শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বইমেলা

যেভাবে শুরু অমর একুশে গ্রন্থমেলা

মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার | প্রকাশের সময় : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৯ এএম

বইমেলার ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, এর ইতিহাসও বইমুদ্রণের ইতিহাসেরই প্রায় সমকালীন। ইউরোপের ফ্রান্স, গ্রিস, বলগ্না, লিঁও, প্যারিস ও ফ্রাঙ্কফুর্টে বইমেলা খুবই প্রাচীন। ইউরোপে বইকে দেখা হয়েছে একই সঙ্গে অর্থনৈতিক পণ্য ও সাংস্কৃতিক উপাদান হিসেবে। সে কারণেই এর প্রচার, প্রসার ও বাজার সৃষ্টির জন্য ওই সব দেশে বইয়ের পসরা সাজিয়ে বই-বিক্রেতারা বসেছে নানা জায়গায়। বই বিকিকিনির এই আয়োজনকেই একালে চিহ্নিত করা হয়েছে বইমেলা হিসেবে।

আমাদের বইমেলা : বইমেলা, বাঙালির প্রাণের মেলা, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যের মেলা। প্রতি বছর ১ ফেব্রæয়ারী থেকে ২৮ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত বই বিক্রির মহৎসবকে আমরা বইমেলা হিসেবে জানি। ‘বইমেলা’ কিংবা ‘গ্রন্থমেলা’ শব্দ দুটি যেন বাঙালির প্রাণের স্পন্দে স্পন্দে রন্ধিত রয়েছে। ফেব্রæয়ারি আসলেই প্রতিটি বাঙালির নিশ্বাসে নিশ্বাসে ধ্বনিত হয় এই বইমেলা। ‘বইমেলা’ শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাংলা একাডেমি আয়োজিত ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। বইমেলা বইপ্রেমী মানুষের প্রাণে দোলা দেয়; জাতিসত্তার শক্তিবলে লাখ লাখ মানুষকে টেনে আনে একাডেমির বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে। আশপাশ ঘিরে জমে ওঠে লেখকদের জমজমাট আড্ডা; কাটে লেখক ও প্রকাশকদের নির্ঘুম রাত। প্রকাশিত হয় হাজার হাজার বই। নতুন বইয়ের মৌ মৌ গন্ধে মোহিত হয় মেলায় আসা পাটক ও দর্শনার্থীরা। কিন্তু আমরা হয়ত অনেকেই জানি না এই বইমেলার ইতিহাস। কিভাবে শুরু হলো এই বইমেলা? কে বাঙালির এই প্রাণের মেলার প্রারম্ভক? এ দেশে বইমেলার চিন্তাটি প্রথমে মাথায় আসে প্রয়াত কথাসাহিত্যিক জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদদীনের। তিনি বাংলা একাডেমিতেও একসময় চাকরি করেছেন। বাংলা একাডেমি থেকে ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিনি গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক পদে নিয়োগ পান। সেসময়ে তিনি ইউনেসকোর শিশু-কিশোর গ্রন্থমালা উন্নয়নের একটি প্রকল্পে কাজ করছিলেন। কাজটি শেষ হওয়ার পর তিনি একটি শিশু গ্রন্থমেলার ব্যবস্থাই করে ফেললেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি) নিচতলায়। যত দূর জানা যায়, এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। এরপরে তিনি ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলায় আলোচনা সভারও ব্যবস্থা ছিল। সে সব আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল হাই, শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও সরদার ফজলুল করিম। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রæয়ারি বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বিক্রি শুরু করেন শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা। তিনিই আমাদের প্রাণের এই বইমেলার প্রারম্ভক। তার আনা ৩২টি বই ছিল তার নিজ প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শরণার্থী সাহিত্যিকদের লেখা বই। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি বই মেলা উপলক্ষে ১৫ ফেব্রæয়ারি থেকে ২১ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। বাংলা একাডেমির পাশাপাশি মুক্তধারা প্রকাশনী, স্টান্ডার্ড পাবলিশার্স এবং আরও কয়েকজন বাংলা একাডেমির মাঠে নিজেদের প্রকাশিত বই বিক্রি শুরু করে। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি ১৪ ফেব্রæয়ারি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি তার নিজস¦ প্রকাশিত বই প্রদর্শন ও ম্যুরাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রফেসর আবু মহাম্মদ হবীবুল্লাহ। তখন একাডেমি প্রাঙ্গণ সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল। তাই ঢাকার বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান একাডেমি প্রাঙ্গনে নিজেদের পছন্দ মতো জায়গায় যে যার স্টল নির্মাণ করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এতে করে কিছুটা সমস্যা দেখা দেয়। তাই পরবর্তি বছর অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চুনের দাগ দিয়ে প্রকাশকদের জন্য কিছুটা জায়গা নির্দিষ্ট করে দেয় বাংলা একাডেমি। সেই নির্দিষ্ট স্থানে প্রকাশকেরা যে যার মতো স্টল তৈরি করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত এই আয়োজনের কোনো স্বীকৃতি দেয়নি বাংলা একাডেমি। এমনকি কোনো নামও দেয়নি। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনেও এর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। এমনকি এই সময়ে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানসূচিতেও এর কোন উল্লেখ নেই। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন আশরাফ সিদ্দিকী। তিনি বইমেলার গুরুত্ব কিছুটা হলেও বুঝতে পারেন। তার স¦উদ্যোগে বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়। শুরু হয় বইমেলার গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ের। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। অমর একুশে ফেব্রæয়ারির উপর লক্ষ রেখে ৭ ফেব্রæয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত বইমেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলা একাডেমি এবং বইমেলার নামকরণ করে ‘একুশে গ্রন্থমেলা’। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এই নিয়মেই ‘একুশে গ্রন্থমেলা’ পালিত হয়। ১৯৮১ সালে ‘একুশে গ্রন্থমেলায় পরিবর্তন আনে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। ‘একুশে গ্রন্থমেলা’র মেয়াদ কমিয়ে ২১ দিনের পরিবর্তে ১৪ দিন ধার্য করে বাংলা একাডেমি। কিন্তু প্রকাশকরা বাংলা একাডেমির এ সিন্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। তারা বাংলা একাডেমির এ সিন্ধান্তের বিরুদ্ধে তাদের দাবি তুলে ধরে।

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রæয়ারি অমর একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন ভাষাবিদ হুমায়ুন আজাদ। তার ওপর হামলার পর বিক্ষোভে ফেটে পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা। গুরুতর আহত ড. হুমায়ুন আজাদ ২২ দিন সিএমএইচ হাসপাতালে এবং ৪৮ দিন ব্যাংককে চিকিৎসাধীন থেকে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেন। হুমায়ুন আজাদের উপর চরমপন্থী ইসলামী জঙ্গিরা এই হামলা চালিয়েছিল বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে। ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট ড. হুমায়ুন আজাদ জার্মানিতে মারা যান। ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে বইয়ের স্টলগুলোতে দূবৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দেয়। ২০১৪ সালে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’য় স্টলের সংখ্যা বাড়িয়ে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যানে স্থানান্তরিত করে। বইমেলা চলাকালীন প্রতিদিন বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা সভা, কবিতা পাঠের আসর, লেখক আড্ডাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজ করে থাকে বাংলা একাডেমি। সন্ধ্যার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মনমুগ্ধকরতা শ্রোতাদেরকে মুহিতকরে। এছাড়া লেখককুঞ্জে লেখকদের সাথে পাঠকদের মন বিনিময়ের আয়োজনও করে থাকে বাংলা একাডেমি।

লেখক : বাংলাদেশ জ্ঞান সৃজনশীল প্রকাশক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক, বাংলা পোস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন