বিশ্ব জাহানের সকল কিছুই আল্লাহ তায়ালা মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীতে এমন কোনো বস্তু নাই যা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষের উপকার সাধন করে না। আর মানুষের দায়িত্ব হলো জগতের সকল কিছুর মালিক আল্লাহর ইবাদত করা। কিছু মানুষ মনে করে জীবনের উদ্দেশ্য হলো কেবল ধন-সম্পদ অর্জন, ক্রীড়া-কৌতুক, যশ-খ্যাতি ও সন্তান-সন্ততির প্রতিযোগিতা করা। তারা জীবনকে উপভোগ করেই আনন্দ পায়। প্রকৃত পক্ষে মানবজীবনের মূল উদ্দেশ্য সেটি নয়। বরং জীবনের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর পরিচয় লাভ করা। ঐ সমস্ত মানুষ গুলো সেটি ভুলে গিয়ে পার্থিব জীবনে ভোগ বিলাসেই মগ্ন থাকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কিছুই নয়।(সূরা আলে ইমরান-১৮৬)। রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, দুনিয়া মুমিনের কারাগার আর কাফিরের জান্নাত। (সহীহ মুসলিম-২৯৫৬)। মুমিনবান্দা দুনিয়াকে আপন মনে করেনা, বরং সামান্য সময়ের অবস্থান মনে করে। তাই কোনো মুমিন দুনিয়ার মোহে পড়ে আখিরাতকে ভুলে যেতে পারে না।
১। পৃথিবীতে মানুষ মুসাফিরের মত-ঃ মুমিন দুনিয়াতে দীর্ঘদিন থাকার ইচ্ছা পোষণ করতে পারে না। কেননা দুনিয়াতে দীর্ঘদিন থাকার ইচ্ছা পোষণ করার মাধ্যমে বিভিন্ন লোভ লালসা তাকে গ্রাস করে ফেলে। যেহেতু আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনই আমাদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য তাই আমাদের যাবতীয় কর্মকান্ড তারই নির্দেশ মোতাবেক হওয়া জরুরী। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমার কাধেঁ হাত রাখলেন এবং বললেন, তুমি দুনিয়ায় এমনভাবে থাকো যেন তুমি একজন মুসাফির অথবা বিদেশি। হযরত ইবনে উমর (রাঃ) বলতেন,“যখন সন্ধ্যায় উপনীত হবে তখন তোমরা সকালের অপেক্ষা করোনা। আর যখন তোমার সকাল হয় তখন সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করো না। অসুস্থ হওয়ার আগে সুস্থতাকে কাজে লাগাও, আর তোমাদের মৃত্যুর জন্য জীবিতাবস্থায় পাথেয় জোগাড় করে নাও। (সহীহ বুখারী-৬৪১৬)।
২। মানুষের উদর কখনও সম্পদ দ্বারা পূর্ণ হয়না ঃ বনি আদম সারাক্ষণ সম্পদ অর্জনের পেছনে ছুটতে থাকে। অনেকে এতো বেশি ঝুকেঁ পড়ে যে, সে যেকোন অন্যায় ও গর্হিত পথে পা দিতে দ্বিধা করেনা। এতে করে আল্লাহ তায়ালা ঐ বান্দার উপর অসন্তুষ্ট হন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনীত হও। ( এমনকি এ অবস্থায় তোমরা মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে যাও। ) (সূরা তাকাসুর : ১-২)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, আদম সন্তান যদি দুটি পর্বত পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তবুও সে (সন্তুষ্ট না হয়ে) তৃতীয়টি কামনা করবে। আদম সন্তানের মোহ মাটি ব্যতীত অন্যকিছু দিয়ে ভর্তি করা সম্ভব নয়। তবে যে আল্লাহর দিকে রুজু হয় আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত:পৃ-৪৪৯)। আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয় মানুষ তার পালনকর্তার প্রতি অকৃতজ্ঞ এবং সে অবশ্য এ বিষয়ে অবহিত। এবং সে নিশ্চিতই ধন-সম্পদের ভালোবাসায় মত্ত। (সূরা আদিয়াত : ৬-৮)।
৩। অবিশ্বাসীদের বৈষয়িক উন্নতিতে বিভ্রান্ত হওয়া যাবেনা ঃ পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালা অবিশ্বাসীদের প্রচুর পরিমাণ সম্পদ দান করেছেন। যার কারণে সারা পৃথিবীতে তারা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে মুমিনগণ তাদের তুলনায় নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের মধ্যে অনেক পিছিয়ে। এ অবস্থা দেখে কোনো ঈমানদার বিভ্রান্ত হতে পারবেনা। হযরত উকবা ইবনে আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবি করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেছেন, যখন তোমরা দেখতে পাবে যে, কোনো ব্যক্তির পাপকাজ ও নাফরমানি সত্ত্বেও তার বাসনা অনুযায়ী দুনিয়ার অফুরন্ত নেয়ামত ভোগ করছেন, তখন এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে অবকাশ বা ঢিলাদান ছাড়া অন্য কিছু নয়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি পার্থিব জীবন ও তার চাকচিক্যই কামনা করে, হয় আমি তাদের দুনিয়াতেই তাদের আমলের প্রতিফল ভোগ করিয়ে দেব এবং তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হয়না। এরাই হল সেসব লোক আখিরাতে যাদের জন্য আগুন ছাড়া কিছুই নেই। তারা এখানে যা কিছু করেছিল সবই বরবাদ করেছে, আর যা কিছু উপার্জন করেছিল সবই বিনষ্ট হলো। (সূরা হুদ : ১৫-১৬)
৪। দুনিয়ার মোহ সকল অনিষ্টের মূল ঃ পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য অত্যন্ত মোহনীয় করে নারী, সন্তান-সন্ততি, ধন-সম্পদ সৃষ্টি করেছেন। এসব বস্তুর প্রতি ভালোবাসা মানুষের স্বভাবজাত। যে ব্যক্তি এসবের ভালোবাসায় ডুবে গিয়ে নিজ দায়িত্বের কথা ভুলে যাবে তার পরকালীন জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে। কেননা দুনিয়ার নেয়ামতরাজি দেওয়ার পেছনে আল্লাহ তায়ালার অন্যতম রহস্য হলো মানুষকে পরীক্ষা করা। দুনিয়ার মোহ মানুষের জন্য অনেক পাপের পথ উম্মুক্ত করে দেয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, মানবকূলকে মোহগ্রস্ত করেছে নারী, সন্তান-সন্ততি, স্বর্ণ-রোপ্য, চিহ্ত্ত্ব্বে, গবাদি পশুরাজি এবং ক্ষেত-খামারের মত আকর্ষনীয় বস্তুসামগ্রী। এসবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্তু। আল্লাহর নিকট হলো উত্তম আশ্রয়। (সূরা আলে ইমরান : ১৪) হাদীসের মধ্যে রয়েছে, দুনিয়ার মহব্বত সব অনিষ্টের মূল। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার মানুষের জন্য বিবিধ মোহনীয় বস্তু সৃষ্টি করেছেন আবার বান্দাহকে এগুলোর মোহ থেকে বেঁচে থাকতেও বলেছেন। কোনো বান্দা এগুলোর মোহমুক্ত থেকে পরকালীন জীবনকে প্রাধান্য দিলে তাদের জন্য নিয়ামতের ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- বলুন, আমি কি তোমাদেরকে এসবের চাইতেও উত্তম বিষয়ের সন্ধান বলবো? যারা পরহেজগার, আল্লাহর নিকট তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার তলদেশে প্রস্রবণ প্রবাহিত- তারা সেখানে থাকবে অনন্তকাল। আর রয়েছে পরিচ্ছন্ন সঙ্গীনীগণ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর আল্লাহ ও তার বান্দাদের প্রতি সুদৃষ্টি রাখেন। (সূরা আলে ইমরান-১৫)
৫। বৈষয়িক সম্পদ ও প্রাচূর্য শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয় ঃ অবিশ্বাসীরা দুনিয়াতে অট্টালিকার মালিক বনে গিয়ে আরাম আয়েশ করছে। আল্লাহর কাছে দুনিয়ার এই সম্পদ-সম্পত্তির কোনো মূল্য নেই। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন- দুনিয়া যদি আল্লাহর কাছে মশার এক পাখার সমান মর্যাদারও হতো, তবে আল্লাহ তায়ালা কোন কাফেরকে দুনিয়া থেকে এক ঢোক পানিও দিতেন না। (তিরমিজী - ২৩২০)
সুতরাং সম্পদ সম্পত্তি কোন মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ নয় যা অর্জনের জন্য লালসা রাখতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, সত্য প্রত্যাখ্যানে মানুষ এক মতাবলম্বী হয়ে পড়বে, এই আশংকা না থাকলে দয়াময় আল্লাহকে যারা অস্বীকার করে তাদেরকে আমি দিতাম তাদের গৃহের জন্য রৌপ্য নির্মিত ছাদ ও সিঁড়ি যাতে তারা আরোহন করে। এবং তাদের গৃহের জন্য দরজা ও পালঙ্ক যাতে তারা হেলান দিয়ে বিশ্রাম করতে পারে। এবং স্বর্ণ নির্মিতও। আর এই সকলই শুধু পার্থিব জীবনের ভোগ-সম্ভার। মুুত্তাকীদের জন্য তোমার প্রতিপালকের নিকট রয়েছে আখিরাতের কল্যাণ। (সূরা যুখরুফ : ৩৩-৩৫)
৬। মোহমুক্ত থাকা বুদ্ধিমানের লক্ষণ ঃ মানুষ যতই লোভ লালসায় পতিত হোক না কেন ইহকালীন জীবনে তার জন্য যা বরাদ্দ রয়েছে তার বেশি সে পাবে না। মানুষ ইহকালে একজন মুসাফির হিসেবে শুধুমাত্র তার মনজিল পরিবর্তন করে থাকেন। প্রকৃত বুদ্ধিমান কোনদিন সাময়িক বাসস্থানের প্রতি মনোযোগী হয়ে দীর্ঘস্থায়ী বাসস্থান তথা কবর-হাশরকে নষ্ট করতে চাইবেনা। যে ব্যক্তি নফসের প্ররোচনায় পড়ে ইচ্ছা, আকাংখা, কামনা-বাসনা, রিপু কামভাব ইত্যাদিতে লিপ্ত হবেনা তারাই হলো বুদ্ধিমান ও সফল। রাসূলে করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, বুদ্ধিমান হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে আত্নসমালোচনা, নফসের হিসাব নিকাশ নেয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য উপার্জন করে। আর নির্বোধ ঐ ব্যক্তি যে নিজের নফসের কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে, ইহা সত্তে¡ও সে আল্লাহর কাছে অনুগ্রহের প্রত্যাশী থাকে। (তিরমিজী-২৪৫৯, ইবনে মাজাহ-৪২৬০)
৭। দুনিয়ার মোহ নয় আখিরাতই কাম্য ঃ হযরত উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একবার রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকট প্রবেশ করে তার শরীর মোবারকে চাটাইয়ের চিহ্ন দেখতে পেলাম এবং একটা পাত্রে এক সা যব দেখতে পেলাম। তখন আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেলে তিনি বললেন, হে উমর তুমি কাঁদছ কেন? আমি বললাম, আমি কান্না করব না কেন? আপনার খাবারের পাত্র এমন আর কায়সার ও কিসরা শাসকদের খাবার ফলমূলে পূর্ণ। অথচ আপনি হলেন আল্লাহর রাসূল। তখন তিনি বললেন, হে উমর এই দুনিয়াটা হচ্ছে তাদের জন্য আর আখিরাতটা আমাদের জন্য। (সহীহ মুসলিম-২৭৬৪)
সুতরাং বুঝা গেল দুনিয়াটা খুবই তুচ্ছ ও নগণ্য। সুতরাং প্রত্যেক মুমিনের জন্য করণীয় হলো ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াতে বসবাস করে পরকালীন জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করা এবং লোভ লালসা বর্জন করা। কেননা পরকালেই রয়েছে মুমিনের জন্য অজস্র নিয়ামত।
লেখক : সহকারী শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা) চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন