দেশ ভ্রমণের নেশা অনেক মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সেই সব মানুষের মধ্যে আমিও একজন। আমার পৈতৃক বাড়ি চট্রগ্রাম শহরের অনতিদূরে চাঁন্দগাও গ্রামে। ছোটকালে দেখেছি আমাদের বাড়ির কেউ কেউ রেঙ্গুনে চাকুরী করতেন। কেউ কেউ কলকাতায় পড়ালেখা করতেন। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে কলকাতায় বসবাস করতেন। ওনারা যখন মাঝে মাঝে বাড়িতে বেড়াতে আসতেন, বাড়িতে আনন্দের বন্যা বইতো। আমরা ছোটরা এসব নবাগত আত্মীয় স্বজনদের দেখে পুলক অনুভব করতাম। তাদের আচার-আচরণে কথা-বার্তায় পোষাক-পরিচ্ছদে ভিন্নতর এক জীবনের স্বাদ পেতাম। আর ভাবতাম আহা! আমি যদি এসব দেশ দেখতে পেতাম তাহলে কি মজাই না হতো!
পাকিস্তান সৃষ্টির আগে বাবার সাথে কলকাতায় থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেসময় ওখানে কিছুদিন স্কুলে লেখাপড়াও করেছি। দেশ ভ্রমণের আনন্দ বলতে যা বুঝায় তার স্বাদ তখন পাইনি। তবে জীবনের মধ্যাহ্ন বেলায় আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে অনেক দেশ ভ্রমণ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
১৯৪৭-এ উপমহাদেশ বিভক্তির পর আমার সৌভাগ্য হয় ইডেন কলেজে অধ্যাপনার সময় ছাত্রী পরিষদের ছাত্রীদের নিয়ে সিঙ্গাপুর, হংকং, মালেশিয়া ভ্রমণের। পরে সুদীর্ঘ বাইশ বছর ঢাকার ইডেন কলেজে বাংলা বিভাগে কর্মরত থেকে ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম সরকারী মহিলা কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে নিেেয়াগ পাবার পর এবার আমার সুযোগ মিললো ভারত ভ্রমণের।
সেখানে সহকর্মীদের ঐকান্তিক সহযোগিতায় ও স্বদেশের মানুষের ভালবাসায় কলেজ পরিচালনার নতুন অনুপ্রেরণা পেলাম। পাঁচ বছর চট্টগ্রামে অধ্যক্ষার দায়িত্ব পালন করেছি এবং ছাত্রী-সহকর্মীদের নিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রামের অনেক জায়গায় ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়েছি। তার মধ্যে কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি, চন্দ্রঘোনা, বান্দরবন, কক্সবাজার, রামু, চন্দ্রনাথের পাহাড়, পাহাড়তলী ইত্যাদি। আমার ভ্রমণ যাত্রায় এসব জায়গার অবদানও কম নয়। কিন্তু বেশিদিন চট্টগ্রামে থাকা সম্ভব হয়নি। আমার একান্ত অনিচ্ছা সত্তে¡ও পারিবারিক কারণে ঢাকায় চলে আসতে হলো ১৯৮৬ সালে। কলেজ ছেড়ে আসার আগে ছাত্রী ও সহকর্মীরা আবদার করলো বিদায়ের আগে তাদের নিয়ে ভারত ভ্রমণে যেতে হবে। আমিও বহুদিন ধরে ভারত দেখার একটা ইচ্ছা মনের মধ্যে লালন করে আসছি। সেই যে ১৯৪৭ সালে ১৪ ই আগষ্ট কলকাতা ছেড়ে এসেছি তারপরে এই সুদীর্ঘ ৪০ বছর আর ভারত যাওয়া হয় নাই। প্রস্তাবটা পেয়ে মনে মনে খুশী হলাম। সবার সঙ্গে শিশুকালের সেই স্বপ্নভূমি ভারতবর্ষটা দেখা হবে ও অন্তরঙ্গ পরিবেশে সবার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোও হবে। রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আহম্মদ হোসাইনকে ভারত সফরের টিম গঠনের দায়িত্ব দিলাম। ১৪ জন ছাত্রীসহ ৩২ জন সদস্যের একটা টিম গঠিত হলো। ২৫ শে সেপ্টেম্বর আমাদের যাত্রা আরম্ভ করলাম।
অগ্রগামী দল হিসেবে আমরা অধ্যাপিকারা চিটাগাং থেকে আকাশপথে কলকাতার দম্দম্ এয়ারপোর্টে এসে নামলাম। অন্যদল আহম্মদ হোসাইনের নেতৃত্বে ঢাকায় এসে ইডেন কলেজের ছাত্রী নিবাসে একরাত অবস্থান করে পরদিন সড়ক পথে কলকাতায় এসে পৌঁছলেন। আমরা আকাশ পথে আসার সময় আকাশ ছিল দুর্যোগপূর্ণ। পাইলট ভীষণ দক্ষতা ও সর্তকতার সাথে বিমান চালিয়ে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছালেন। আহম্মদ হোসাইন সাহেবের কাছে শুনলাম তারাও পথে ভীষণ বৃষ্টির সম্মুখিন হয়েছিল। দম্দম্ এয়ারেেপার্ট এসে যখন নামলাম তখনও অবিরাম বর্ষণ চলছে।
সহকর্মী অধ্যাপিকা হোসনে আরা করিমের ভাই মনসুরের ব্যবসায়ী বন্ধু গাড়ি নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল এয়ারপোর্টে। কিন্তু প্রবল বৃষ্টির জন্য গাড়ি সামনের দিকে এগুতে পারছিল না। রাস্তা-ঘাট সব পানিতে সয়লাব। কলকাতা পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব নয়। এয়ারপোর্টের কাছাকাছি নর্থস্টার নামে একটা হোটেলে চার বেড ও দুই বেডের পাশাপাশি দুটি রুম ভাড়া নিতে হলো। এক রুমে আমরা টিচাররা আর এক রুমে সরোয়ার সাহেব ও তার স্ত্রীর থাকার ব্যবস্থা হলো।
এতোদিন পরে কলকাতায় এসে আমার ছেলেবেলার স্মৃতি আবার ভেসে উঠলো মনের আয়নায়। সেই পুরানো কলকাতা একই জরাজীর্ণ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হোটেলের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। রাস্তার ওপারের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে বাঁশের খুঁটিতে তেরপালের ছাদ দিয়ে চায়ের দোকান খুলেছে। হোটেলের পাশেই কচুরীপানাভর্তি একটা ডোবা। ময়লা ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ চারদিকে। মেয়েরা হাঁটু পানিতে লাইনে দাঁড়িয়ে দোকান থেকে কেনাকাটা করছে। রাস্তা-ঘাটে বয়ে চলছে হাঁটু পানির ঢল। হোটেলে আমরা জলবন্দি হয়ে আটকা আছি। সড়ক পথে যারা এসেছে তাদের কোন খবর পাচ্ছি না।
কলকাতার সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছি আমরা। পানি না কমলে কিছু করার নাই। বিকালের দিকে আকাশের অবস্থা একটু ভালো দেখা গেল। অনেক কষ্টে সড়ক পথে আসা দলের নেতৃত্বে যিনি ছিলেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করে- আমরা কলকাতা সদর স্টিটের ডিপ্লোম্যাট হোটেলে এসে উঠলাম। চিটাগাং থেকে যে সমস্ত অধ্যাপিকারা এই সফরে এসেছেন সবাই পাশাপাশি দুইটা রুমে উঠলাম। আর দুই রুমে ছাত্রীরা। পুরুষ টিচারদের জন্যও একটা রুম নেয়া হল।
অধ্যাপক আহম্মদ হোসাইন ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন দিল্লিগামী ট্রেনের টিকেট সংগ্রহের জন্য। আমাদের সফরের শেষ গন্তব্য হচ্ছে পবিত্র আজমীর শরীফ জিয়ারত করা। পথে দিল্লি, আগ্রা, ও জয়পুর দেখা।
আমরা যে হোটেলে আছি তাতে এক সময়ে কবি রবীন্দ্রনাথও ছিলেন। তাঁর ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি এই বাড়ির বারান্দায় বসে লেখা। এখন এই বাড়িটির ভগ্ন দশা। দোতলা বড় বাড়ি । অনেক কক্ষ। প্রত্যেক কক্ষ এখন নানাবিধ ব্যবসায়ীক প্রয়োজনে ব্যবহৃত হচ্ছে। হোটেল, ডাক্তারখানা থেকে শুরু করে রিক্সার গ্যারেজ হিসেবে এই বাড়ির কিছু অংশ ব্যবহৃত হচ্ছে।।
গৌরবময় হাজার স্মৃতি বুকে ধরে রাখা এই বাড়িতে আমিও এসেছি ক্ষণকালের অতিথি হয়ে। একটা বেদনার্ত অনুভূতি অনুভব করলাম। সময় কম, বিকালে মেয়েদের নিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলটা দেখতে গেলাম। সেই ছোটকালে দেখা মেমোরিয়াল হলের কোন স্মৃতি এখন মনে নেই। রাণী ভিক্টোরিয়ার ছবিটা দেখে ভালই লাগলো। পলাশীর আ¤্রকাননের মডেলটি দেখে নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্য সহানুভূতিতে মনটা আর্দ্র হয়ে উঠলো। মেয়েরা উৎফুল্ল মনে বেশ কিছু ছবি তুললো। আমরা ঘুরে ঘুরে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ব্যবহৃত কিছু কাপড়-চোপড় শোকেসে রক্ষিত দেখলাম। আরও দেখার অনেক কিছু ছিল, কিন্তু সময়ের স্বল্পতার কারণে দেখতে পারলাম না। তবে যে কয়দিন কলকাতায় ছিলাম মাঝে মাঝে ছাত্রীদের নিয়ে কলকাতার নতুন কিছু জিনিস দেখে নিলাম। তার মধ্যে পাতাল রেলে চড়া, জাদুঘর দেখা, নিউমার্কেটে ঘোরা ইত্যাদি ছিল প্রধান। তারপরও কলকাতা পুরোপুরি উপভোগ করা সম্ভব হয়নি।
এবার আমাদের যাত্রা শুরু করতে হলো দিল্লীর পথে। আহমদ হোসেন সাহেবের চেষ্টা ও পরিশ্রমে কলকাতার উন্নতমানের ট্রেন রাজধানী এক্সপ্রেসে করে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। ট্রেন তো নয় যেন বিমান! বিকাল ৪.৪৫ মিনিটে (ভারতীয় সময় ট্রেন হাওড়া স্টেশন ছেড়ে গেল। রাত ৮টার দিকে গরম স্যুপ দিয়ে গেল। তারপর এলো রাতের খাবার। সবশেষে এলো ভারতের সবচেয়ে প্রিয় ও বহুল পরিচিত ক-ধিষরঃু আইসক্রিম। ছাত্রীদের মধ্যে খুশির ঝিলিক লক্ষ্য করলাম। আমরা বয়সে প্রবীণ হলেও মনের দিক দিয়ে আমাদেরও আনন্দের কমতি নেই। মাঝে মাঝে ঘোষণা হচ্ছে কতোদূর পথ আমরা পেরিয়ে এলাম। কয়েকজন অধ্যাপিকা আমাদের কম্পার্টমেন্টে যায়গা না পাওয়ার জন্য অন্য কম্পার্টমেন্টে উঠেছিল। তারা হচ্ছেন- উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপিকা জেসমিন আক্তার ও অর্থনীতির জেসমিন সুলতানা। ওদের জন্য মাঝে মাঝে চিন্তিত ছিলাম। স্টুয়ার্ড এন, কে বসু আশ্বস্ত করলেন, চিন্তার কোন কারণ নাই। আমরা তদারকি আছি। তিনি টেলিফোনে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা করে দিলেন।
পরদিন সকাল ১১.৪৫ মিনিটে নতুন দিল্লি স্টেশনে পৌঁছলাম। পাহাড়গঞ্জ মেইন বাজারে হোটেল ‘স্বপ্নাতে’ উঠলাম। সারাদিন হোটেলে বিশ্রাম শেষে পাক-ভারতের অন্যতম সুফি সাধক নিজামউদ্দিন আওলীয়ার মাজার জিয়ারত করতে যাই। মাজারের দেয়ালে লেখা- খধফরবং ধৎব হড়ঃ ধষষড়বিফ. মনটা স্বভাবতই খারাপ হয়ে গেল। মাজার সংলগ্ন উঠানে দাঁড়িয়ে আমরা মহিলারা জিয়ারত করলাম। মাজারের কাছেই স¤্রাট শাহজাহানের আদরের দুলালী জাহানারা বেগম মাটির বিছানায় শায়িত আছে অত্যন্ত সাদামাটা পরিবেশে। মাজার দেখে ভক্তি বিনয়মিশ্রিত সম্মান জানিয়ে আমরা ধীরে ধীরে বেড়িয়ে আসলাম। পরে দিল্লির প্রধান প্রধান যায়গাগুলো দেখতে বের হলাম। প্রথমে গেলাম মোগল স¤্রাট শাহজাহান কতৃক নির্মিত লাল কিল্লায়। তিন হাজার ফিট দৈর্ঘ্য এবং ১৮০০ শত ফিট প্রস্থ বিরাট এলাকা জুড়ে নির্মিত এই কিল্লাটি শ্বেত পাথরের তৈরি। ভিতরে দেখলাম দেওয়ানে আম, রাজ সিংহাসন, মতি মসজিদ ইত্যাদি। এখনো অনেক সুন্দর অবস্থায় আছে। এছাড়াও দেওয়ান-ই খাস, খাস মহল ইত্যাদি অসাধারণ স্থাপত্য শিল্পের স্বাক্ষর বহন করছে। দেওয়ান-ই খাস বা বিশেষ দরবার কক্ষ শাহী মহল নামেও পরিচিত ছিল। এই মহলের মধ্যে ছিল-পৃথিবীর বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসন এবং স¤্রাট শাহজাহানের স্ব-হস্তে দেয়ালে লেখা একটি ফারসী শ্লোক যার বাংলা অর্থ-‘পৃথিবীতে স্বর্গ যদি কোথাও থেকে থাকে তবে ‘এখানে তা ! এখানে তা !! এখানে তা!!!’ এছাড়াও লাল কিল্লার ভেতরে হাতীর দাঁত ও বিভিন্ন সঙ্কর ধাতুর মনোহারী দ্রব্যাদির পসারও দেখলাম। সেখান থেকে লাল বেলে পাথরের তৈরি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দিল্লির জুমা মসজিদের পাশ দিয়ে চলে গেলাম ভারতের নেহেরু পরিবারের সমাধিস্থল শান্তিবনে।
যেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু ও তার তনয়া ইন্দিরা গান্ধী ও সঞ্জয় গান্ধীর সমাধিচিহ্ন রক্ষিত আছে। রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধি দেখে চলে আসলাম ভারতের পার্লামেন্ট দেখতে। গোলাকৃতি সৌধটি হচ্ছে ভারতের আইনসভা। এরপর দেখতে গেলাম নতুন দিল্লিতে রাষ্ট্রপতির ভবন। এই ভবনই সবচেয়ে জাকজমকপূর্ণ সৌধ।
সেখান থেকে আমরা কিংসরোডের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত যুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ইন্দিরাগেট দেখতে যাই। প্রথম মহাযুদ্ধে নিহত ভারতীয় যোদ্ধাদের সম্মানে এই সৌধ নির্মাণ হয়েছিল। সেখান থেকে ১ নম্বর সফদর জং রোডস্থিত ইন্দিরার বাসবভনে (বর্তমানে যার নাম ইন্দিরা মেমোরিয়াল) পৌঁছলাম। অত্যন্ত সাদামাটা একতালা একখানা দালান। ভেতরে ইন্দিরার ছোটবেলার ছবি থেকে শুরু করে ফিরোজ গান্ধীর সাথে বিয়ের ছবি, ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধীকে কোলে নিয়ে তোলা ছবি ইত্যাদি অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাজানো। ইন্দিরার ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র, টেবিল, চেয়ার, খাট, সোফা পরিপাটি করে রাখা। বাড়িটি ঘুরে ফিরে, তার বাসবভন থেকে সামান্য দূরে অফিসে যাওয়ার পথে- যেখানে তাকে গুলিবদ্ধ করে হত্যা করা হয় সেখানে গেলাম। এখনো রক্তের দাগ রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা হয়েছে যার উপরে কাচের তৈরি কাসকেট দিয়ে ঢাকা। এরপর দুপুরের খাওয়া শেষে বের হলাম দিল্লির তথা পৃথিবীর অন্যতম বেলে পাথরে নির্মিত সর্বোচ্চ মিনার, কুতুব মিনার দেখতে। পাঁচতলা বিশিষ্ট্য এই স্তম্ভটি উপরের দিকে ক্রমশঃ সরু হয়ে গেছে। উচ্চতায় ২৩৮ ফিট বিশাল উচু এই মিনার এবং এর গঠন-কৌশল ও গায়ে খচিত কারুকার্য দেখার মতো। ১২৩৬ সালের দিকে ফিরোজ শাহ তোগল এই মিনারের কাজ সম্পন্ন করেন। কুতুব মিনার থেকে দিল্লিতে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের এ্যামবেসি অফিস সমূহের পাশ দিয়ে ১৯৩৮ সালে নির্মিত বিড়ালা মন্দিরে গেলাম। বিড়ালা মন্দিরে তিনটি পৃথক মন্দির রয়েছে। মধ্যে ল²ী নারায়ণের মন্দির, দক্ষিণ দিকে শিব ও বামে শ্রীদূর্গার মন্দির। পরদিন সকালে আমরা রওয়ানা দিলাম দিল্লি থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে আগ্রার তাজমহল দেখতে। আমরা একটি ভিডিও কোচে যাত্রা করেছিলাম। ছবি দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম আগ্রা। আগ্রাফোর্ট গঠনের দিক দিয়ে প্রায় লাল কিল্লার মতো। এর ভিতের দেওয়ানে খাস, অন্দরমহল, খাসমহল, মতি মসজিদ ইত্যাদি। এটি যমুনাতীরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত, যেখান থেকে তাজমহল পুরোটাই সরাসরি দেখা যায়। এই আগ্রাদূর্গের ভিতরে এমন একটি কামরা আছে যার দেয়ালে আয়না লাগানো ছিল, যেখানে তাজমহলের ছবি প্রতিফলিত হতো। এই কক্ষে বসে শেষ বয়সে শাহজাহান সারাক্ষণ তাজমহলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। আগ্রাদূর্গ থেকে এবার চললাম তাজমহল দেখতে। তাজমহল এলাকার ভিতরেও রেডফোর্ট এর মতো মনোহারী দ্রব্যের দোকান রয়েছে বেশ কয়েকটি।
তাজমহলের প্রথম গেইটে নিরাপত্তা তল্লাসি শেষে চত্ত¡রে প্রবেশ করলাম। কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাজমহলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনোরম সে দৃশ্য। পুরো তাজমহলটি শ্বেত পাথরের তৈরি। এসব পাথর জয়পুর, চীন, পারস্য, আফগানিস্থান ইত্যাদি দেশ থেকে আনা। ২০ বছর ধরে ২২ হাজার কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে এই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করেছে। তারপর তাজমহলের ভিতরে প্রবেশ করে সিঁড়ি দিয়েনেমে স¤্রাট শাহজাহান ও মমতাজের আসল কবর দেখতে গেলাম। যাওয়ার পথটি ছিল কিছুটা অন্ধকার।
তবে সেখানকার প্রহরিরা আমাদেরকে টর্চের আলোতে সেখানে নামতে সাহায্য করেছিলো। দুটি কবরই পাশাপাশি। কবওে ঢোকার দরজা ও দেয়ালেরর কারুকার্য দেখে বিমোহিত হলাম। কতোবছর পূর্বে করা এমন নিখুত শিল্পকর্ম! বিমুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। আসল কবর দেখে বেরিয়ে আসলাম দোতালায়, এখানেও নিচের কবরের ঠিক উপরে আসল কবরের হুবহু দু’টি নকল কবর বানানো হয়েছে। দেয়ালের চারপাশে কোরআন শরিফের আয়াত খচিত। এই লেখাগুলি নিচে থেকে একই মাপের। তাজমহলের পাশেই যমুনা নদী।
তাজমহল দেখেই আমরা রওয়ানা দিলাম সেকেন্দ্রার দিকে। যেখানে চির নিন্দ্রায় শায়িত আছেন মোগল স¤্রাট আকবর। তারপরে দিল্লি ফিরে আসার পথে শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান মথুরায় নেমেছিলাম। সেখানে বিরাট মন্দিরে তার মূর্তি, রাম, লক্ষণ ও হনুমানজির মূর্তি, সঙ্কর ধাতুর তৈরি চুড়ির দোকানও আছে। মথুরা থে সোজা চলে এলাম হোটেলে।
পরদিন সকাল ৪-১১-১৯৮৬ তারিখে আমরা ‘পিংক সিটি এক্সপ্রেস’ এ করে বেলা এগারোটার দিকে জয়পুরে আসলাম। দেখতে সুন্দর এই জয়পুর শহরে আমরা মাত্র চারঘষ্টা ছিলাম। সিটির প্রতিটি দালান গোলাপী রঙে রাঙ্গা। গোটা শহরটা জুড়ে স্থাপত্য শিল্পের মনোরম নিদর্শন দেখা যায়। এই জয়পুর শহর এখন ভারত সরকারের তত্ত¡াবধানে পরিচালিত হয়। এই নগরীতে হ্যান্ডিক্রাফটসের (হস্তশিল্পের খুব কদর জনগণের মধ্যে, সরকারী রেইটে এই সমস্থ হস্তশিল্প বেচাকেনা হয়। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে অম্বর প্যালেস যা বর্তমানে রাজাদের ব্যবহার্য জিনিস পত্রের সংরক্ষণাগার হিসেবে রাখা হয়েছে।
বিকেল বেলা ছাত্রী ও অধ্যাপিকারা সবাই শহর দেখতে ও বাজার করার জন্য বের হলাম। সন্ধা পর্যন্ত ঘুরে ফিরে ডিলাক্স বাসে পবিত্র আজমীর শরিফ মাজার জিয়ারতের জন্য রওয়ানা দিলাম। সেখানে পৌঁছালাম রাত ১২ টায়।
খাদেম আলাউদ্দিন চিশতীর বাড়িতে উঠলাম। চট্রগ্রাম মহিলা কলেজ থেকে এসেছি বলে পরম যতেœ আমাদের রাত্রে খাবার এবং থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। প্রতিবছর লাখো লাখো মানুষ এখানে আসে। এই মহান সাধকের কবর জেয়ারতের উদ্দেশ্যে। আমরাও এসেছি একই উদ্দেশ্যে। ভাবতে মনটা অভাবিত পুলকে শিহরিত হয়ে উঠলো, মাজার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে বলে আল্লাহর শুকরিয়া জানাতে পরেরদিন একটা রোজা রাখলাম। সারারাত ধরে কাওয়ালি গানের মূর্ছুনায় মুখরিত গোটা আজমির শরীফ। খাদেম সাহেবের বাড়িতে রাত কাটিয়ে রোজা মুখে দলবল নিয়ে সকালে রওয়ানা দিলাম মাজারের দিকে। ছোট্র একটি ঘরে খাজা বাবা শায়িত। কোনো জৌলুস নেই। মাজারের আঙ্গিনা স¤্রাট শাহজাহান কর্তৃক শ্বেতপাথর দিয়ে তৈরি। গম্বুজগুলো স্বর্ণে মোড়ানে। মাজারে দুইটি মসজিদ আছে। খাজা মঈনউদ্দিন চিশতী (রাঃ) এর দরগায় দুটি মসজিদ আছে, যার একটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স¤্রাট শাহজাহান ও স¤্রাট আকবর। তাদের দেয়া একই রকমের দুটি ডেগও দেখলাম, ওরশের সময় এই দুই ডেগে রান্না করা হয়। হায়দারাবাদের নিজামউদ্দিন তৈরি করে দিয়েছেন মাজারের গেইট এবং মাজারের সাথেই তার স্ত্রীর কবর। এই মাজারে নানা রকম হিন্দুয়ানী ও মুসলমানদের অবাদ গতি,পূজাপার্বণ, মানত , ওরশ এককথায় সবরকমের ধর্মীয় আচার-আচরণ উৎযাপিত হয়। কাওয়ালি গানের সুরের মূর্ছুনায় শহরটাকে অন্যরকম মনে হয়। মাজার ঘরে আমরা ভক্তি বিন¤্র চিত্রে অত্যন্ত ধীর পায়ে ঢুকলাম। থরে থরে সাজানো ঝুড়ি বোর্ডটি গোলাপ ফুলের পাপড়ি রাখা দেখলাম। ভক্তরা যারা যায় হাত ভরে গোলাপ ফুলের পাপড়ি ছিটায় মাজারের উপরে। আমরাও সবাই মাজারের চারদিক ঘিরে ঘিরে গোলাপের পাপড়ি ছড়ালাম। নিজের মনের গোপন কথা যা বলার দোআ দরুদের মাধ্যমে প্রকাশ করে ভক্তি বিন¤্র চিত্রে বেরিয়ে আসলাম। মাজারে পা দিয়ে মনে হলো, গোটা আজমির শরীফটা জেনো অশরীরীক খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রঃ) ঐশী শক্তির হিরন্ময় প্রকাশে উজ্জ্বল আভায় আলোকিত। মাজার থেকে বেরিয়ে গেলাম প্রসিদ্ধ আনা সাগরের তীরে সেখানেও স¤্রাট শাহজাহান পর্যটকদের জন্য শ্বেত পাথরের আসন তৈরি করে রেখেছেন। সেই সঙ্গে রয়েছে খাজা মঈনউদ্দিন চিশতী (রঃ) এর অজু করার জন্য আলাদা ঘাট বাধানো । শ্বেত পাথরের আসনে বসে আনা সাগরের দৃশ্যতো দেখলাম, সেই সাথে আরো দেখলাম-মাজার থেকে একটু দূরে আনা সাগরের
চারদিক বাধানো সিমেন্টের মধ্যেখানে একটা সাপের মূর্তি। বুঝতে বাকী রইলো না এরাও এখানে আসেন। পরদিন সকাল বেলা আমাদের ফিরে আসার পালা। এ সময়ে মোয়াল্লিমের ছেলেরা আমাদের বিদায় জানাতে এসে আমাদের বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান দেখালো। তাদের সঙ্গে এক ধরনের অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠলো। এক ছেলে আসার সময় আমাকে একটা পাথর দিয়ে বলল- এটা পরবেন সবসময়। আল্লাহ বিপদ মুক্তিতে সাহায্য করবেন।
তারপর ৭/১১/১৯৮৬ তারিখ সন্ধা সাতটায় জনতা এক্সপ্রেসে প্রায় আটত্রিশ ঘন্টা জার্নি করে কলকাতা এসে পৌঁছলাম। হোটেল ডিপ্লোম্যাটের একটা রুমে রেখে গিয়েছিলাম মালসামানা। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। অথচ ফ্লাইটের কনফার্মড টিকেট নাই। যেতে হলো ভিসা অফিসে। অনেক অনুরোধের পরে তিনদিন ভিসার মেয়াদ বাড়ানো হল। আহম্মদ হোসেন সাহেব ছাত্রীদের নিয়ে দু’দিন আগেই চলে গেছেন।
অবশেষে ১২/১১/১৯৮৬ তারিখ বেলা ১২ টার সময় আমরা রওয়ানা দিলাম। আমাদের টিকেট ছিলো চিটাগাং যাওয়ার। কিন্তু ঢাকায় নামার জন্য আমরা ওটা বাতিল করে ঢাকার টিকেট করলাম। বিমান বন্দরের কাজ সম্পন্ন করতে কোন অসুবিধা হলো না। পয়ত্রিশ মিনিটে কোলকাতা থেকে ঢাকা এসে নামলাম। এয়ারপোর্টে ইডেন কলেজের অধ্যক্ষা আমাদের প্রিয় হাসনা আপা আমাদের জন্য কলেজ থেকে গাড়ি পাঠিয়েছিলেন। গাড়িটা পাওয়াতে আমরা সবাই নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায় যার যার ঘরে ফিরে আসলাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন