মানুষের পুরো জীবনটাই মহান আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতসমূহে পূর্ণ। এসব নেয়ামতের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেয়ামত হচ্ছে সুসন্তান। আজ যারা শিশু, কাল তারা হবে বড়, ভবিষ্যতে সমাজ-রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল। একটি সভ্য-সুন্দর সমাজ নির্মাণের জন্য প্রয়োজন, প্রত্যেক শিশুকে দ্বীনদার আদর্শবানরূপে গড়ে তোলা। এ শিশু-কিশোরেরা যদি অবহেলা-অনাদারে বড় হয়, নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, ভবিষ্যতে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারের জন্য এরাই হবে চরম অশান্তি ও বিপর্যয়ের কারণ। আর শিশুদের দ্বীনদার আদর্শবানরূপে তখনই গড়ে তোলা যাবে, যখন তাদের অধিকারগুলো সঠিকভাবে আদায় করা হবে। ইসলাম মানুষের জীবনের প্রতিটি ধাপেই তার অধিকার সংরক্ষণ করে, তাকে সম্মানিত করেছে। কোরআনে উল্লেখ হয়েছে, “আমিতো আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি; স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ দান করেছি এবং আমি যাদেরকে সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের ওপর ওদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।” [সূরা বনি ইসরাইল ৭০]
জন্মলাভের আগে শিশুর অধিকার: শিশুর কিছু অধিকার শুরু হয় তার জন্মলাভের আগে থেকে। এর মধ্যে প্রথমটি হল মায়ের চরিত্র উত্তম হওয়া। কারণ শিশুর ওপর তার মায়ের প্রভাব পড়বেই। তাই শিশুকে সুন্দর ও সফল জীবন উপহার দিতে চাইলে তার প্রস্তুতি নিতে হবে বিয়ের আগেই। হাদিসে আছে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “চারটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে মেয়েদের বিয়ে করা হয়; তার সম্পদ, তার বংশমর্যাদা, তার সৌন্দর্য ও তার দ্বীনদারী। সুতরাং তুমি দ্বীনদারী-ধার্মিকতাকে প্রাধান্য দেবে নতুবা তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” (বুখারি ৫০৯০, মুসলিম ৩৫২৭) দ্বিতীয়তঃ বৈধভাবে জন্মলাভের অধিকার। জন্মগত বৈধতা এমন বিষয়, যা ইসলামী পরিবার গঠনের ভিত্তি ও শিশুর ন্যায্য অধিকার। অবৈধ সন্তান অনেক ক্ষেত্রেই মানবিক অধিকার হতে বঞ্চিত হয়, তার জীবনধারণ এবং লালন পালনের সুযোগ-সুবিধা সহজলভ্য হয় না। যদিও বা মাতাপিতার অপরাধ সন্তানের ওপর বর্তায় না, কিন্তু সমাজ অবৈধ সন্তানকে পূর্ণ সামাজিক মর্যাদা দিতে সম্মত নয়। তৃতীয়তঃ গর্ভের সন্তানের যত্ননেয়া। অর্থাৎ অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর যত্ন নেয়া। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে যদি তালাকও দেয়া হয় তখনো ভরণ-পোষণের দায়িত্ব কোরানের বিধান মতে স্বামীর ওপর। সূরা তালাক, ৬ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে, “তারা গর্ভবতী হলে সন্তান প্রসব পর্যন্ত তাদের জন্য ব্যয় করবে।”
জন্মলাভের পর শিশুর অধিকার: (ক) কানে আযান শোনার অধিকার। সন্তান জন্মলাভের সাথে সাথেই অভিভাবকদের দায়িত্ব, সহনীয় আওয়াজে নবজাতকের ডান কানে আযান, বাম কানে ইকামত দেওয়া, এটা মুস্তাহাব। হাদিসে আছে, “ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা যখন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর পুত্র হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে প্রসব করলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কানে নামাযের আযানের মতো আযান দিয়েছিলেন।” (আবু দাউদ ৫১০৫, হাসান) (খ) দুধপানের ব্যবস্থা করা। জন্মের পর শিশুর অন্যতম অধিকার, তার দুধপানের ব্যবস্থা করা, তার যত্ন নেয়া। কোরআনে উল্লেখ হয়েছে, “মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু›বছর দুধ পান করাবে।” [সূরা বাকারা ২৩৩] (গ) শিশুর সুন্দর নাম রাখা। এটা শিশুর আরেকটি মৌলিক অধিকার। শিশুর সুন্দর নাম রাখা মুস্তাহাব। হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমরা নবীগণের নামে নাম রাখবে। আর আল্লাহর নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় নাম হল আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান।”(আবু দাউদ ৪৯৫০, সহিহ) (ঘ) শিশুর আকিকা করা। অভিভাবক নবজাতকের পক্ষ হতে, তার জন্মের খুশিতে মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ পশুজবাই করবেন। আকিকা করা মুস্তাহাব। হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “প্রত্যেক শিশু তারা আকিকার সাথে দায়বদ্ধ থাকে, তার জন্মের সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে পশু যবেহ করতে হবে, তার মাথা (চুল) কামাতে হবে এবং নাম রাখতে হবে।” (ইবনে মাজাহ ৩১৬৫, সহিহ) (ঙ) খতনা করানো। ছেলে শিশুদের খতনা করানো সুন্নত। হাদিসে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “(নবীগণের সুন্নত) স্বভাবগত বিষয় হলো পাঁচটি, খতনা করা, ক্ষৌরকর্ম করা (অর্থাৎ অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার করা) বগলের লোম উপড়ে ফেলা, নখ কাটা ও গোঁফ খাটো করা।” (বুখারী ৬২৯৭, মুসলিম ৪৮৫) (চ) নবজাতককে পিতার বংশের সাথে সম্পৃক্ত করা। হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে লোক নিজের সন্তানকে অস্বিকার করে, অথচ শিশুটি তার মমতার আকাঙ্ক্ষা করে, মহান আল্লাহ তাকে তাঁর রহমত থেকে বঞ্চিত করবেন এবং তাকে কেয়ামতের দিন পূর্বাপর সকল লোকের সামনে লাঞ্ছিত করবেন।” (নাসায়ি ৩৪৮১) (ছ) শিশুর ভরণপোষণ দেয়া। সমস্ত ইসলামী পন্ডিতগণ একমত, নবজাতক ছেলে হোক বা মেয়ে পিতার জন্য সামর্থ্য অনুপাতে নবজাতকের ভরণপোষণের ব্যয় বহন করা ওয়াজিব বা আবশ্যক। (জ) ভদ্রতা ও ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা দেয়া। হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের (পুরুষ হোক বা নারী) ওপর ফরয।” (ইবনে মাজা ২২৪, সহিহ) তাই সন্তানকে তার দৈনন্দিন ইবাদতের জন্য যতটুকু ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা দরকার, অন্তত ততটুকু ধর্মীয় জ্ঞান শেখার ব্যবস্থা করতেই হবে। তাকে পরিচ্ছন্নতা-পবিত্রতা শিক্ষা দিতে হবে, শুদ্ধভাবে কোরআন শিক্ষা দিতে হবে, প্রয়োজনীয় মাসায়েল শেখাতে হবে। (ঝ) শিশুদের স্নেহ করা ভালবাসা। শিশুদের স্নেহকারীর জন্য রয়েছে পরকালের উত্তম পুরস্কার, আর শিশুদের যে স্নেহ করে না তার জন্যে রয়েছে কঠিন ধমক। হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে লোক আমাদের শিশুদের স্নেহ করে না এবং আমাদের বড়দের সম্মানের প্রতি খেয়াল করেনা; সে (চারিত্রিকভাবে) আমাদের দলভুক্ত নয়।” (তিরমিযি ১৯২০, সহিহ)
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে শিশুদের অধিকার, সঠিকভাবে বাস্তবায়নের তাওফীক দান করুন, আমীন।
লেখক : খতিব, ইব্রাহীমনগর মাদ্রাসার মসজিদ বুড়িগঞ্জ, বগুড়া।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন