শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

নামাজ দর্শন : একটি তাত্তি¡ক সমীক্ষা

এ. কে. এম ফজলুল রহমান মুন্শী | প্রকাশের সময় : ১৭ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

“তোমরা নামাজ কায়েম কর”।
ইসলামী ইবাদতের প্রথম রোকন যা আমীর, গরীব, বৃদ্ধ, যুবক, নারী, পুরুষ, সুস্থ, রোগী সকলের উপর সমভাবে ফরজ এবং এটা এমন ইবাদত যা কোন অবস্থাতেও সাকেত বা বিলোপ হয়ে যায় না, এমনকি এই ফরজকে কেউ দাঁড়িয়ে আদায় করতে না পারলে বসে হলেও আদায় করতে হয়, এতেও যদি সে অপারগ হয় তাহলে শুয়ে শুয়ে আদায় করতে হয়, আর যদি মুখে এই ইবাদতের শব্দাবলী উচ্চারণ করতে না পারে তাহলে ইশারায় আদায় করতে হয়, যদি দাঁড়িয়ে আদায় করতে সক্ষম না হয়, তাহলে চলমান অবস্থায়ই তা আদায় করতে হয়, আর যদি সে কোনও যানবাহনের উপর সওয়ার হয়ে থাকে, তাহলে যেদিকে তা গমন করে সেদিকেই মুখ করে আদায় করতে হবে। এই ইবাদতকেই সালাত বলা হয়। ফার্সী এবং বাংলা ভাষায় আরবী সালাত শব্দটির প্রতিশব্দ নামাজ। তবে সালাত শব্দের মূল ব্যঞ্জনা প্রতিশব্দের দ্বারা ষোলআনাভাবে লাভ করা যায় না, যদিও এর দ্বারা পরিচয়ের সেতুবন্ধন রচিত হয়ে থাকে। (নায়লুল আওতার : ২ খ: ২৮ পৃ: দারুকুতনী, আবু, দাউদ, বাবে সালাতুত তালেব, সহি মুসলিম, কিতাবুস সালাত)
আল-কুরআনে বার বার ঘোষণা করা হয়েছে, ‘আকিমুস সালাত’ অর্থাৎ সালাত কায়েম কর। কায়েম করা বা প্রতিষ্ঠা করা শুধু কেবল নিজের জন্যই নির্ধারিত নয়। বরং সমভাবে সকলের জন্যই সালাতের প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। সুতরাং সালাত প্রতিষ্ঠার অন্তর্নিহিত মর্ম অনুধাবন করার জন্য যত্মবান হওয়া দরকার।
আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘ইন্না সালাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়াইয়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ অর্থাৎ অবশ্যই আমার সালাত আমার কুরবানী আমার জীবন এবং আমার মরণ কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই নিবেদিত। মোটকথা সালাত সত্যিকারভাবে আল্লাহর জন্যই হতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই মনের কোণে এই জিজ্ঞাসার বুদবুদ ভেসে উঠা অস্বাভাবিক নয় যে, সালাত কেমন করে আল্লাহর জন্য হবে? সালাত কিভাবে আল্লাহর সাথে নিবিঢ় সম্পর্ক স্থাপনের সহায়ক হতে পারে? তবে হ্যাঁ, এই শ্রেণীর জিজ্ঞাসার স্বাভাবিক ও সহজ উত্তর লাভ করার একটি উপায় আছে। আসুন, এই সহজ উপায়টির দ্বারা সালাতের সাথে আল্লাহ পাকের নিগূঢ় সম্পর্কের পরিচিতি লাভ করা যাক। (ক) আরবী ভাষায় আল্লাহ শব্দটি লিখলে চারটি বর্ণ ব্যবহার করতে হয়। যথা-আলিফ, লাম, লাম এবং হা। অর্থাৎ আল্লাহ শব্দটি ঐ বর্ণ চতুষ্টুয়ের দ্বারা গঠিত। অনুরূপভাবে আরবী সালাত শব্দটিতেও মূলত: চারটি বর্ণ রয়েছে।
যেমন-সোয়াদ, লাম, আলিফ এবং তা। কখনো কখনো লেখতে গিয়ে সালাত শব্দটির তৃতীয় বর্ণটি আলিফ-এর স্থলে ওয়াও লেখা হয় এবং এই ওয়াও-এর উপর খাড়া যবর দিয়ে পাঠ করা হয়। এতে করে সালুত পাঠ না করে সালাত পাঠ করা হয়। লিখিত আকারে ওয়াও বণটি ব্যবহৃত হলেও উচ্ছারণে আলিফের প্রাধান্যই বহাল থাকে। সে যাই হোক, সালাত শব্দের তৃতীয় বর্ণটি আলিফ অথবা ওয়াও যা-ই হোক না কেন আক্ষরিক দিক হতে আল্লাহ শব্দের সাথে বর্ণসমষ্টির ভিত্তিতে সালাত শব্দটির গভীর মিল রয়েছে। আল্লাহ শব্দে যেমন চারটি বর্ণ পাওয়া যায়, তেমনি সালাত শব্দেও চারটি বর্ণই দেখা যায়। অতএব একথা বলা খুবই সঙ্গত যে, চার-এর সাথে চার-এর মিল ও বন্ধন একসূত্রে গাঁথা এবং চির অম্লান।
(খ) যিনি সালাত কায়েম করেন, তাকে আরবী ভাষায় মুসল্লী বলা হয়। উচ্চারণের দিক হতে দেখা যায়, এই মুসল্লী শব্দেও চারটি বর্ণই রয়েছে। শুধু তাই নয়, দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করাকে ‘কিয়াম’ বলা হয় এবং বসে আদায় করাকে ‘কুয়ুদ’ বলা হয়। হিসেব করলে দেখা যাবে এই কিয়াম ও কুয়ুদ শব্দদ্বয়েও চারটি বর্ণই স্থানলাভ করেছে। অর্থাৎ মুসল্লী কিয়াম এবং কুয়ুদের হালতেও আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। কেননা, বান্দাহর আল্লাহর দীদার এমনি তরো সত্য প্রতিষ্ঠার দ্বারাই সম্ভব।
(গ) সালাতের প্রতিটি কর্ম-কান্ডই চারবর্ণে গঠিত বাক্যের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন সূরা, কেরায়াত, কাওমা, জলসা, সালাম, রুকু এবং সেজদাহ। এই শব্দগুলোর প্রতি গভীরভাবে তাকালে যে চিত্রটি আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে তাহলো চারবর্ণ সম্বলিত সালাতের অবস্থা ও কাঠামো নির্দেশক কতিপয় শব্দ যা সংখ্যার দিক হতে একে অপরের সাথে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ এবং একইভাবে দেহ-মন উজাড় করে দিয়ে আল্লাহর দীদারের প্রত্যাশায় প্রহর গুণেই চলে। চলার এই গতি যখন কুরআনের নির্দেশ মোতাবেক হয়, তখন আল্লাহর সান্নিধ্য, নৈকট্য ও কুরবতের পথে কোন কিছুই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আর পারে না বলেই মুসল্লীর দেহ-মন সম্পূর্ণরূপে বিকলাঙ্গ, রুগ্ন, রোগাক্রান্ত অবস্থা হতে চিরমুক্ত ও নির্মল পরিবেশে বিরাজ করতে থাকে। এই মধুময় অবস্থার কথা তুলে ধরে আল-কুরআনে ইরশাদ করা হয়েছে, “ইন্নাস সালাতা তানহা ‘আনিল ফাহশায়ি ওয়াল মুনকার।”
অর্থাৎ অবশ্যই সালাত বিরত রাখে নির্লজ্জতা ও অপবিত্রতার হাত হতে। কেননা, যা পবিত্র ও নিষ্কলুষ, যা নিদাগ ও নির্মল, আল্লাহপাক তাকেই পছন্দ করেন এবং যা কদর্য লজ্জাকর ও অমঙ্গলের ধারক ও বাহক, তাকে কখনো পছন্দ করেন না। আর এটাও সত্য যে, যা পছন্দনীয় ও সৌন্দর্যমন্ডিত তার সাথে আল্লাহ পাকের রহমতের গভীর যোগাযোগ রয়েছে। এই যোগাযোগই মূলত : আল্লাহর জন্য নিবেদিতচিত্তে সালাত কায়েমের প্রতি অনুপ্রাণিত করে।
(ঘ) সালাত কায়েমের লক্ষ্যে মুসল্লী কিবলা ও কাবার দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, আরবী কিবলা ও কা’বা শব্দদ্বয়ের চারটি করে বর্ণই রয়েছে। মোটকথা সালাতের সকল অবস্থা চার সংখ্যার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে। এই চার-এর মাধ্যমেই সালাত মূলত : যে আল্লাহর জন্যই হতে হবে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
(ঙ) সালাত কায়েমের লক্ষ্যে বান্দাহ যমীনের উপর দাঁড়িয়ে আত্মবিস্মৃতির অতল তলে হারিয়ে যেতে থাকে। দুনিয়ার সাথে তার কোন সম্পর্কই থাকে না। এমনি করে সে আল্লাহর মহব্বতের সাগরে অবগাহন করার সুযোগ লাভ করে এবং একান্তভাবে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়। এই অবস্থা চতুষ্টয়ের ক্রমবিকাশই সালাত কায়েমে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম এবং বান্দাহর সাথে আল্লাহ পাকের মহামিলনের পথ রচনা করে দেয়। এতেকরেই সালাত তার জন্য মে’রাজরূপে পরিস্ফুট হয়ে উঠে। আর এই অর্থেই সালাত মুমিন বান্দাহর মে’রাজরূপে সুপরিচিত।
(চ) সালাত কায়েমের জন্য তাহুর অর্থাৎ শারীরিক পবিত্রতা একান্ত অপরিহার্য। এই পবিত্রতা অজু এবং গোসলের দ্বারা অর্জিত হয় অথবা তায়াম্মুম-এর দ্বারাও হাসিল হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, আরবী ‘ওয়াজু’ ‘তায়াম্মুম’ এবং ‘ইগসিল’ শব্দত্রয়েও চারটি বর্ণই আছে। মোটের উপর সালাত কায়েমের প্রস্তুুতি কার্য সম্পাদন এবং সালাম প্রদানের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠান হতে মুক্তিলাভ করা সবকিছুই চার সংখ্যার সাথে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা রয়েছে।
(ছ) সালাত কায়েমে মানব দেহ, মন, মুখ, চোখ, হাত, কান ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এ নিবিষ্টতার সবক দান করে। এই এক নিবিষ্টতার ব্যবহারিক দিক চারটি পর্যায়েই বিন্যস্ত। যেমন-কিয়াম (দাঁড়ানো), কুয়ুদ (বসা) রুকু (অবনত মস্তকে ঝুঁকে পড়া) এবং সিজদাহ (যমীনের উপর কপাল স্থাপন) ইত্যাদি। সুতরাং সালাত যেমন চার বর্ণের সমাহার, অনুরূপভাবে ‘কায়েম’ শব্দটিও চার-এরই প্রকাশ। যা কেবলমাত্র আল্লাহকেই নির্দেশ করে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
সাইফ ১৭ জানুয়ারি, ২০১৯, ১০:১২ এএম says : 0
আল্লাহুয়াকবার, লেখক সাহেবকে অনেক ধন্যবাদ এবং ইনকিলাব সংশ্লিষ্ট সকলকেও এত সুন্দর ও গভীর গবেষনা মুলক লেখার জন্যে যা দারা আশা করছি আমার মত অনেকেই অনেক জ্ঞ্যান অর্জনের শুযোগ হল। আল্লাহ্‌ তায়ালা আপনাদের সকলকে এর উত্তম প্রতিদান প্রধান করুন।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন