রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঈদ সংখ্যা

কোনাইয়া

শ্রীলঙ্কার গল্প

ভাষান্তর: হোসেন মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ২ জুন, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

বাসিল ফার্নান্দো

কোনাইয়ার আসল নাম কেউ জানত না। কারো কারো অনুমান যে তার নাম কোরানারিস, যেমন মানাইয়ার নাম ম্যানুয়েল। তবে মানাইয়া ছিল একজন ক্যাথলিক, তাই তার নাম অনুমান করা কঠিন ছিল না। কিন্তু কোনাইয়া হচ্ছে একজন বৌদ্ধ (যদিও সে ধর্মকর্ম করত না), আর কোরানারিস সাধারণ বৌদ্ধ নাম ছিল না। 

এমন নয় যে নামটির কোনো তাৎপর্য ছিল। কোনাইয়া ছিল শ্রীলংকার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জাতিগোষ্ঠির সদস্য। নিজেদের বা অন্যদের কাছে তাদের নাম কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না। কোনাইয়া নিজেও তার নামের কোনো গুরুত্ব আছে বলে মনে করত না।
সম্ভবত একমাত্র যে জিনিসটিকে সে তার নিজের বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ মনে করত তা হলো যে গ্রামে সে তার জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দিল, সে গ্রামের অংশ ছিল না সে। তার বয়স যখন দশ বছর বা এ রকম, তখন সে এ গ্রামে এসেছিল। কিন্তু কে তা জানে? সমাজে সঠিক তারিখ বা সময়ের কোনো গুরুত্ব নেই। এ সমাজেই জীবনটা কেটে গেল তার। সে বলে, সে মাতারা থেকে এসেছে, আর তা নিয়ে কেউ তর্ক করতে যায় না।
শিশু বয়সেই কাজ করতে শুরু করেছিল সে। পুরুষরা বড় হয়ে ওঠে কাজ করার জন্য। এটাই নিয়ম। তার মানে এ নয় যে কোনো লোক যদি কাউকে বাড়ি নিয়ে যায় ও খেতে দেয়, তাকে দিয়ে কাজ করানোর জন্যই তা দেয় এটা বলা আসলে নিষ্ঠুরতা।
সে সব দিনগুলোতে পরিবারের বাইরের কোনো লোককে বোঝা মনে করা হতো না। ভাত রান্নার সময় এ পরিমাণ রান্না করা হতো যে নারী বা পুরুষ কারোরই জন্য তা কম বলে মনে হতো না। গোটা পরিবার একটি আম ভাগ করে খেত এবং যে বাড়িতে থাকত না তার জন্য একটি টুকরো রেখে দিত।
লোকজন খেলা ও কাজ একসাথে করত। একজন লোকের গোটা জীবনই প্রায় কাটত এভাবে। একদিকে কাজের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব আরেকদিকে আমুদে মনোভাব ছিল তাদের সহজাত।
কোনাইয়ার বয়স যখন ১৮ বছর বা কাছাকাছি, সে নিজেই তার কাজ যোগাড় করে নিত। তার জীবনে তখনো কোনো মেয়ের আগমন না ঘটায় গ্রামের সবচেয়ে বয়স্কা মহিলা ঠাট্টা করতে শুরু করল তার সাথে। তারপর গ্রামের লোকজন পাশের গ্রামের এক সুন্দরী তরুণীর সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিল।
তার নিজের কোনো সম্পত্তি ছিল না। গ্রামের একজন সদয় হয়ে নিজের বাড়ির পিছন দিকে তাকে একটা ঘর তোলার অনুমতি দিল। এ জন্য তাকে কোনো ভাড়া বা খাজনা দিতে হতো না। আর এ সামান্য একটু সহযোগিতার জন্য টাকা পয়সা নেয়ার কথা লোকে ভাবতও না। তারা মনে করত যে কোনো ফাঁকা জমি অকারণে পড়ে থাকার বদলে কেউ যদি ব্যবহার করে তাতে ক্ষতি কী? গ্রামবাসীরা এ কথা বুঝত যে ফাঁকা পড়ে থাকা জমি ও অবিবাহিত পুরুষ উভয়েই শূন্যতার শিকার।
গ্রামবাসীদের এত সহানুভূতির মধ্যে কয়েক দশক বাস করেও কোনাইয়া নিজেকে গ্রামের একজন বলে মনে করতে পারেনি। সে খুব গর্বিত লোকÑ গ্রামবাসীরা কোনো কোনো সময় নিজেদের মধ্যে তার সম্পর্কে বলাবলি করত। তার জীবনটা কিছুটা আলাদা ছিল বলেই মনে হয়। অনেকটা তার শৈশবের মতই রহস্যময়। মানিয়ে নেয়ার রহস্যময় অক্ষমতা।
সে যেখানকার লোক ছিল, সে জায়গা ছিল অনেক দূরে। কোনাইয়া সেখানকার লোকদের যেমন চিনত না তেমনি তাকে চেনে এমন লোকও সেখানে কেউ ছিল না। তবে তাতে কিছু আসে-যায় না। কোনো কিছুর সাথেই তার যোগসূত্র ছিল না। তার অর্থ কিন্তু এ নয় যে তার জীবন ছিল খুব দুঃখ-কষ্টে ভরা। আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতই ছিল তার জীবন। পাওয়া বা না পাওয়া নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। এটা সে বুঝত যে অতীত এমন এক বিষয় যার উপর মানুষের কোনো ক্ষমতা নেই। প্রতিটি মানুষ না চাইলেও তার মধ্যে অতীত জেগে থাকে। আর কোনাইয়ার ক্ষেত্রে অতীত তার বর্তমানের উপর জেঁকে বসেছিল।
যদিও এর কোনো কারণ ছিল না তবে সে বোধ হয় ধরে নিয়েছিল যে এ রকমই হয়। সে যেখানে বাস করত সেটি ছিল একটি ক্যাথলিক গ্রাম। সেখানকার লোকদের স্বভাব ছিল পর্তুগিজ আমলের মতো। স্বভাবের ক্ষেত্রে ধর্মের প্রভাব সামান্যই, তা মূলত মানসিক ও সামাজিক।
সে এমন এক জগতের মানুষ ছিল যেখানে এ প্রভাব পড়ার পথ ছিল না। সে নিজের মতো থাকার চেষ্টা করত। তার মধ্যে লুকিয়ে ছিল এক নীরব বিদ্রোহ। সে কথা তার পরিচিত লোকজন বা প্রতিবেশীরা কেউ জানত না, যারা ছিল ভালো ও তার প্রতি সহৃদয়। তার ভিতরে একটি ক্রোধ সুপ্ত ছিল, যার তাৎক্ষণিক কোনো কারণ ছিল না। সে এ ক্রোধটাকে সব সময় পুষে রাখলেও তার কোনো প্রকাশ ঘটত না। বাইরে সে ছিল আর দশজনের মতই শান্ত। তবে সম্ভবত তার স্ত্রী জানত যে তার মধ্যে একটি ক্রুদ্ধ শয়তান বাসা বেঁধে আছে।
কোনাইয়া তার স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসত। তারপরও সে তার সাথে প্রচন্ড ঝগড়া করত। কিন্তু চাইত না যে বাইরের কেউ তা জানুক। তার শান্ত নির্বিবাদী চেহারাটি অক্ষুণœ রাখতে চাইত সে। অন্যদিকে কেউ বলতে পারত না যে সে কোনোদিন কারো সাথে ঝগড়া করেছে। আর সম্ভবত এ কারণেই যখন অন্য গ্রামের দলের সাথে তার গ্রামের দলের এলি খেলা হতো, সেসব খেলায় তাকে আম্পায়ার মনোনীত করা হতো। এ কাজে সে একটি কোট পরিধান করত, আর তখন তাকে একজন প্রকৃত বিচারক বলে মনে হতো। ব্যক্তিগত জীবনে সে যাই করুক আর বলুক সে সবের কোনো গুরুত্ব না থাকলেও সে কোনো খেলায় যে সিদ্ধান্ত দিত তা এতটাই নিরপেক্ষ ও সঠিক হতো যে কেউ কখনো তা চ্যালেঞ্জ করেনি। সবাই বলত, তার সিদ্ধান্ত নির্ভুল।
তার বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়েছিল। এ সময় এক ধনী মহিলা ডেকে পাঠায় তাকে। ঐ মহিলার কয়েক একর পারিবারিক জমি ছিল। জঙ্গলের মধ্যে ছিল সে জমি। মহিলা জমি দেখাশোনার জন্য অনুরোধ জানায় কোনাইয়াকে। সাথে সাথেই সে রাজি হয়ে যায়। জমি দেখাশোনা করতে হলে সেখানে থেকে তা করা দরকার। তাই গ্রাম ছাড়ল সে। সে জন্য একটুও মন খারাপ হলো না তার। মনে হল, একা থাকতেই চাইছিল সে। হয়ত এর ভেতর দিয়ে যে পরিবেশের সাথে সে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিল না বা চাইছিল না, সেই পরিবেশ থেকে সরে যেতে চাইছিল সে।
জঙ্গলে ধনী মহিলার জমি চাষ করতে এসে অতীতের স্মৃতি তার মনে ভিড় করতে শুরু করে। তার চাষ করা জমিটুকু চমৎকার সব্জি খেত হয়ে উঠেছিল। অনেক নারকেল চারা লাগিয়েছিল সে, সেগুলো ফল দিতে শুরু করে। সে এখন সম্পূর্ণরূপে অতীতের অংশ হয়ে ওঠে। ক্যাথলিক গ্রামে বাস করার স্মৃতি তার কাছে অর্থহীন হয়ে যায়।
কোনাইয়ার বয়স হয়েছে। তার কোনো সন্তান ছিল না। তার স্ত্রী এখনো বেশ শক্ত সমর্থ। এ অবস্থায় তার অল্প বয়সী দু’ একজন আত্মীয় তাকে সাহায্য করতে আসে। তারা পৃথক ছোট ঘর তুলে সেখানে বাস করতে থাকে।
সেই ধনী মহিলার কানে এ খবর চলে যায়। ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে সে। কিন্তু সে কোনাইয়াকে ডেকে পাঠায় না বা সরাসরি তাকে কিছু বলেও না। হয়ত সে তার মুখের উপর কিছু বলতে চাইছিল না। কিন্তু বিভিন্ন জনের কাছে সে কোনাইয়ার ব্যাপারে নানা কথা বলতে থাকল। সে জানত, তাহলে তার কানে এ কথা যাবে।
ধনী মহিলার এ নিষ্ঠুর আচরণে খুব দুঃখ পায় কোনাইয়া। সে তার বাড়ি গিয়ে হাজির হয়ে তার সাথে সাক্ষাত করে। কিন্তু মহিলা তাকে কিছু বলে না। সম্ভবত সে লজ্জিত হয়ে পড়েছিল। অথবা কোনাইয়া যে এ বিষয় নিয়ে তার কাছে হাজির হবে এটা সে ভাবেনি। পরে সে শুনতে পেল যে কোনাইয়া তাকে দোষারোপ করছে ও তাকে অভিশাপ দিচ্ছে।
কোনাইয়ার এ ব্যবহারে সবাই অবাক হয়।
এর মধ্যে এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। কোনাইয়ের স্ত্রী মারা যায়। কোনাইয়া স্ত্রীর শোকে ভীষণ কাতর হয়ে পড়ে। স্ত্রীর কফিনের ডালা বন্ধ করার পর সে জ্ঞান হারায়। গুরুতর অসুস্থ হয়ে এক সপ্তাহের মধ্যেই বিছানা নেয় সে।
ধনী মহিলাটি তাকে দেখতে আসে। শোনা গেল, সে কোনাইয়াকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। তার কয়েকদিনের মধ্যেই কোনাইয়ার নিজের ও তার আত্মীয়দের তোলা ঘর ভেঙ্গে দেয়া হলো। গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে ধনী মহিলা কোনাইয়াকে হাসপাতালে নয়, দাতব্য সংস্থা পরিচালিত একটি বৃদ্ধাশ্রমে ভর্তি করে দিয়েছে। সে আর কখনোই ফিরে আসবে না।
কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরই কোনাইয়া ফিরে আসে। তার ঘর ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর সে ধনী মহিলার সাথে দেখা করতে গেল। কিন্তু দেখা পেল না তার। তাকে বলা হলো যে সে কয়েকদিনের জন্য বাইরে গেছে।
কী করবে ভেবে পায় না কোনাইয়া। শেষ পর্যন্ত সে গির্জার যাজকের কাছে গিয়ে অভিযোগ করে মহিলার বিরুদ্ধে। যাজক তাকে রাতে গির্জার বারান্দায় ঘুমানোর অনুমতি দেন। কয়েকদিন পর সে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার কাপড়-চোপড় ময়লা হয়ে যায়। দয়া দেখিয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে দেন যাজক। সেখানে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠে সে।
তবে ধনী মহিলার জমিতে আর ফিরে যায়নি কোনাইয়া। দূরবর্তী যে গ্রাম থেকে ছোটবেলায় চলে এসেছিল সেখানেই ফিরে যায় সে। কিন্তু সেখানে তাকে একটু আশ্রয় দেয়ার কেউ ছিল না।
নিরুপায় হয়ে পাশের শহরে ভিক্ষা শুরু করে কোনাইয়া।
*বাসিল ফার্নান্দো শ্রীলংকার বিশিষ্ট কবি ও ছোটগল্পকার। ১৯৪৪ সালে শ্রীলংকার এক গ্রামে তাঁর জন্ম। ১৯৮২ সালে তিনি আইন পেশায় যোগ দেন। ১৯৯০ সাল থেকে তিনি ইউএনএইচসিএইচআর-এর নিযুক্ত আইনজীবী হিসেবে হংকং-এ কর্মরত। সিংহলি ও ইংরেজি উভয় ভাষায়ই তাঁর গ্রন্থ রয়েছে। ১৯৮২ সালে ‘এ নিউ এরা টু এমারজ’ নামে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‘সিক্স শর্ট স্টোরিজ অব শ্রীলংকা’ নামে লী রয় রবিনসনের সম্পাদনায় তাঁর ৬টি ছোটগল্পের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। ‘কোনাইয়া’ ঐ গ্রন্থের অন্যতম গল্প।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন