তাসাওউফ বা আত্মশুদ্ধির মূল কথা
তাসাওউফ, তাযকিয়া, তরিকত, ইহসান ইত্যাদি শব্দগুলো সমার্থবোধক। যার বাংলা অর্থ দাড়ায় আত্মশুদ্ধি বা অন্তরকে পাক-পবিত্র করা। অন্তরকে সর্ব প্রকার চারিত্রিক ও আত্মিক রোগ-ব্যধি থেকে পবিত্র রাখার জন্য এই আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন হয়। যার মূল কথা হলো, ভিতর-বাহিরকে নেক আমল দ্বারা সজ্জিত করা এবং বদ আমল ও গুনাহ থেকে বাঁিচয়ে রাখা। আখলাক-চরিত্রকে সংশোধন করা এবং অন্তরকে এ পরিমাণ পাক-পবিত্র করা যে, তার ভিতর-বাহিরের সর্ব প্রকার নিকৃষ্ট গুণাবলীর প্রতি ঘৃণা ও সর্ব প্রকার উৎকৃষ্ট গুণাবলীর প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। [ইসলাহী নেসাবে সংযুক্ত কাসদুস সাবীল:৭৮৫, ৭৯১; ইসলাহী মাজালিস:১/৪১] তাযকিয়া-তাসাওউফ মূলত ইসলামী শরীআতেরই নেহায়েত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। যা ছাড়া ঈমান ও ইসলাম পরিপূর্ণ হতেই পারে না। যার অনুপস্থিতিতে মুমিনের জীবনে আসতে পারে না পূর্ণ সাফল্য এবং মুমিন পৌছতে পারে না তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে। তাসাওউফের ব্যাপারে মুজাদ্দিুল মিল্লাত হাকীমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী রহ. বলেন, ‘তাসাওউফের সারনির্যাস অথচ খুব সংক্ষিপ্ত কথা হলো, কোনো নেক কাজ করতে অলসতা লাগলে তার মুকাবিলা করে তা করে ফেলা এবং নফস কোনো গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকতে ঢিলেমি করলে তার মুকাবিলা করে সেই গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। এতটুকু করার দ্বারাই আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, সম্পর্কের উন্নতি হয় এবং তা স্থায়ী হয়।’ [ইসলাহী মাজালিস:১/৭৯-৮০] এই কথাটি কে বলেছেন? কথাটি বলেছেন হাকীমুল উম্মাত মুজাদ্দিুল মিল্লাত শাহ আশরাফ আলী থানভী রহ.। যিনি তাযকিয়া, তাসাওউফ ও তরীকতের এক মহান সংস্কারক। যিনি এই বাগানের প্রতিটি গাছের প্রতিটি পাতায় পাতায় বিচরণ করেছেন এবং যিনি এই পথের প্রতিটি ধূলিকণা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন। তিনিই বলেছেন তাসাওউফ বা আত্মশুদ্ধির মূল কথা বা সারনির্যাস হলো, নেক কাজে অলসতার মুকাবিলা করা। যেমন নামায পড়তে অলসতা লাগছে বা মসজিদে গিয়ে জামাতে শরীক হতে মন চাইছে না। ঘরেই পড়তে মন চাইছে কিংবা নামায ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে। তাহলে তার চিকিৎসা হলো, গা ঝাড়া দিয়ে অলসতার আড় ভেঙে হিম্মতের সাথে এই অবস্থার মুকাবিলা করা। মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে নামায আদায় করে নেওয়া। মোটকথা অলসতার মুকাবিলায় হিম্মতকে কাজে লাগাতে হবে। তাহলেই অলসতা বা ঢিলেমি দূর হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। নতুবা অলসতা অক্টোপাসের মতো আকড়ে ধরবে। কারণ অলসতার চরিত্রই হলো, তার কাছে যতই অত্মসমর্পণ করা হবে ততই সে আধিপত্য বিস্তার করবে। আজ সুন্নত থেকে দূরে রাখবে তো আগামীকাল ফরয থেকে দূরে রাখবে। আজ একটি ফরয থেকে দূরে রাখবে তো আগামীকাল আরেকটি ফরয থেকে দূরে রাখবে। এভাবে আজ একটি গুনাহ করালে পরদিন আরেকটি গুনাহ করাবে। এটিই তার চরিত্র। আর হিম্মতের সাথে কঠিনভাবে তার মুকাবিলা করা হলে আস্তে আস্তে সে দুর্বল ও অকেজো হয়ে পড়ে। [ইসলাহী মাজালিস:১/৮০]
আত্মশুদ্ধির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
এই তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্য হলো, গাফলত ও উদাসিনতার পর্দা দূর করে মুমিনের অন্তরে ঈমানী নূর পয়দা করা। সে নূরের আলোতে চলা-ফেরা ও উঠা-বসা সর্বদায় আল্লাহর জাতের ভয় অন্তরে জাগ্রত রাখা। আর আত্মার জন্য অর্জন করার মতো যত গুণ-বৈশিষ্ট্য আছে তার সবই অর্জন করা। সর্ব প্রকার আত্মার ব্যাধি সমূহ থেকে মুক্ত হয়ে এগুলোকে নির্মুল করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো। যাতে করে এসবের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় এবং ‘আল্লাহর ইবাদত এভাবে কর যেন তুমি তাঁকে দেখছো। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তত এ কল্পনা করো যে, স্বয়ং আল্লাহ তোমাকে দেখছেন।’ [মুসলিম: ১/২৭] এর মাকাম অর্জিত হয়ে যায়। তাসাওউফ ও তাযকিয়ার যাবতীয় মেহনতের আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ইহাই। বিশেষ সংখ্যার যিকরের তালীম ও অন্যান্য আমল আসল মাকসুদ নয় এবং শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে ওয়াজিব, ফরজও নয়; বরং এ সকল বিশেষ পদ্ধতি মূলত আত্মিক রোগ দূর করার চিকিৎসা ও তদবীর মাত্র। যা একজন শায়খে কামিল ও হক্কানী পীর সাহেব তাঁর মুরীদদের অবস্থা ও প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে বাতলে দিয়ে থাকেন। এখন যদি কোনো ব্যক্তি এগুলোকেই আসল মনে করে বসে এবং চুড়ান্ত মাকসূদ নিজ চরিত্র সংশোধন ও আত্মশুদ্ধি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়, তাহলে নিশ্চয় সে ভ্রান্তিতে রয়েছে এবং তাসাওউফ ও তাযকিয়ার প্রকৃত হাকীকত থেকে একদম বেখবর। [ইসলাহী মাজালিস:১/৪৯]
আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব ও উপকারিতা
মুমিনের অন্তর যখন পরিশুদ্ধ ও আলোকিত হয় এবং নিজ আখলাক-চরিত্র সংশোধন হয়, তখন তার জন্য আল্লাহ তাআলার রেযা-সন্তুষ্টি অর্জন সহজ হয়ে যায়। আর যে মুমিন আল্লাহর সন্তুষ্টি পায়, সে যে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতর মানুষ তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ জন্যই আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম যিম্মাদারী ছিল সাহাবায়ে কিরামের তাযকিয়া বা আত্মশদ্ধি। পবিত্র কুরআনে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দায়িত্ব ও জিম্মাদারীর বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলাই নিরক্ষরদের মাঝে তাদেরই স্বগোত্রীয় একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন। তিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতসমূহ, পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করেন তাদের আত্মাকে এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত।’ [ জুমুআ: ২] সাহাবায়ে কিরামের মাঝে ইসলাহ ও আত্মশুদ্ধির এই পবিত্র দায়িত্ব তিনি আঞ্জাম দিয়েছেন যথাযথভাবে। তাই তার নূরানী সুহবত ও শানদার তরবিয়াতের বদৌলতে সাহাবায়ে কিরাম উম্মার শ্রেষ্ঠতর কাফেলার আসনে আসীন হয়েছেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে পেয়েছেন তাঁর আগাম রেযা ও সন্তুষ্টির ঘোষণা। আর নবুওয়াতের ভাষায় ‘নুযূমে হিদায়াত’ তথা হিদায়াতের উজ্জল নক্ষত্ররাজীর উপাধি পেয়েছেন। ইসলাহ ও আত্মশুদ্ধির পর তাঁদের অবস্থা কি হয়েছিল? সে সম্পর্কে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর বর্ণনা হলো, কারো অনুসরণ করতে চাইলে সে যেন মৃত ব্যক্তিদের অনুসরণ করে। কারণ জীবত মানুষ ফিতনা থেকে নিরাপদ নয়। সেই ফিতনামুক্ত অনুসরণীয় ব্যক্তিরা হলেন হযরাত সাহাবায়ে কিরাম। তাঁরা ছিলেন এই উম্মতের সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ। যাদের আত্মা ছিল পূণ্যে পরিপূর্ণ, ইলমে ভরপুর। আর কৃত্রিমতা ছিল নিতান্ত কম। যাদেরকে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবীর সাহচার্য, স্বীয় দীনের সংরক্ষণ ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য নির্বাচন করেছিলেন। তাই তোমরা তাদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব সর্ম্পকে অবগত হও এবং তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ কর। আর সর্বশক্তি দিয়ে তাঁদের আখলাক ও সীরাতকে দৃঢ়তার সাথে আকড়ে ধর। কারণ তাঁরা ছিলেন সঠিক পথের উপর প্রতিষ্ঠিত। [মিশকাত :১/৩২] মোদ্দা কথা, অন্তরকে সর্ব প্রকার চারিত্রিক ও আত্মিক রোগ-ব্যধি থেকে পবিত্র করা, নিজ আখলাক-চরিত্রকে সংশোধন করা এবং নেক আমলের অভ্যাস গড়ে তোলা প্রত্যেক মুমিনের অবশ্য কর্তব্য ও অপরিহার্য দায়িত্ব। এ জন্য প্রয়োজন একজন শায়খে কামিলের হাতে বাইআত হয়ে তাঁর সুহবত গ্রহণ ও প্রবল প্রচেষ্টা এবং উন্নত সাহস। মূলত তাসাওউফ ও আত্মশুদ্ধির পথে যে যত বেশি অগ্রসর হবে, আল্লাহর নৈকট্যও সে তত বেশী অর্জন করতে পারবে এবং সিক্ত হবে মাওলায়ে পাকের অবারিত রহমতের বারি ধারায়।
পীর-মুরীদী ও বাইআতের হাকীকত
হযরত থানভী রহ. বলেন, বাইআত ও পীর-মুরীদীর হাকীকত বা বাস্তবতা হলো, পীর সাহেব তাঁর মুরীদকে যিকর ও আল্লাহর হুকুম বলে দেওয়ার ওয়াদা করেন আর মুরীদ এ কথার স্বীকারোক্তি করে যে, তার পীর সাহেব যা বলবেন, সে তা অবশ্যই পালন করবে। মুরীদ হওয়ার প্রচলিত পদ্ধতির বাইরেও পীর সাহেব তালীম দিতে পারেন এবং মুরীদ তাঁর তালীম অনুপাতে আমল করতে পারেন। এভাবে মুরীদ হওয়ার মাঝে এই বৈশিষ্ট ও উপকার রয়েছে যে, এতে করে সেই মুরীদের প্রতি পীর সাহেবের তাওয়াজ্জুহ বা মনোযোগ অধিক হয়ে থাকে। মুরীদও পীর সাহেবের কথা পালনের ব্যাপারে অধিক যতœশীল হয়ে থাকে। তাসাওউফের ইমামগণ বলেন, একজনকেই পীর ধরবে এবং নিজের পীর সাহেবকে সমকালীন যুগের সকল পীর সাহেবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করবে। এতে পীর-মুরীদ উভয়ের মাঝে বন্ধন ও সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। [ইসলাহী নেসাবে সংযুক্ত কাসদুস সাবীল:৮০৭]
পীর সাহবে ও মুরীদের দায়িত্ব
পীর সাহেবর দায়িত্ব এক ধরনের আর মুরীদের দায়িত্ব আরেক ধরনের। উভয়ের দায়িত্ব আলাদা আলাদা। পীর সাহেবের কাজ হলো মুরীদকে আমল, ওযীফা, মেহনতের পথ-পদ্ধতি ইত্যাদি বলে দেওয়া। আর মুরীদের কাজ হলো, সে আমল ও ওযীফাগুলো পীর সাহেবের বাতলানো পথ-পদ্ধিতে ঠিক-ঠাক মতো আদায় করা। যথানিয়মে মেহনত-মুজাহাদা করা। আমল ও ওযীফা আদায় না করে কেবল পীর সাহেবের দুআ, নেক নযর ও তাওয়াজ্জুহ ইত্যাদি লাভের আশায় বসে থাকলে কাজ হবে না। মেহনত-মুজাহাদা ও আমল নিজেকেই করতে হবে। এগুলো পীর সাহেব করে দিবেন না। এ বিষয়ে হযরত থানভী রহ. বলেন, পীর সাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক হলো ডাক্তার ও রোগীর মতো। ডাক্তার ঔষধ দিল। কিন্তু রোগী ঔষধ সেবন করলো না। তাহলে কেবল ডাক্তারের আদর, ভালোবাসা ও মনোযোগের কারণে সে সুস্থ হবে না। স্স্থু হতে হলে ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র মেনে ওষুধ খেতে হবে। তাহলেই সে সুস্থ হতে পারে। পীর-মুরীদের সম্পর্কটাও এমনই। ইসলাহ ও আত্মশুদ্ধির জন্য কেবল মাত্র পীর সাহেবের দুআ ও তাওয়াজ্জুহই যথেষ্ট নয়। এ জন্য জরুরী হলো পীর সাহেবের বাতলানো পথে নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলা। তাঁর বাতলানো আমলগুলো যথানিয়মে করতে থাকা। পীর সাহেব কেবল পথ দেখাবেন। পথ নির্ধারণ করে দিবেন। আত্মার চিকিৎসা জন্য ব্যবস্থাপত্র বলে দিবেন। সে পথে নিজেকেই চলতে হবে। নিজেকেই অতিক্রম করতে হবে সে পথ। তাঁর ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী কাজ করতে হবে নিজেকেই। এ ক্ষেত্রে কেবল পীর সাহেবের দুআ, নেক নযর ও তাওয়াজ্জুহের পথ চেয়ে বসে থাকলে চলবে না। তবে মুরীদের জন্য পীর সাহেবের দুআ, নেক নযর ও তাওয়াজ্জুহ ফেলনা নয়। শায়খের দুআ ও তাওয়াজ্জুহ মুরীদের জন্য এক অমূল্য নিয়ামত। মুরীদের মেহনত-মুজাহাদা ও আমলে এগুলো বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। শায়খের বাতলানো ওযীফা আদায়ে সহযোগী হয়। মনোবল ও হিম্মত শক্তিশালী হয়। জীবনের মোড় পরিবর্তন হয়। কিন্তু কাজ নিজেকেই করতে হবে। এ রাস্তা নিজেকেই অতিক্রম করতে হবে। [ইসলাহী মাজালিস:১/৪১৭-৪১৯] তো বুঝাগেল পীর সাহেবের দায়িত্ব হলো, ইসলাহ ও আত্মশদ্ধির পথ ও পদ্ধতি নির্ধারণ করে দেওয়া। আমল-ওযীফা বলে দেওয়া। আমল-আখলাক ও চরিত্র সংশোধনের ব্যবস্থাপত্র বাতলে দেওয়া। কিভাবে চললে ভিতর-বাহির পরিশুদ্ধ হবে, আমলে শওক-যওক পয়দা হবে, ঈমানের মজা অনুভূত হবে, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হবে, দুনিয়া ও মাখলুকের সাথে সম্পর্ক দর্বল হবে পীর সাহেব ইত্যাদির পথ ও পদ্ধতি বলে দিবেন। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন