নারী ও শিশু ধর্ষণ বাংলাদেশে মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে নারী ও শিশু ধর্ষণের জগন্যতম ঘটনা। দেশের কোথাও ধর্ষক নামের নরপশুদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না নারী ও শিশুরা। দেশে প্রতি বছর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং ধর্ষণ শেষে নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনা। অপ্রতিরোধ্য নারী ও শিশু ধর্ষণের রাস টানতে ইতোমধ্যে সরকার ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদÐ পর্যন্ত করে আইন করেছে।
শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশে মোট ৪৯৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ৩৫১ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। চলতি বছরের এপ্রিল ও মে এ দুই মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২১৪ শিশু। বাকি চার মাসে ধর্ষণের শিকার হয় ২৮২টি শিশু। প্রতি মাসের গড় হিসেব করলে প্রায় ৮৩টি শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ৫৭১টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে শিশু ধর্ষণ বেড়েছে শতকরা ৪১ শতাংশ যা অত্যন্ত আশংকাজনক। এই বছরের প্রথম ৬ মাসে ধর্ষণ হওয়া এই ৪৯৬টি শিশুর মধ্যে ৫৩ জন শিশুকে গণধর্ষণ করা হয়েছে এবং ২৭টি প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং ২৩ জন শিশুকে ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও এই ৬ মাসে ৭৪টি শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। এ বছর শিশু ধর্ষণের ঘটনা অতিতের যেকোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। শিশু অধিকার ফোরামের মতে, সব ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় না। তাই এই সংখ্যা আরও বেশি হবে বলেই মনে করে সংস্থাটি। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হওয়া বেশিরভাগ শিশুর বয়স ৭ থেকে ১২ বছর। ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা বেশি হন যৌন নির্যাতনের শিকার। বিশেষ করে পুরুষ শিক্ষকের হাতে এই ধরনের নির্যাতনের ঘটনা বেশিঘটে। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১২৯ জন। এদের মধ্যে ১৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
একইসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী, বছরের প্রথম ছয় মাসেই সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩১ জন নারী ও শিশু। যাদের মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ২৬ জনকে। গতবছর সারাদেশে ৯৪২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয় ৬৩ জন নারী ও শিশুকে। অর্থাৎ, গতবছর যে পরিমাণ ধর্ষণ হয়েছে তার অর্ধেক সময়ে এবছর ধর্ষণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় দেড়গুণ।
তিনটি সংগঠনের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনা যেকোনো সময়ের চেয়ে চলতি বছরে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে পেডোফেলিয়া নিয়ে আলোচনা বা গবেষণা কম থাকায়, অধিকাংশ সময় আমাদেরকে আন্তর্জাতিক গবেষণা ও অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করতে হয়। যদিও আমরা সহজভাবে পেডোফেলিয়া বলতে শিশুদের প্রতি বড়দের যৌন আকর্ষণকে বুঝে থাকি এবং এটিকে বিশ্বব্যাপী একটি মানিসিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এটাও প্রমাণিত যে অনুকুল পরিবেশ ও সুযোগ পেলে পেডোফাইল ব্যক্তিও হয়ে উঠতে পারেন ভয়ংকর অপরাধী ও যৌন নির্যাতনকারী। কাজেই বাংলাদেশের এই বিষয়ে আরো গবেষণা ও আলোচনার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। শিশু ধর্ষণের ঘটনা ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণ মূলত অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া, দুর্বল চার্জশিট, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা এবং সর্বোপরি সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বলে মনে করছেন তিনটি সংগঠনের কর্মকর্তারা।
এবার আসি ইসলামে ধর্ষণের কি শাস্তির বিধান রয়েছে সে আলোচনায়। ইসলামে ব্যভিচার সু¯পষ্ট হারাম ও হত্যার পর বৃহত্তম অপরাধ। পবিত্র কোরআন মজিদের সুরা আল ইসরা’র ৩২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আল-আমীন বলেন, ‘আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।’ বিবাহবহির্ভ‚ত যেকোনো যৌন সঙ্গমই পবিত্র ইসলাম ধর্মে গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য। ইসলামি আইন শাস্ত্রে ধর্ষকের কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে এক মহিলাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) ধর্ষককে হদের (কোরআন-হাদিসে বহু অপরাধের ওপর শাস্তির কথা আছে। এগুলোর মধ্যে যেসব শাস্তির পরিমাণ ও পদ্ধতি কোরআন-হাদিসে সুনির্ধারিত তাকে হদ বলে) শাস্তি দেন।’ -ইবনে মাজাহ: ২৫৯৮
হযরত উমর (রা.) এর শাসনামলে সরকারি মালিকানাধীন এক গোলাম এক দাসির সঙ্গে জবরদস্তি করে ব্যভিচার (ধর্ষণ) করে। এতে ওই দাসির কুমারিত্ব নষ্ট হয়ে যায়। হযরত উমর (রা.) ওই গোলামকে কষাঘাত করেন এবং নির্বাসন দেন। কিন্তু দাসিটিকে কোনো শাস্তি প্রদান করেননি।’ -সহিহ বোখারি: ৬৯৪৯
ইসলামে ব্যভিচারের শাস্তি ব্যক্তিভেদে কিছুটা ভিন্ন হয়ে থাকে। ব্যভিচারী বা ধর্ষক যদি বিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে পাথর মেরে মৃত্যুদÐ দেওয়ার বিধান রয়েছে। আর ধর্ষক যদি অবিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে একশ ছড়ি মারা হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ব্যভিচারিণী নারী-ব্যভিচারী পুরুষ, তাদের প্রত্যেককে একশ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর করার কারণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ইসলামে ধর্ষণের শাস্তি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।’ -সূরা নূর: ২ হাদিসে বলা হয়েছে, ‘অবিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে শাস্তি একশ বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর। আর বিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে একশ বেত্রাঘাত ও রজম অর্থাৎ পাথর মেরে মৃত্যুদÐ। -সহিহ মুসলিম ধর্ষণের ক্ষেত্রে একপক্ষে ব্যভিচার সংগঠিত হয়। আর অন্যপক্ষ হয় নির্যাতিত। তাই নির্যাতিতার কোনো শাস্তি নেই। কেবল অত্যাচারি ধর্ষকের শাস্তি হবে।
সম্প্রতি পাশ হওয়া বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের কারণে মৃত্যু হলে মৃত্যুদÐের বিধান করা হয়েছে। ইসলামে বিবাহিত কেউ ধর্ষণ বা ব্যভিচার করলে তার শাস্তিও পাথর মেরে মৃত্যুদÐের কথা বলেছে। [তথ্যসূত্র : মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী]
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন