প্রাচীন ও বর্তমান অনেক ধর্ম ও সমাজব্যবস্থায় বিধবাদের জীবন অত্যন্ত মানবেতর। শুধু বিধবা হওয়ার কারণে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি তাদের হতে হয় যা বর্ণনা করা কঠিন। উদাহরণস্বরূপ হিন্দু ধর্মের সতীদাহ প্রথার কথা উল্লেখ করা যায়। এ প্রথা বিলুপ্ত হলেও সে সমাজে এখনো রয়েছে নানাবিধ কুসংস্কার যা একজন বিধবাকে নিগৃহীত করে ও স্বাভাবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। কিছু মুসলিম সমাজেও বিধবাদের অপয়া মনে করা হয়। ফলে, বিধবা পরবর্তী জীবন আর স্বাভাবিক হয়ে ওঠে না। মূলত ধর্মকে না বুঝার কারণে এমনটি হয়ে থাকে। সত্যিকার অর্থে বিধবাদের সাথে প্রাচীন সব কুসংস্কারকে উপড়ে ফেলে সত্যিকারের সম্মান-মর্যাদা এবং অধিকার নিশ্চিত করেছে ইসলাম। এতিম বাচ্চার দেখাশুনা বা এ ধরনের কোন শরিয়তসম্মত অপারগতা না থাকলে বিধবা মহিলারা ইদ্দতের পরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকে দোষ মনে করা অজ্ঞতা এবং হিন্দুদের রীতি। আর বংশের লোকেরা তাকে বিবাহ বসতে বাধা দেওয়া হারাম। নবীজির (সা.) সম্মানিতা স্ত্রীগণও হজরত আয়েশা (রা.) ব্যতীত কেউ কুমারী ছিলেন না; বরং কেউ বিধবা ছিলেন আর কেউ তালাকপ্রাপ্তা ছিলেন। (তাকমিলায়ে ফাতহুল মুলহিম : ১/৯৭)। সাহাবায়ে কেরামও বিধবা নারীদের বিয়ে করেছেন। তাই এমন মোবারক আমলকে দোষ মনে করা চরম অজ্ঞতা এবং ভ্রষ্টতা।
আর কুমারী মহিলার চেয়ে বিধবা মহিলার বিবাহ আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তার বিবাহ না হলে অনেক সময়ই শারীরিক সুস্থতা, ইজ্জত, কখনো দ্বীন ধর্ম এমনকি সবকিছুই বরবাদ হয়ে যায়। (তাফসিরে ইবনে কাছির (সুরা নুর : ৩২) ৩/২৮৭; তাফসিরে তাবারি : ১৮/১২৫) বিধবা হওয়ার পর নারীকে সামাজিক মর্যাদা এবং নিরাপত্তার জন্য ফের বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। যা ইসলাম অত্যন্ত মর্যাদার সাথে প্রতিষ্ঠিত করেছে। পবিত্র কোরআনের বেশ কয়েক জায়গায় বিধবা মহিলাদের ইদ্দতের পরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে উৎসাহিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রী রেখে মৃত্যুবরণ করবে, তাদের স্ত্রীদের কর্তব্য হলো চার মাস দশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করা। এরপর যখন ইদ্দত পূর্ণ করে নেবে তখন তারা নিজেদের ব্যাপারে বিধিমতো ব্যবস্থা নিলে তাতে কোনো পাপ নেই।’ (সুরা বাকারা : ২৩৪) বিয়ে ছাড়া থাকা ইসলামে পছন্দনীয়ও নয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও।’ (সুরা নুর : ৩২) আয়াতে ‘আয়ামা’ শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো প্রত্যেকটি এমন নর ও নারী, যার বিবাহ বর্তমান নেই; আসলেই বিবাহ না করার কারণে হোক কিংবা বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজনের মৃত্যু অথবা তালাকের কারণে হোক। এমন নর ও নারীদের বিবাহ সম্পাদনের জন্যে তাদের অভিভাবকদের আদেশ করা হয়েছে। এখানে শরিয়তের চাহিদা এটাই যে, ইসলামী সমাজজীবনে কোনো পুরুষ বা নারী যেন বিয়ে ছাড়া না থাকে, তাহলে বিপথগামীতা ও গুনাহে লিপ্ত হওয়ার রাস্তুা বন্ধ হয়ে যায়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তিকে সাহায্য করা আল্লাহর দায়িত্বে। ১. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী, ২. ঐ কৃতদাস যে মনিবের পাওনা আদায়ের ইচ্ছা রাখে, ৩. ইজ্জত-সম্মান হেফাজতের জন্য বিয়ে করে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে এও বর্ণিত আছে যে, ‘তোমরা বিয়ের মধ্যে ধনাঢ্যতা তালাশ কর।’
এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের পোশাক হিসেবে তুলনা করা হয়েছে। তাই কোনো নারী বিধবা হওয়ার পর আবার যখন বিয়ে করেন তখন তিনি পোশাকে আবৃত হওয়ার মতো নিজের জীবনকে সব দিক থেকে নিরাপত্তার চাদরে আবৃত করেন। ইসলাম বিধবা নারীদের যে সকল অধিকার প্রদান করেছে এর মধ্যে সর্বপ্রথম কথা তো এটাই যে, বিধবা নারী যেন দ্বিতীয়বার বিয়ে করে নিজের ইজ্জত-সম্মান নিয়ে জীবন-যাপন করতে পারে। অত্যন্ত দুঃখজনক যে, কিছু কিছু মুসলমান বংশের লোকেরাও মুর্খজাতি-গোষ্ঠীর ন্যায় বিধবা নারীর বিয়েকে দোষণীয় মনে করে। অথচ আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং এর আদেশ করেছেন। হাঁ, কোনো শরিয়তসম্মত অপারগতা থাকলে ভিন্ন কথা। বিধবার বিয়েতে মানুষ খারাপ বলবে শুধুমাত্র এ কারণে এর থেকে পিছিয়ে থাকা কোনোরকম কাম্য নয়। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশের বিপরীতে হালাল বস্তুকে হারাম বানিয়ে নেওয়া ধর্মহীনতা। বাস্তব কথা হলো, দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি নারীর জন্য রহমতস্বরূপ। এর মাধ্যমে চিন্তা-পেরেশানি থেকে মুক্ত থাকা যাবে। দ্বিতীয়বার আবার শান্তিতে স্বাভাবিক জীবন যাপন করার সুযোগ হবে। বিধবা নারীর বিয়েতে অভিভাবকের প্রয়োজন নেই। যেখানে আত্মীয়তা করা ভালো মনে করে সেখানে করতে পারবে। ইদ্দত পালনের অধিকার : পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বিধবার সুবিধা, মূল্যায়ন ও মর্যাদা সম্পর্কে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রী রেখে মৃত্যুবরণ করবে, তাদের স্ত্রীদের কর্তব্য হলো ৪ মাস ১০ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করা। এরপর যখন তারা (৪ মাস ১০ দিন) পূর্ণ করে নেবে, তখন নিজেদের ব্যাপারে বিধিমতো ব্যবস্থা নিলে তাতে কোনো পাপ নেই। আর তোমরা যা কর, সেই সম্পর্কে আল্লাহ সবিশেষ অবগত আছেন।’ (সুরা বাকারা : ২৩৪)।
আর চার মাস দশ দিন ইদ্দত অতিক্রম হওয়ার পরে শরিয়তের সীমারেখার ভিতরে বিধবা নারীর জন্য সব রকম সাজসজ্জা করা জায়েজ। ভালো খাবার খেতে, ভালো পোশাক পরতে কোনো অসুবিধা নেই।
সম্পদের অধিকার : বিধবা নারীর সর্বপ্রধান অধিকার হলো মৃত স্বামীর উত্তরাধিকার লাভ। যেখানে, নারীরা কোনো সম্পত্তিরই মালিক হতে পারত না বরং নিজেরাই পন্য হিসেবে বিক্রীত হতো সেখানে স্বামীর মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে বিধবা স্ত্রীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে ইসলাম। সেক্ষেত্রে কোনো সন্তান থাকলে স্ত্রী এক অষ্টমাংশ এবং না থাকলে এক-চতুর্থাংশ সম্পত্তির মালিক হবেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের সন্তান না থাকলে তাদের (স্ত্রীদের) জন্য তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পদের এক-চতুর্থাংশ, তোমাদের সন্তান থাকলে তাদের জন্য তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পদের এক-অষ্টমাংশ। তোমরা যে অসিয়ত করবে তা দেওয়ার পর এবং ঋণ পরিশোধের পর।’ (সুরা নিসা : ১২) বিধবা স্ত্রী সন্তানহীন হলে অথবা অন্যত্র বিয়ে করলেও সে মৃত স্বামীর সম্পদের উত্তরাধিকারী হবে, যদিও বিষয়টি নিয়ে সমাজে কুসংস্কার রয়েছে। দেনমোহর বিধবা নারীর অধিকার। স্বামী দেনমোহর পরিশোধ না করে মারা গেলে স্বামীর পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে অন্যান্য ঋণের ন্যায় আগে দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। তারপর বাকি সম্পত্তি ওয়ারিশদের মাঝে বণ্টন করা হবে। বিধবার প্রতি সযত্ন এবং তাদের অধিকারের বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! নারীদেরকে জোড়পূর্বক উত্তরাধিকারের পণ্য হিসেবে গ্রহণ করা তোমাদের জন্য বৈধ নয় এবং তোমরা তাদেরকে যা প্রদান করেছ তার কোনো অংশ তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়ার জন্য তাদেরকে আটকে রেখ না; যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে জীবনযাপন কর, এমনকি তোমরা যদি তাদেরকে পছন্দ নাও কর। এমনও তো হতে পারে যা তোমরা অপছন্দ কর, তাতেই আল্লাহ অনেক কল্যাণ নিহিত রেখেছেন।’ (সুরা নিসা : ১৯)
বিধবা নারীর দায়-দায়িত্ব পালন করা, তাদের সহযোগিতা করা অনেক বড় পূণ্যের কাজ। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘বিধবা ও মিসকিনের জন্য খাদ্য জোগাড়ে চেষ্টারত ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর মতো অথবা রাতে সালাতে দন্ডায়মান ও দিনে সিয়ামকারীর মতো।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৩৫৩) বিধবা নারীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা, তাদের সহানুভূতি প্রদর্শন করা, সম্মান করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য খুবই সওয়াবের কাজ। সহিহ বুখারিতে এসেছে, হজরত ওমর (রা.) বলেন, আমাকে আল্লাহ তায়ালা সুস্থ রাখলে আমি ইরাকের বিধবা নারীদের এমনভাবে স্বচ্ছল করে দেব যে, এরপর তাদের আর কারো মুখাপেক্ষী হতে হবে না।
বিধবা নারীদের বিয়ে করার মাধ্যমেও তাদের সহযোগিতা করা যেতে পারে। চারটা পর্যন্ত বিয়ে করার যেহেতু শরিয়ত অনুমতি দিয়েছে, এজন্য সবদিক ঠিক থাকলে বিধবা নারীকে বিয়ে করে তাদের সহযোগিতা করা যেতে পারে। স্ত্রী ছাড়া অনেকে অতিরিক্ত চাহিদা পুরা করার জন্য গার্লফেন্ড রাখেন, পতিতালয়কে বেছে নেন, এক্ষেত্রে বিধবা নারীকে বিয়ে করলে নিজে গুনাহ থেকেও বাঁচা যাবে এবং একজন বিধবা নারীকে সহযোগিতা করার পূণ্য অর্জন করা যাবে।
বিধবা নারীর পুরস্কার : রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি ও (নিজের যত্ন না নেওয়ায়) চেহারায় দাগ পড়া নারী পরকালে এভাবে থাকব অথবা শাহাদাত ও মধ্যমা আঙুলের চেয়ে বেশি দূরত্ব থাকবে আমাদের মধ্যে। সে হলো সেই নারী যার স্বামী মারা গেছে এবং তার বংশীয় মর্যাদা ও সৌন্দর্য থাকার পরও সে নিজেকে বিরত রাখে এতিম সন্তানদের জন্য-যতক্ষণ না সন্তানরা (স্বাবলম্বী হয়ে) পৃথক হয়ে যায় অথবা মারা যায়।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫২৪৯)
বিধবার সন্তানের দায়িত্ব : সন্তানের দায়িত্ব শুধু বিধবা নারীর নয়। ইসলাম বিধবা নারীকে সন্তানের একক দায় থেকে মুক্তি দিয়েছে। ইসলামী শরিয়ত মতে, সম্পদ ও ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে পিতার অবর্তমানে দাদা সন্তানের অভিভাবক এবং তার অবর্তমানে ইসলামী রাষ্ট্রের বিচারক অভিভাবক নির্ধারণ করে দেবে। অবশ্য মা সন্তান প্রতিপালন করবে যতক্ষণ না সে অন্যত্র বিয়ে করে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি সন্তানের ব্যাপারে বেশি হকদার যতক্ষণ না তুমি বিয়ে কর।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২২৭৬) সন্তান প্রতিপালনের অজুহাতে মায়ের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত করার সুযোগ নেই। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কোনো মাকে তার সন্তানের জন্য এবং কোনো পিতাকে তার সন্তানের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে না।’ (সুরা বাকারা : ২৩৩) আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে বিধবাসহ সমাজের সব শ্রেণির অসহায় মানুষের পাশে দাড়াঁনোর তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন