সাধারণভাবে বলতে গেলে সকল মানুষই ভোক্তা। যে খাদ্য গ্রহণ করে মানুষ জীবন ধারণ করে তাতে ভেজাল মিশিয়ে ভোক্তাদের চরম সর্বনাশ করা হচ্ছে। ভেজাল এখন সর্বত্র, ফলমূল, মাছ, মুড়ি, মসলা ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সহ মানুষের জীবন ধারণের জন্য যা প্রয়োজন, সর্বত্রই ভেজাল আর ভেজাল। তাছাড়া পণ্যের গুণগত মান এবং পণ্যের মূল্য নিয়েও ভোগান্তিতে আছেন ভোক্তাগণ। বাংলাদেশের বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে লাগে উপলক্ষ আর অজুহাত। সুতরাং মানুষ একদিকে ভেজাল দ্বারা আক্রান্ত অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যবাজারও স্থিতিশীল নয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা খাবারের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য মিষ্টিসহ বিভিন্ন খাবারে রঙ ব্যবহার করে থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। জীবন রক্ষাকারী ঔষধও ভেজাল থেকে মুক্ত নয়। প্রায়ই বিভিন্ন কোম্পানির নকল ও নিম্নমানের ঔষধ সম্পর্কিত খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আমাদের দেশের হোটেল রেস্তোরাঁ সম্পর্কে একটি কথা সবারই জানা। অনেক হোটেলের কড়াইয়ের তেল কখনো নতুন হয় না, শুধু রিসাইকেল হতে থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খাবারে ব্যবহৃত রঙ ক্যানসার সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে এবং ভেজাল যুক্ত ও ব্যবহৃত পুরোনো তেল ক্যানসারের অন্যতম কারণ। খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মানুষের লোভী মনোবৃত্তিই এর প্রধান কারণ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সচেতনতা ও সতর্কতার সাথে সচেষ্ট থাকা সত্ত্বেও ভেজালমুক্ত জীবন যাপন করা বা ভেজালমুক্ত খাদ্য গ্রহণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর অনেক কারণ রয়েছে, নাগরিক সচেতনতা এখানে মূল বিষয় নয়। হীন ব্যবসায়ীক স্বার্থ অর্থাৎ যে কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জনের মানসিকতাই বেশি কাজ করে। খাদ্যে ভেজাল দিয়ে মানুষকে ঠকানো পবিত্র ইসলাম ধর্মে বড় ধরনের পাপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুরাহ্ বাকারায় ৪২নং আয়াতে মহান আল্লাহ্ তা’আলা ঘোষণা করেছেন, তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলো না এবং জেনে বুঝে সত্য গোপন করো না। রসুল সা. বলেছেন, যে প্রতারণা করে সে আমার দলভুক্ত নয়। ওজনে কম দেওয়ার ব্যাপারে পবিত্র ইসলাম ধর্মে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। যারা ওজনে কম দেওয়ার মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের ধ্বংসের হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে মহান আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, যারা ওজনে কিংবা মাপে কম দেয় তাদের জন্য ধ্বংস। তারা মানুষের কাছ থেকে পুরোপুরি মেপে নেয়। কিন্তু মানুষকে যখন মেপে দেয় তখন প্রাপ্যের চেয়েও কম দেয়। সুরা মুতাফফিফিন আয়াত ১-৩। ওজনে কম দেওয়ার মানেই হলো মানুষের হক নষ্ট করা। ওজনে কম নেওয়া ব্যক্তি যদি মাফ না করেন আল্লাহ্ তা’আলাও মাফ করেন না, এটাই ইসলামী বিধান। তাই এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে।
একথা সত্য যে, শুধুমাত্র সরকারি উদ্যোগে ভেজাল প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে মূল এবং শক্ত ভূমিকা সরকারকেই নিতে হবে। আমাদের দেশে কার্যকর রয়েছে নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩। এ আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনটির ৯০ ধারা অনুসারে পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স ১৯৫৯ রহিত হয়েছে। বাংলাদেশে খাদ্যে ভেজাল রোধ কার্যক্রমের সঙ্গে বেশ কিছু আইন সম্পৃক্ত থাকলেও মূল আইনটি ছিল পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স ১৯৫৯। আইনের বাস্তবায়নের পাশাপাশি নাগরিক উদ্যোগে ভেজালের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা সচেতন নাগরিক সমাজের দায়িত্ব। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্য ভেজালমুক্ত করতে হলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সেতুবন্ধন জরুরি। পচাবাসী এবং পুরোনো খাবার বিক্রি করে ফেলা আমাদের দেশের অনেক ব্যবসায়ীদের প্রবণতা, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। মুসলিম জাতির জন্যও এটা চরম লজ্জাজনক। তাছাড়া কোনো ধর্মই ভেজালকে প্রশ্রয় দেয় না। ধর্মীয় মূল্যবোধ মানুষের কাছে গৌরবের ও মর্যাদার বিষয় তা যে ধর্মেরই হোক। ভেজাল প্রতিরোধে বিএসটিআই বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (পণ্যমান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান) এর কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। ভেজাল প্রতিরোধে প্রশাসনকে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। তাছাড়া জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে নকল ও ভেজালসহ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ধারায় অভিযান জোরদার করে জরিমানা কার্যক্রম আরও কঠোর করতে হবে।
জাতিসংঘের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহৃত জিনিসপত্রে থাকা রাসায়নিকের কারণে সৃষ্টি হতে পারে ক্যানসার, ডায়াবেটিস, অ্যাঁজমা, শিশুর ত্রুটিপূর্ণ জন্ম ও মানসিক বিকারগ্রস্তসহ বেশ কিছু রোগ। সংবাদপত্রে প্রায়ই দেখা যায়, শুটকী তৈরিতে ডিডিটি ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। অথচ এটি নিষিদ্ধ। মাছ, মাংস, ফলমূলে ব্যবহৃত হয় ক্ষতিকর ফরমালিন। রঙিন খাবার তৈরিতেও ব্যবহার করা হয় ক্ষতিকর কাপড়ের রং, যা ক্যান্সারও সৃষ্টি করতে পারে। মুড়ি ভাজতে ইউরিয়া, কলা পাকাতে কার্বাইড, মুরগী ব্যবসায়ীদের মরা মুরগী সরবরাহ করা হয় অনেক হোটেলে। এ জাতীয় খবর প্রায়ই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হয় সেমাই, চানাচুরসহ বেকারিতে অনেক খাদ্যদ্রব্য। তেল, ময়দা, মশলা, আটাসহ প্রায় প্রতিটি খাদ্যদ্রব্যেই ভেজালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। নিরাপদ খাদ্য আইনের অধীনে ২৩ ধরনের অপরাধে এক থেকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড ও চার লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে এ ধরনের অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এমনকি মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে।
রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার বৃদ্ধি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশার কথা হলো, জাতীয় ও স্থানীয় সাংবাদিক এবং লেখকরা এ সংক্রান্ত রিপোর্ট ও নিবন্ধ প্রকাশ করে জনসচেতনতা বাড়াচ্ছেন। মাঝে মধ্যে ভেজাল বিরোধী পরিদর্শন টিম বাজার পরিদর্শন করায় ভোক্তাদের কাছে স্বস্তিদায়ক মনে হয়। তবে ভেজালের ধরনেও এসেছে ভিন্নতা। যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। চালে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত ক্রোমিয়াম। তরল দুধ তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে স্যাম্পু ও সাবান। কেক, জেল ও সস তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে রাসায়নিক দ্রব্য ও কাপড়ের রং। নকল ও নিম্নমানের ঔষধের বিস্তাররোধে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বাজারে মানহীন ঔষধ ছড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক। অসাধু ঔষধের ব্যবসায়ীরা মফস্বলে নিম্নমানের ঔষধ বাজারজাত করে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া না হলে মানুষ নানাভাবে প্রতারিত হবে। একশ্রেণীর অসাধু ব্যক্তি চিকিৎসকদের নানা রকম উপঢৌকন দিয়ে নিম্নমানের ঔষধ প্রচলন করে। এদের তৎপরতা রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। ঔষধের বিরূপ প্রভাবে দেশে কত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার সঠিক হিসাব পাওয়া না গেলেও এর কারণে অনেক পরিবারকে যে পথে বসতে হয়েছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এতদিন কোন ভুক্তভোগী তার ঔষধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা কেবল সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের জানাতে পারতেন। এখন অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এখন ঔষধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে অভিযোগ জানানো যায়।
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ভেজাল খাদ্য খেয়ে অসুস্থ হওয়া জটিল রোগের চিকিৎসায় দেশের বাইরে প্রচুর অর্থের খরচ সংশ্লিষ্ট পরিবারকে হুমকির মধ্যেও ফেলে দিচ্ছে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের লোকবল বাড়িয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয় করার মাধ্যমে সরকারি পদক্ষেপ আরও জোরদার করা এখন সময়ের দাবি। জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কমিটির কার্যক্রম আরও জোরদার এবং জেলায় নিয়োজিত জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তর কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে গণসচেতনতা কার্যক্রম বৃদ্ধি করা গেলে ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব।
জাতিসংঘ কর্তৃক ক্রেতা ভোক্তাদের অধিকার ও দায়িত্ব নিম্নরূপ: ১. অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরনের অধিকার। ২. নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার। ৩. পণ্য উৎপাদন, ব্যবহার বিধি, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি তথ্য জানার অধিকার। ৪. যাচাই বাছাই ন্যায্য মূল্যে সঠিক পণ্য ও সেবা পাবার অধিকার। ৫. অভিযোগ করার ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার। ৬. কোন পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্থ হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার। ৭. ক্রেতা ভোক্তা হিসেবে অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার। ৮. স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাস করার অধিকার। অধিকারের পাশাপাশি ভোক্তা হিসেবে আমাদের কিছু দায়িত্বও রয়েছে। ১. পণ্য বা সেবার মান ও গুণাগুণ সম্পর্কে সচেতন ও জিজ্ঞাসু হোন। ২. দরদাম করে সঠিক পণ্য বাছাই করুন। ৩. আপনার আচরণে অন্য ক্রেতা যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সে ব্যাপারে সচেতন থাকুন। ৪. পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন ও সক্রিয় হোন। ৫. ক্রেতা ভোক্তা হিসেবে অধিকার সংরক্ষণে সোচ্চার ও সংগঠিত হোন।
ভেজাল নামক মারাত্মক ব্যাধি সমগ্র জাতিকে গ্রাস করতে চলেছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে যে কোনো মূল্যে জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত অধিকার সমূহ সংরক্ষণে মানুষকে সংগঠিত হতে হবে। আমাদের সামনে রয়েছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)। এটি অর্জন করতে হলেও ভোক্তাদের আস্থার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
শুধুমাত্র আইন করে শাস্তির ব্যবস্থা করে খাদ্যে ভেজাল রোধ করাও সম্ভব নয়। এজন্য দরকার মানুষের নৈতিকতাবোধ এবং পরকালীন জবাবদিহিতার বিষয়টি জাগ্রত করা। একজন সত্যিকারের মুসলমান, সত্যিকারের পরকাল বিশ্বাসী মানুষ ভেজাল মেশাতে পারে না। অস্বাস্থ্যকর খাদ্য খাইয়ে অসুস্থ করতে পারে না। হযরত ওমর (রা.) এর শাসনামলের একটি ঘটনা এখানে বেশ প্রণিধানযোগ্য বলে মনে করি। প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য খলিফা ওমর (রা.) রাতের আঁধারে ছদ্মবেশে বের হয়েছেন। পথিমধ্যে একঘর থেকে আওয়াজ শুনতে পেলেন মা মেয়েকে বারবার দুধে পানি মেশাতে বলছে, কিন্তু মেয়েটি বলছে খলিফা দুধে পানি মেশানো বেআইনি ঘোষণা করে আইন জারি করেছেন। মা বললো, এতো রাতে তো খলিফা দেখতে আসবে না। একথা শুনে মেয়েটি বলল, খলিফা না দেখলেও আল্লাহ তো দেখছেন। এ মেয়েটির কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করলে আমরাও খাদ্যে ভেজাল মেশানোর মতো গর্হিত কাজ থেকে মহান সৃষ্টিকর্তার ভয়ে বিরত থাকতে উৎসাহিত হতে পারি।
লেখক: ব্যাংকার, কলামিস্ট এবং গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন