্তানের এক জননী। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের রাতে সংঘটিত সে পৈশাচিক ঘটনা দেশবাসীকে হতভম্ব করে দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এক নেতার নির্দেশ ও উপস্থিতিতে গণধর্ষণের সে ঘটনাটি ঘটেছে। এ ঘটনার ওপর গত ২ জানুয়ারি পত্রিকান্তরে ‘যে বর্ণনা শোনার মতো নয়’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি পাঠ করলে যে কারো গা শিউরে ওঠার কথা। ওই প্রতিবেদনে কতগুলো মানুষাকৃতির দ্বিপদ প্রাণির হিংস্রতার যে বর্ণনা রয়েছে, তাতে আমাদের সমাজ ও রাজনীতির এক কুৎসিত চিত্রই ফুটে উঠেছে। ঘটনার বিবরণ সবারই জানা। তাই এখানে তার পুনরুল্লেখ বাহুল্য বিবেচনা করছি। কিন্তু যে প্রশ্নটি আজ সবার বিবেকের দরজায় কড়া নাড়ছে, তা হলো, কেন এমন হিং¯্রতা সংঘটিত হবে?
পারুলের নির্যাতনের ঘটনায় স্থানীয় থানায় যে মামলা হয়েছে তাতে ঘটনার মূল হোতা আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা রুহুল আমিনকে বাঁচানোর চেষ্টা লক্ষ করা গেছে। পারুলের স্বামী সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘সোমবার (৩১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় চর জব্বর থানার ওসি (তদন্ত) হাসপাতালে এসে আমাকে চর জব্বর থানায় নিয়ে যান এবং থানায় লেখা এজাহারে আমার সই নিয়ে বলেন, এটাই মামলা। এখন দেখা যাচ্ছে মামলায় রুহুল আমিনের নাম রাখা হয়নি। পুলিশ তাকে ধরেও পরে ছেড়ে দিয়েছে।’ পরে অবশ্য পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নোয়খালীতে গৃহবধুকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের কেউ ছাড় পাবে না। দোষীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। এ ঘটনাকে চুড়ান্ত মানবাধিকারের লঙ্ঘন আখ্যা দিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, ‘যে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় যারা দায়ী, আইনের আওতায় এনে তাদের শাস্তির জন্য আমরা লড়াই করি। এই নির্যাতন চুড়ান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত আমরা করব। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তা গণমাধ্যমে জানাব।’ এদিকে ঘটনার খবর পাওয়ার পর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পৃথক দু’টি তদন্ত দল ঘটনাস্থলে গেছে বলে সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে। এ নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদ ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে মহিলা পরিষদ, আসক, নারীপক্ষ, হিউম্যান রাইটস ফোরামসহ বিভিন্ন সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠন বিবৃতি দিয়েছে। সংগঠনগুলো এ পৈশাচিক ঘটনার হোতাদের শাস্তি এবং ধর্ষিতা পারুলের সুচিকিৎসা এবং তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে।
ঘটনাটি শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ় হননি এমন কাউকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। পছন্দের দল ও প্রার্থীকে ভোট দেওয়ায় এমন শাস্তি একজন নারীকে পেতে হবে কেন-এ প্রশ্ন উঠেছে সর্বত্র। যেখানে আমাদের সংবিধান এ দেশের সব নাগরিককে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। সংবিধানের যেসব অনুচ্ছেদে নাগরিকদের সংগঠন ও সভা সমাবেশের অধিকার দেওয়া হয়েছে, নির্বাচনে পছন্দের দল বা প্রর্থীকে ভোট দেওয়ার অধিকারও তার অন্তর্ভূক্ত। সে অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে পারুল আজ ধর্ষিতা, হাসপাতালে পাঞ্জা লড়ছে মৃত্যুর সাথে। নির্বাচনে ভোটাররা তাদের পছন্দ মতো ভোট দেবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের দেশে এ ক্ষেত্রে জবরদস্তির অনেক ঘটনাই ঘটে থাকে । ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচনোত্তর সহিংসতা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন। প্রতিটি নির্বাচনের পর প্রতিদ্ব›দ্বী দল ও প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিজয়ী দলের কর্মী-ক্যাডারদের হাতে পরাজিত দলের কর্মী-সমর্থকদের নির্যাতিত হতে হয়। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। নির্বাচনের আগেও যেমন ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের হামলা ও পুলিশের হয়রানির কারণে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা পালিয়ে বেড়িয়েছে, এখনও তারা নিজ নিজ এলাকায় যেতে পারেনি। এছাড়া প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে খবর আসছে নির্বাচনোত্তর সহিংসতার। যেসবের প্রধান ভিক্টিম হচ্ছে পরাজিত বিএনপির নেতাকর্মীরা। গত ২ জানুয়ারির পত্রিকান্তরে এক প্রতিবেদনে সে চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে হামলা মামলা ও পুলিশি ধরপাকড়ের মুখে পালিয়ে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীরা ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত বিরোধী দলের ১১ হাজার ৫০৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ৯২৭টি। এ অভিযোগ বিএনপির। যদিও পুলিশ বলছে, রাজনৈতিক কারণে কেউ গ্রেফতার হননি। সুনির্দিষ্ট মামলার আসামিদেরই গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের ভাষ্যকে অসত্য বলা যাবে না। কেননা, যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা কোনো না কোনো মামলার আসামি। তবে, খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে, মামলাগুলো রাজনৈতিক কারণে দায়ের করা। বিএনপির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে দাবি করা হয়েছে, দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিগত কয়েক বছরে সারাদেশে প্রায় পঁচানব্বই হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে, যেগুলিতে জ্ঞাত এবং অজ্ঞাত মিলিয়ে আসামির সংখ্যা প্রায় পঁচিশ লাখ। সুতরাং কাউকে গ্রেফতার করে সুনির্দিষ্ট মামলার আসামি হিসেবে দেখিয়ে দেওয়া কঠিন কোনো বিষয় নয়।
রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার অভাবই যে এর মূল কারণ সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদেরকে গণতন্ত্রের ধারক-বাহক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। কিন্তু অনেক সময়ই জনগণ তাদের কর্মকান্ডে তা খুঁজে পায় না। প্রতিদ্ব›দ্বী দলকে তারা শত্রæপক্ষ মনে করে। ফলে সময়ে সময়ে এমন সব ঘটনা ঘটে, যেগুলো কাক্সিক্ষত তো নয়ই, বরং ঘৃণ্য। সুস্থ রাজনীতির প্রয়োজনীয়তার কথা গুণিজনরা প্রায়ই বলে থাকেন। কিন্তু রাজনীতিকদের অসুস্থ চিন্তাভাবনার কারণে তা আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছে দিন দিন। তাই বলে এটা বলা ঠিক হবে না যে, ২০০১ সালের পূর্ণিমার সাথে আর ২০১৮ সালে পারুলের সাথে সংঘটিত ঘটনা কোনো রাজনৈতিক দলের নির্দেশে ঘটেছে। রাজনৈতিক দলের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে ওঁৎ পেতে থাকা দুর্বৃত্তরাই এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়ে থাকে। বলাই বাহুল্য, এদের অপকর্মের দায়ভার বহন করতে হয় রাজনৈতিক দলগুলোকেই। আবার অনেক সময় এদেরকে আইনের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে রেহাই দেওয়ার চেষ্টাও করতে দেখা যায় রাজনৈতিক নেতাদেরকেই।
নির্বাচনে বিজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দু’টি কথা দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এক. গত ৩১ ডিসেম্বর গণভবনে বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেছেন ‘আমি সবার প্রধানমন্ত্রী’। দুই. গত ২ জানুয়ারি গণভবনে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে আসা বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিদের সাক্ষাতের সময় অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনের পর দেশ ও জনগণের প্রতি আমার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে’। বস্তুত একজন দায়িত্বশীল রাজনীতিকের মতোই কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি এটা যেমন সত্য, তেমনি তিনি দেশেরও প্রধানমন্ত্রী। যারা তাকে বা তার দলকে ভোট দিয়েছে তাদের যেমন তিনি প্রধানমন্ত্রী, তেমনি যারা তাকে ভোট দেয়নি তাদেরও প্রধানমন্ত্রী তিনি। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসবেন, তখন তার দৃষ্টিভঙ্গী হবে নিরপেক্ষ। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করবেন তিনি। দেশবাসীও তার কাছ তেকে সেটাই প্রত্যাশা করে। দেশবাসী বিশ্বাস করে, সুবর্ণচরের পারুলের আর্তচিৎকার নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর হৃদয়ের মর্মমূলে আঘাত করে থাকবে। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত হবে তার দৃঢ় মনোভাবের কারণে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন