আশরাফুল মাখলুকাত খ্যাত মানবজাতির প্রতি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মহা অনুগ্রহ হলো হেদায়েত দান করা। যে ব্যক্তি হেদায়েত লাভ করে কেবল তার ভাগ্যে ঈমান জোটে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি বিশ্বাসীকে মুমিন বলা হয়। পবিত্র কোরআন মাজীদে মুমিনের পরিচয় প্রসঙ্গে মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বলেন, যাহারা অদৃশ্যে ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে ও তাহাদেরকে যে জীবনোপকরণ দান করিয়াছি তাহা হইতে ব্যয় করে, এবং তোমার প্রতি যাহা নাযিল হইয়াছে ও তোমার পূর্বে যাহা নাযিল হইয়াছে তাহাতে যাহারা ঈমান আনে ও আখিরাতে যাহারা নিশ্চিত বিশ্বাসী, তাহারাই তাহাদের প্রতিপালক - নির্দেশিত পথে রহিয়াছে এবং তাহারাই সফলকাম। (সুরা বাকারাহ: আয়াত: ৩-৫)। তিনি আরো বলেন, হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহে, তাঁহার রাসূলে, তিনি যে কিতাব তাঁহার রাসূলের প্রতি অবতীর্ণ করিয়াছেন তাহাতে এবং যে কিতাব তিনি পূর্বে অবতীর্ণ করিয়াছেন তাহাতে ঈমান আন। এবং কেহ আল্লাহ্, তাঁহার ফিরিশ্তাগণ, তাঁহার কিতাবসমূহ, তাঁহার রাসূলগণ এবং আখিরাতকে প্রত্যাখ্যান করিলে সে তো ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হইয়া পড়িবে। (সুরা নিসা: আয়াত: ১৩৬)।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রকৃত মুমিন হতে এসব বিষয়ের প্রতি সন্দেহাতীত বিশ্বাস স্থাপন করতে বলেছেন। যে বিশ্বাস একজন মানুষকে প্রকৃত মুমিনে পরিণত করে দেবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তুমি আল্লাহ তাআলা, তাঁর ফিরিশতাগণ, আসমানি কিতাবসমূহ, রাসুলগণ, শেষ দিবসের প্রতি (আখিরাত) এবং ভাগ্যের ভালো-মন্দের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে। (সহীহ মুসলিম)।
মু’মিনের অনুপম বৈশিষ্ট্য সমুহ: ক. আল্লাহর ভয়ে ভীত: মুমিন সর্বদা আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘প্রকৃত মুমিন তারাই যখন তাদের কাছে আল্লাহর নাম নেয়া হয়, তখন তাদের অন্তর কেঁপে ওঠে। আর যখন তাদের কাছে তাঁর (আল্লাহর কুরআনের) আয়াত পাঠ করা হয় তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। তারা তাদের প্রভুর ওপরই ভরসা করে। তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে এবং আমার দেয়া রুজি হতে (আল্লাহর পথে) খরচ করে। তারাই হলো সত্যিকারের মুমিন। (সুরা আনফাল : আয়াত: ২-৪)
খ. দেহমন পবিত্র: ঈমানদার ব্যক্তির দেহমন পবিত্র ও পরিশুদ্ধ। কেননা সে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক পবিত্রতা অবলম্বন করে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহপাক বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীকে ভালবাসেন এবং যাহারা পবিত্র থাকে তাহাদেরকেও ভালবাসেন। (সুরা বাকারাহ: আয়াত: ২২২)। আল্লাহপাক আরো বলেন, সেখানে এমন লোক আছে যাহারা পবিত্রতা অর্জন ভালবাসে এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে আল্লাহ পছন্দ করেন। (সুরা তাওবাহ: আয়াত: ১০৮)।
গ. সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণ: মুমিন ব্যক্তি সর্বদা আল্লাহর স্মরণ করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, কাজেই তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং অকৃতজ্ঞ হয়ো না। (সুরা বাকারাহ: আয়াত: ১৫২)। আল্লাহপাক আরো বলেন, যখন তোমরা সালাত সমাপ্ত করিবে তখন দাঁড়াইয়া, বসিয়া এবং শুইয়া আল্লাহকে স্মরণ করিবে, যখন তোমরা নিরাপদ হইবে তখন যথাযথ সালাত কায়েম করিবে ; নির্ধারিত সময়ে সালাত কায়েম করা মু’মিনদের জন্য অবশ্যকর্তব্য। (সুরা নিসা: আয়াত: ১০৩)। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, তোমাদেরকে কি এমন একটি উত্তম আমলের সংবাদ দেব যা তোমাদের মালিকের নিকট অধিকতর পবিত্র, তোমাদের মর্যাদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অধিকতর সহায়ক, স্বর্ণ ও রৌপ্য ব্যয় করা থেকেও তোমাদের জন্য উত্তম, শক্রর সাথে মোকাবেলা করে গর্দান দেয়া-নেয়া থেকে উত্তম? তারা বলল, হ্যাঁ অবশ্যই বলবেন। তিনি বললেন, যিকরুল্লাহ। অর্থ্যাৎ সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করা। (জা’মে তিরমিযী: হাদিস: ৫/৪৫৯)।
ঘ. সালাতের প্রতি যত্নশীল: মুমিন ব্যক্তি সালাতের ব্যাপারে খুবই যত্নশীল ও দায়িত্বশীল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, যারা নিজেদের নামাযে বিনয়াবনত হয়, এবং নিজেদের নামাযগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করে। (সুরা মুমিনুন: আয়াত: ২ ও ৯)। আল্লাহপাক আরো বলেন, তোমরা সালাত সমূহের প্রতি এবং (বিশেষ করে) মধ্যবর্তী সালাতের প্রতি যত্নবান হও, এবং আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্যে একান্ত অনুগত অবস্থায় দাঁড়াও। (সুরা বাকারাহ: আয়াত: ২৩৮)। বল, নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎ সমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যে। (সুরা আনয়াম: আয়াত: ১৬২)। হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এক জুমার সালাত থেকে অপর জুমার সালাত এবং এক রমযান মাসের সিয়াম হতে অপর রমজান মাসের রোজা সেসব গুনাহের জন্যে কাফফারা হয়, যা এর মধ্যবর্তী সময়ে হয়ে থাকে; যখন কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা হয়। (সহীহ মুসলিম:২৩৩)।
ঙ. নেক কাজে সর্বদা লেগে থাকে: মুমিন ব্যক্তির অন্যতম অনুপম আদর্শ হলো সে সর্বদা নেককাজে নিয়োজিত থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে এবং স্বীয় পালনকর্তার সমীপে বিনতি প্রকাশ করেছে তারাই বেহেশতবাসী, সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে।’ ( সূরা হুদ: আয়াত: ২৩ )। তিনি আরো বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পূণ্যশীলতা ও তাকওয়ার কাজে একে অপরকে সাহায্য কর।’ (সুরা মায়েদা: আয়াত: ২)। হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, একজন মুসলমান যতক্ষণ পর্যন্ত তার অপর মুসলমান ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে, ততক্ষণ আল্লাহও তার সাহায্যে হাত বাড়িয়ে রাখেন।’ (সহীহ মুসলিম, নাসাঈ ও তিরমিজি)।
চ. পাপ থেকে দুরে থাকে: প্রকৃত মুমিন আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক রাসুল (সা.) এর সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করে। সকল প্রকার পাপ কাজ থেকে নিজেকে দুরে রাখতে চেষ্টা চালায়। আল্লাহপাক বলেন, (মুমিন) বাজে কাজ থেকে দূরে থাকে। নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। (সুরা মুমিনুন: আয়াত: ৩ ও ৫)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা প্রকাশ্য ও গোপন পাপ বর্জন করো, যারা পাপ করে, অচিরেই তাদের পাপের সমুচিত শাস্তি দেওয়া হবে। (সুরা আনআম: আয়াত : ১২০)।
ছ. বড়দের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহ করে: মুমিন তার ইমানের দাবী অনুসারে বড়দের শ্রদ্ধা এবং ছোটদেরকে স্নেহ করে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যারা ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না তারা আমার দলের অন্তর্ভুক্ত নয়। (সুনানে আবু দাউদ: হাদিস: ৪৮৪২)।
জ. পরোপকারই ব্রত: মুমিন ব্যক্তির জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মুমিন নিজের জীবনকে অপরের কল্যাণে বা পরোপকারে বিলিয়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের নির্দেশ দেবে এবং মন্দ কাজে বাধা দেবে।’ (সুরা আলে-ইমরান: আয়াত: ১১০)। তিনি আরো বলেন, ‘সুতরাং তোমরা আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় কর এবং (তাঁর কথা) শ্রবণ কর ও (তাঁর) আনুগত্য কর এবং (তাঁর পথে) ব্যয় কর; এতেই তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে। যারা তাদের আত্মার কৃপণতা (স্বার্থপরতা ও লোভ) হতে মুক্ত, তারাই সফলকাম। যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণদান কর তবে তিনি তোমাদের জন্য তা বৃদ্ধি করবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন; আর আল্লাহ অতিশয় গুণগ্রাহী, পরম সহনশীল।’ (সূরা আত-তাগাবুন: আয়াত : ১৬-১৭)। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা জগদ্বাসীর প্রতি সদয় হও, তাহলে আসমানের মালিক আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতি সদয় হবেন।’ ( জা’মে তিরমিজি: হাদিস: ১৮৪৭)।
ঝ. আত্মসমালোচনা করে: প্রকৃত মুমিন নিজের কৃতকর্মের ব্যাপারে নিজে সচেতন। প্রতিদিনকার কর্মকান্ডে কোনটি সঠিক কোনটি বেঠিক এ নিয়ে আত্মসমালোচনা করে। আত্মসমালোচনার ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত আগামীকালের জন্য (অর্থাৎ আখিরাতের জন্য) সে কী প্রেরণ করেছে, তা চিন্তা করা। আর তোমরা তাদের মত হয়ও না, যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে, ফলে আল্লাহ তাদের আত্মভোলা করে দিয়েছেন (অর্থাৎ তারা কোন কাজটি ভালো, কোনটি মন্দ তা বাছাই করা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে)। নিশ্চয়ই তারা ফাসিক।’ (সূরা হাশর: আয়াত: ১৮)। হাদীসে এসেছে, হজরত ওমর (রা.) বলেন, ‘তোমরা নিজেদের আমলনামার হিসাব নিজেরাই গ্রহণ কর, চূড়ান্ত হিসাব দিবসে তোমাদের কাছ থেকে হিসাব গৃহীত হওয়ার পূর্বেই। আর তোমরা তোমাদের আমলনামা মেপে নাও চূড়ান্ত দিনে মাপ করার পূর্বেই। কেননা আজকের দিনে নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ করতে পারলে আগামীদিনের চূড়ান্ত মুহূর্তে তা তোমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই সেই মহাপ্রদর্শনীর দিনের জন্য তোমরা নিজেদের সুসজ্জিত করে নাও, যেদিন তোমরা (তোমাদের আমলসহ) উপস্থিত হবে এবং তোমাদের কিছুই সেদিন গোপন থাকবে না।’ (জা’মে তিরমিজি: হাদিস: ২৪৫৯)।
ঞ. দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন: মুমিন ব্যক্তি জিম্মদারীর ব্যাপারে সচেতন, এমনকি জবাবদিহিতার ব্যাপারেও। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর (কেয়ামত দিবসে) তোমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। সুতরাং জনগণের শাসকও একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর পুরুষ তার পরিবারের একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাবাদ করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর ঘরসংসার ও সন্তানের দায়িত্বশীল, তাকে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। গোলাম তার মনিবের মালসম্পদের ওপর একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই একেকজন দায়িত্বশীল। আর তোমাদের প্রত্যেককেই (কেয়ামত দিবসে) তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ( সহীহ বুখারি: হাদিস: ২৫৫৪; মুসলিম: হাদিস: ৪৮২৮)। আল্লাহপাক আমাদেরকে কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক আমল করার তাওফিক দান করুন।
লেখকঃ মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, সোনাপুর, নোয়াখালী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন