উত্তর : যে-কোনো যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে শত্রু পক্ষ সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত হওয়া। শত্রুর দুর্বলতা কোথায়, তার শক্তি কোথায়, সে কীভাবে কোন পথে কাজ করে, কীভাবে তাকে পরাজিত করা যায় তা নিয়ে গবেষণা করা। তাহলেই শত্রু র সাথে যুদ্ধে জেতা সম্ভব। শয়তান আমাদের আদি শত্রু। চির শত্রু । মহা শত্রু । তার এ শত্রু তা মানবজাতির আদি পিতা থেকে নিয়ে সৃষ্টির শেষ মানুষটি পর্যন্ত দীর্ঘ। এ কারণে আমাদের ভালো করে জানা দরকার শয়তান কীভাবে কাজ করে। শয়তান প্রতিনিয়ত মানুষকে কিভাবে পথভ্রষ্ট করা যায় সেই অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকে। ইরশাদ হয়েছে, ‘শয়তান তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। ফলে তাদের ভুলিয়ে দিয়েছে আল্লাহর স্মরণ। তারা শয়তানের দল। সাবধান! শয়তানের দল অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত।’(সুরা : মুজাদালা, আয়াত : ১৯) তার প্রলোভন ও প্রতারণা থেকে বাঁচতে পারে না আলেম-জাহেল, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ- কেউই। সর্বত্র সবার জন্য সে পুতে রেখেছে অকল্পনীয়-অবর্ণনীয় পাপের বীজ। পৃথিবীব্যাপী সে বিছিয়ে রেখেছে অজস্র মোহজাল। পেতে রেখেছে অসংখ্য কুটিল ফাঁদ। সূক্ষ্ম-স্থূল সকল প্রকার ফন্দিতে শয়তান অদ্বিতীয়। শয়তান আমাদেরকে যেভাবে প্ররোচনা দেয় সেই পদ্ধতিগুলো নিয়ে মহান আল্লাহ আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। যেন সহজ সরল বান্দাগন তার প্ররোচনায় লিপ্ত হয়ে তার স্রষ্টার অবাধ্যতায় লিপ্ত না হয়। পবিত্র কোরআনে ‘শয়তান’ (এক বচন-বহু বচন) শব্দটি ৮৮ বার আর ‘ইবলিস’ শব্দটি ১১ বার উল্লেখ করা হয়েছে। বন্ধু সেজে ধোকা দেওয়া : শয়তান আদম ও হাওয়া (আ.)-কে বন্ধু সেজে অভিনব কৌশলে ধোঁকা দিয়েছে। যার সীহত শুনে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়েছেন। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘অতঃপর শয়তান উভয়কে প্ররোচিত করল, যাতে তাদের অঙ্গ, যা তাদের কাছে গোপন ছিল, তাদের সামনে প্রকাশ করে দেয়। সে বলল, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের এ গাছ থেকে নিষেধ করেছেন, তবে তা এ কারণে যে, তোমরা না আবার ফেরেশতা হয়ে যাও কিংবা হয়ে যাও এখানে চিরকাল বসবাসকারী। সে তাদের কাছে কসম খেয়ে বলল, আমি অবশ্যই তোমাদের হিতাকাঙ্খী।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ২১-২১)
আমাদের সমাজে ঘাপটি মেরে অনেক শয়তান রয়েছে যারা বন্ধু সেজে মানুষকে প্রতিনিয়ত ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে এবং কাদের বর্জন করতে হবে এ ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আমাদের পথ দেখিয়েছেন কারণ মানুষের কর্ম, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয় বন্ধুত্বের কল্যাণে। পবিত্র কোরআনে কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘আর ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার নারী একে অপরের বন্ধু। তারা ভালো কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠিত করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন-যাপন করে। তাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী সুকৌশলী। (সূরা আত তওবা: ৭১)
শয়তান মানুষকে সরাসরি কোনো আক্রমণ না করে ধীরে ধীরে ইসলামের বিধান থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। এটা হলো শয়তানের সূক্ষ্ম কূটচাল। শয়তান সর্বপ্রথম মানুষকে এভাবে প্ররোচনা দেয়, নামাজের সময় হলে সে মানুষকে বলতে থাকে এখনো অনেক সময় বাকি আছে। যখন নামাজের ওয়াক্ত একদম শেষ পর্যায়ে চলে আসে, তখন শয়তান বলে, কাজটা খুবই জরুরি; আচ্ছা কাজা নামাজটা আজ পরের ওয়াক্তের সময় কাজা করে নিলেও হবে। এভাবে সে মানুষকে বেনামাজিতে পরিণত করে। রোজার ক্ষেত্রে সেহরির সময় হলে শয়তান বলতে থাকে আরো অনেক সময় আছে; আর কিছুক্ষণ পরে ওঠলেও চলবে; যখন ওয়াক্ত চলে যায়; তখন বলতে থাকে বিনা সেহরিতে রোজা রাখবে; এভাবে সে মানুষকে সূক্ষ্মভাবে রোজা থেকে বিরত রাখে। হজের ক্ষেত্রেও সরাসরি নেতিবাচক কিছু না বলে বিভিন্ন অজুহাত মানুষের সামনে তুলে ধরে। ধীরে ধীরে হজের প্রতি পুরোপুরি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে ফেলে। আল্লাহর প্রতিটি বিধান নামাজ, রোজা, হজের ক্ষেত্রেও শয়তান মানুষকে এভাবে ধোঁকা বা প্রতারণার মাধ্যমে ফিরিয়ে রাখে।
শয়তান কখনোই আপনাকে সরাসরি এসে শিরক করতে বলবে না। সে সব সময়ই আপনাকে ভালো ভালো কারণ দেখিয়ে ধোঁকায় ফেলবে, এবং শয়তান আমাদের যে কারো চাইতেই বেশী ধৈর্য্যশীল, তাই সে বার বার ফিরে আসবে। কাজেই আমরা সবসময়ই আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইবো শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। কখনোই ভাববেন না যে আপনার অনেক জ্ঞান আছে, বিচার-বুদ্ধি আছে, শয়তান কিছুতেই আপনাকে ধোঁকায় ফেলতে পারবে না। মিথ্যা সংবাদ প্রচার: মিথ্যা সংবাদ করে শয়তান আমাদের অন্যায় কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন: আর যখন তাদের কছে পৌঁছে কোন সংবাদ শান্তি-সংক্রান্ত কিংবা ভয়ের, তখন তারা সেগুলোকে রটিয়ে দেয়। আর যদি সেগুলো পৌঁছে দিত রাসূল পর্যন্ত কিংবা তাদের শাসকদের পর্যন্ত, তখন অনুসন্ধান করে দেখা যেত সেসব বিষয়, যা তাতে রয়েছে অনুসন্ধান করার মত। বস্তুতঃ আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা যদি তোমাদের উপর বিদ্যমান না থাকত তবে তোমাদের অল্প কতিপয় লোক ব্যতীত সবাই শয়তানের অনুসরণ করতে শুরু করত!(সূরা নিসা:৮৩)
মন্দ ও অশালীন কাজের নির্দেশ : শয়তান মানুষের সামনে অশ্লীল ও খারাপ জিনিসকে আকর্ষণীয় ও উত্তম হিসেবে পেশ করে। আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই সে (শয়তান) তোমাদের মন্দ ও অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেয়। আর যেন তোমরা আল্লাহর ব্যাপারে এমন কথা বলো যা তোমরা জানো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৬৯) পাপকে আকর্ষণীয় করে তোলা : পথভ্রষ্ট করতে শয়তানের অন্যতম কৌশল হলো, পাপ কাজকে আকর্ষণীয় করে তোলা। যাতে সহজেই যে কারো মনকে হরণ করতে পারে। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সে (ইবলিস) বলল, হে আমার পালনকর্তা, আপনি যেমন আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তাদের সবাইকে পৃথিবীতে নানা সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করব এবং তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করব। আপনার মনোনীত বান্দারা ছাড়া (তাদের কোনো ক্ষতি আমি করতে পারব না)।’ (সুরা হিজর, আয়াত : ৩৯-৪০)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল। বলল, হে আদম! আমি কি তোমাকে বলে দেবো অনন্তকাল জীবিত থাকার গাছের কথা এবং অবিনশ্বর রাজত্বের কথা?’ (সুরা ত্বহা, আয়াত : ১২০)
উত্তর দিচ্ছেন : মুফতি জাওয়াদ তাহের
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন