মৃত্যু অবধারিত। আল্লাহপাক মৃত্যুর যে সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেই সময়েই মৃত্যু হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, আমি তোমাদের মৃত্যুর সময় ঠিক করে দিয়েছি। আর নির্ধারিত সময়ের পূর্বে মৃত্যু হবে না। (সূরা ওয়াকিয়া : ৬০)। তিনি আরও বলেছেন, জীবিত মাত্রেরই মৃত্যুর স্বাদ পেতে হবে। (সূরা আনকাবুত : ৫৭)।
জীবনের মালিক যেমন আল্লাহ, তেমনি মৃত্যুর মালিকও। উপযুক্ত কারণ ছাড়া কারো মৃত্যু ঘটানোর বা হত্যা করার কোনো এখতিয়ার আল্লাহ কাউকে দেননি। এমনকি আত্মহত্যা করার অধিকারও কারো নেই। জীবন ক্ষণস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী- যাই হোক না কেন, আল্লাহর দৃষ্টিতে তা অত্যন্ত মূল্যবান। জীবনের অপরিসীম গুরুত্ব ও মূল্যের কথা তিনি বলেছেন এভাবে- নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ করার জন্য কেউ কাউকে হত্যা করল সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষকে হত্যা করল। আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করল সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করল। (সূরা মায়েদা : ৩২)।
মহান আল্লাহর কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ হত্যা করাকে অনুমোদন দিয়েছেন। তিনি হত্যার দায়ে হত্যার অনুমোদন দিয়েছেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : হে বিশ্বাসীগণ, নরহত্যার ব্যাপারে তোমাদের জন্য কিসাসের (বদলা) নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, ক্রীতদাসের বদলে ক্রীতদাস ও নারীর বদলে নারী। কিন্তু তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে কিছুটা ক্ষমা প্রদর্শন করা হলে সম্মানজনক ব্যবস্থার অনুসরণ ও সদয়ভাবে তার দেয় পরিশোধ করা উচিত। (সূরা বাকারা : ১৭৮)। এ ছাড়াও হত্যাযোগ্য অপরাধে বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়া ব্যক্তির হত্যা কার্যকর করার অনুমোদনও রয়েছে আল্লাহর তরফ থেকে। এর বাইরে কাউকে হত্যা করা গুরুতর অপরাধ এবং আল্লাহ এ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন : আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন, যথাযথ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করো না। (সূরা বনী ইসরাইল : ৩৩)। কেউ কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করলে আল্লাহপাক বলেছেন : তার শাস্তি জাহান্নাম, যেখানে সে চিরকাল থাকবে। (সূরা নিসা : ৯৩)।
দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, আমাদের দেশে অন্যায় ও ইচ্ছাকৃত হত্যাকান্ড মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। অতি সা¤প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাকান্ডগুলোর মাঝে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদের নির্মম-নৃশংস হত্যাকান্ড দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। কী অপরাধ ছিল তার? দৃশ্যত কোনো অপরাধ ছিল না। আবরার ফাহাদ তার একটি স্ট্যাটাসে বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি ও সমঝোতার বিষয়ে মন্তব্য করেছিল। সেই মন্তব্যে কারো প্রতি বিদ্বেষ ও আক্রমণ ছিল না। সেটা ছিল তার হৃদয়ের একান্ত অনুভূতি ও তার সহজ উচ্চারণ। এই অপরাধে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দলবেঁধে তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। তারা এতটাই সীমার যে, তাকে পানি পর্যন্ত দেয়নি। মানুষ যে মানুষকে এভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে, তা বিরল না হলেও বর্ববতার চ‚ড়ান্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবরার ফাহাদ হত্যার বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা হত্যাকারীদের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করি। উল্লেখ করা যেতে পারে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত শিক্ষাঙ্গনে ১৫১টি হত্যাকান্ড ঘটেছে। এসব হত্যাকান্ডের অধিকাংশের কোনো বিচার হয়নি।
শুধু শিক্ষাঙ্গনে নয়, সারাদেশে এখন খুন-গুম ও অপহরণের রীতিমতো সয়লাব বয়ে যাচ্ছে। পাল্লা দিয়ে ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যাকান্ডের ঘটনাও বাড়ছে। বিশেষভাবে শিশুরা হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছে। ক’দিন আগে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার রাজানগর গ্রামে সংঘটিত হয়েছে এক লোমহর্ষক শিশু হত্যার ঘটনা। প্রতিপক্ষকে জব্দ করার জন্য শিশুটিকে ঘুমন্ত অবস্থায় তুলে নিয়ে গিয়ে পিতা ও চাচা মিলে হত্যা করেছে। হত্যার সঙ্গে সঙ্গে তার লিঙ্গ ও কান কাটা হয়েছে। এত বড় নিষ্ঠুরতা কোনো পিতা-চাচা করতে পারে, এটা কল্পনাও করা যায় না। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ৫ বছরে মা-বাবার হাতে অন্তত ৩৩৫ জন শিশু নিহত হয়েছে। সন্তানের প্রতি মা-বাবার স্নেহ-মমতার কোনো তুলনা হয় না। সন্তানের জন্য মা-বাবা জীবন পর্যন্ত দিতে পারে, এমন নজির কম নেই। অথচ এমনই কাল পড়েছে, সন্তান মা-বাবার কাছে নিরাপদ নয়। শিশু হত্যা আরো নানাভাবে বাড়ছে। পরিসংখ্যান মতে, গত ৫ বছরে ১ হাজার ৬৩৪ জন শিশু নিহত হয়েছে। গত ৯ মাসে নিহত হয়েছে ৩২০ জন। প্রতিদিন গড়ে ৩৫ জন শিশু হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে।
খুনখারাবি বস্তুতপক্ষে অতি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। মা-বাবার হাতে সন্তান, সন্তানের হাতে মা-বাবা, স্ত্রীর হাতে স্বামী, স্বামীর হাতে স্ত্রী, ভাইয়ের হাতে ভাই, বন্ধুর হাতে বন্ধু, প্রতিপক্ষের হাতে প্রতিপক্ষ হরহামেশাই খুন হচ্ছে। এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভ‚ত হত্যাকান্ড এবং গুমের অভিযোগও পুরনো। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাবে, গত ৯ মাসে দেশে বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ড হয়েছে ৩১৫টি। এর মধ্যে ৩০৬ জন তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। ১ জনকে পিটিয়ে, ৪ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অবশিষ্ট ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে নির্যাতনে। এই সময়ে গুমের ঘটনা ঘটেছে ২৪টি আর কারাগারে মৃত্যু হয়েছে ৪৯ জনের।
নানাভাবেই মানুষ হত্যার শিকার হচ্ছে। অথচ একটা হাত্যারও যথাযথ বিচার হচ্ছে না। বিচার হচ্ছে না বলে হত্যাকান্ডও থামছে না। এই অস্বাভাবিক ও অবাঞ্ছিত হত্যাকান্ডের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিহত ব্যক্তি তার নিহত হওয়ার কারণ জানে না, ঘাতক বা ঘাতকরাও জানে না কেন সে বা তারা হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছে। এ অবস্থা কিয়ামতের পূর্ব লক্ষণ হিসাবে গণ্য। মহানবী সা. একটি দীর্ঘ হাদিসে কিয়ামতের আলামত বর্ণনা করেছেন। সেই হাদিসে আছে : এমন একটা সময় আসবে, যখন হত্যাকান্ড ব্যাপক আকার ধারণ করবে। নিহত ব্যক্তি জানবে না, কেন তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং হত্যাকারী বুঝবে না, কেন সে হত্যা করছে।
আমরা কি তাহলে সেই সময়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি? জ্ঞানী, বিচক্ষণ ও সচেতন ব্যক্তিরা এমতাবস্থায় উদ্বিগ্ন ও বিচলিত। এখনই হত্যাকান্ডের রাশ টেনে ধরা না গেলে ভবিষ্যতে আরও বিপর্যয়কর পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। আল্লাহর রোষানলে পড়াও অসম্ভব নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন