প্রকাশনার ২৫ বছর পেরিয়ে আসা সংবাদপত্রগুলোকে সম্মাননা প্রদান করলো নিউজ পেপার ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-নোয়াব। গতকাল ঢাকা ক্লাবের স্যামসন এইচ হলে আয়োজিত জমকালো অনুষ্ঠানে দেশের অগ্রযাত্রায় অবদান রাখা সংবাদপত্রগুলোকে ‘২৫ পেরোনো নোয়াব সদস্য সংবাদপত্র সম্মাননা ২০২২’ স্মারক তুলে দেয়া হয়। সম্মাননা পাওয়া পত্রিকাগুলো হচ্ছে দৈনিক সংবাদ, ইত্তেফাক, আজাদী, পূর্বাঞ্চল, করতোয়া, পূর্বকোণ, ইনকিলাব, ভোরের কাগজ, জনকণ্ঠ, ডেইলি স্টার ও ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, বিশেষ অতিথি তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। সূচনা বক্তব্য রাখেন নিউজ পেপার ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- নোয়াবের সভাপতি এ কে আজাদ। সভাপতিত্ব করেন নোয়াবের সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ খান বাদল। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন নোয়াব এর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হানিফ মাহমুদ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য মতিয়া চৌধুরী, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, বাসদের খালেকুজ্জামান, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাজাহান ওপর বীরবিক্রম, বিকল্প ধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সাবেক তত্ত্ববাধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুরে এলাহী, চীনের উপ-রাষ্ট্রদূত হা লং, পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার কামার আব্বাস খোখার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রতিনিধিদল, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট সাংবাদিক শওকত মাহমুদ, যুগান্তর সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি, বিশিষ্ট সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, বিএফইউজে একাংশের সভাপতি ওমর ফারুক, বিএফইউজের সাবেক সভাপতি মোল্লা জালাল, বিএফইউজে অপর অংশের সভাপতি এম আব্দুল্লাহ, মহাসচিব নূরুল আমিন রোকন, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, নিউ এইজ সম্পাদক নূরুল কবীর, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, বাংলাদেশের খবর সম্পাদক আজিজুল ইসলাম ভুইয়া, কবি আসাদ চৌধুরী প্রমুখ।
সম্মাননা পাওয়া পত্রিকাগুলোর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন, সংবাদের সম্পাদক আলতামাশ কবির, ইত্তেফাক সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, দৈনিক আজাদী সম্পাদক ও প্রকাশক এম এ মালেক, দৈনিক করতোয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক মোজাম্মেল হক, দৈনিক পূর্বকোণের সম্পাদক ও প্রকাশক ড. রমিজ উদ্দিন চৌধুরী, ভোরের কাগজের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক তারিক সুজাত ও ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ ও ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম।
ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, অবাধ তথ্যপ্রবাহ গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে। সংবাদপত্র বাংলাদেশের উন্নয়নে, সমাজ বিকাশে ও বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। মানুষকে আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তুলতে সংবাদপত্রের ভূমিকা অতুলনীয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতামত তৈরিতে ভূমিকা রাখে, প্রভাবিত করে। সে কারণে সংবাদপত্রের দায়িত্ব অনেক। ভুল তথ্য, মিথ্যা সংবাদ সমাজে নেতিবাচক প্রভাব রাখে। আর ইতিবাচক সংবাদ সুন্দর সমাজ ও দেশ গড়ে তুলতে পারে। তাই সংবাদপত্রকে সততার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পেশাগত দায়িত্ব চালিয়ে যেতে হবে।
বিশেষ অতিথি ড. হাছান মাহমুদ বলেন, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সরকারের চমৎকার সম্পর্ক। সরকার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী; যেকোনো সমালোচনা গ্রহণে প্রস্তুত। তবে সমালোচনার পাশাপাশি উন্নয়ন ও অর্জনের কথাও বলতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সংবাদপত্র দেশ গঠনে মানুষের মনন তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে, স্বাধীনতা পরবর্তী দেশ গঠণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রিন্ট মিডিয়া নানা চ্যালেঞ্জের পরেও তার গুরুত্ব একেবারেই কমেনি। সরকার গণমাধ্যমের বিকাশে সবসময়ই সচেষ্ট। গণমাধ্যমের বিকাশ না ঘটলে দেশের বিকাশে ঘটা সম্ভব নয়। তথ্যমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট কোনোভাবেই গণমাধ্যমের জন্য নয়। এটা সাধারণ মানুষের জন্য। সিঙ্গাপুর, ভারত, মাকিূন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়াও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এ আইন করেছে। তবে, এ আইনের মাধ্যমে সাংবাদিক এবং সাধারণ মানুষ যাতে ভোগান্তির শিকার না হয় তা নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, গণমাধ্যমকর্মী আইন সংবাদকর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবি। এ আইনের মাধ্যমে সংবাদপত্রের পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক ও অনলাইনের সংবাদকর্মীদের ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য খারাপ সময় যাচ্ছে মন্তব্য করে ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন বলেছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার কোনো সামাজিক ও সত্যতার দায়দায়িত্ব নেই। তারা যেনতেন খবর প্রচার করে রাজনীতিবিদদের পর্যন্ত বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে। এ অবস্থায় প্রিন্ট মিডিয়ায় খারাপ অবস্থা যাচ্ছে। এত খারাপ সময়ের মধ্যেও টিকে আছি, এটা বড় অর্জন। আশা করছি, আমাদের আবারও ভালো সময় আসবে ইন শা আল্লাহ। কারণ পাঠকের সত্য খবর তালাশে প্রিন্ট মিডিয়ার বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ইনকিলাব এখনও একটি অথেনটিক এবং জেনুইন সত্য সংবাদ দেয়ার চেষ্টা করে থাকে।
এ এম এম বাহাউদ্দীন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জাতীয় সংসদের স্পিকার, তথ্যমন্ত্রী, ড. কামাল হোসেনসহ উপস্থিত নোয়াবের সদস্যদের অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, প্রথমেই নোয়াবের সদস্য এবং বিশেষ করে একে আজাদ সাহেবকে ও হানিফ সাহেবকে ধন্যবাদ। তারা একটা মহতী উদ্যোগ নিয়েছেন। একটা সময় একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে আমরা এখনও টিকে আছি। ১৯৮৬ সালে যখন ইনকিলাব শুরু করেছিলাম, তখন ইত্তেফাকের ঠিক অর্ধেক বয়স আমাদের। সংবাদ একদম জমজমাট, সে সময় এতো মিডিয়া কিছু ছিল না। কিন্তু অনেক বিশাল তাদের (ইত্তেফাক) সারা দেশে অবস্থান ছিল। সে অবস্থায় ইনকিলাবের প্রকাশনা শুরু করেছি। শুরু করে ওই সময়ের সেরা প্রযুক্তি ব্যবহারের চেষ্টা করেছি এবং আমরা প্রকাশনা জগতে ভিন্ন ধারা আনার চেষ্টা করেছি।
এ এম এম বাহাউদ্দীন বলেন, সময়ের সাথে সাথে অর্থনৈতিক দুরবস্থা, টেলিভিশন, সংবাদপত্রের পেছনে করপোরেট হাউসের উপস্থিতি, মানুষের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন করে দিয়েছে। তারপরও আমরা আল্লাহর রহমতে টিকে আছি। ইনকিলাব এখনও একটি অথেনটিক এবং জেনুইন সত্য সংবাদ দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। একটা অথেনটিক নিউজপেপারের যে গুরুত্ব ইউক্রেন যুদ্ধ দিয়ে দেখা যায়, সোশ্যাল মিডিয়া রাজনীতিবিদদের পর্যন্ত বিভ্রান্ত করে দিয়েছে। অনেক রকম ফেক নিউজ-ভিডিও ছড়াচ্ছে। কিন্তু সংবাদপত্রে একটা নিউজ দেয়ার জন্য যেই ধরনের চেকিং, কাউন্টার চেকিং হয়; সেটা অনলাইন মিডিয়াতে বা এখন নতুন নতুন অনেক সোশ্যাল মিডিয়াতে সেটা সম্ভবপর হয় না। আগে প্রকাশের জন্য প্রতিযোগিতা থাকে। ফলে সঠিক তথ্যের জন্য এখনো পাঠকদের কাছে অথেনটিক নিউজপেপারের গুরুত্ব আছে, আগামীতেও থাকবে ইন শা আল্লাহ। পত্রিকা ছাপা থেকে শুরু করে সবকিছুই মূল্য এতো বেড়ে গেছে যে, এখন প্রিন্ট মিডিয়ার অবস্থা সত্যিই খারাপ সময় যাচ্ছে। আমরা এত খারাপ সময়ের মধ্যেও টিকে আছি এবং বিশ্বাস করি আমাদের আবারও ভালো সময় আসবে ইন শা আল্লাহ। যে লক্ষ্য নিয়ে পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করেছিলাম, ইন শা আল্লাহ সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। মানুষ এখন যেমন প্রকৃত খবরের জন্য প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন; আগামীতেও থাকবেন। বরং প্রিন্ট মিডিয়ার গুরুত্ব আরো বাড়বে।
তাসমিমা হোসেন বলেন, ইত্তেফাক ও সংবাদের যখন জন্ম হয়েছিল তাদের অবদান সম্পর্কে আজকের বেশিরভাগ মানুষই জানেন না। সেই বৈরী সময়ে যে সীমাহীন বাধা নিয়ে পত্রিকাগুলো বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করেছে তা অনেকটা অনুচ্চারিতই রয়ে গেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সময়ের সন্ধিক্ষণে, উন্নয়নের সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে। একটা নতুন দিন। কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো আজকের এই নতুন দিনে পৌঁছাতে দীর্ঘ দিনের সংবাদপত্র বস্তুনিষ্ঠ প্রকাশের মাধ্যমে দেশকে পথনির্দেশ দিয়ে এসেছে।
তিনি বলেন, সংবাদপত্র এখন নানা বাধার মুখে। নিউজপেপার, কালি এখনও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। সরকারের ঘরে বিজ্ঞাপনের টাকা দীর্ঘ সময় ধরে আটকে থাকা, ট্যাক্স, ওয়েজবোর্ড সবকিছু মেনে সংবাদপত্র পরিচালনা করা খুব চ্যালেঞ্জিং। এত বাধার পরেও পত্রিকার প্রকাশনা থামিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। আমাদের ওপরে ঐতিহাসিকভাবে অর্পিত দায়িত্ব আমার পালন করে চলেছি।
মাহফুজ আনাম বলেন, সংবাদপত্রগুলো সুসম্পর্ক চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এই অগ্রযাত্রায় সাংবাদিকরাই অংশীদার। সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। সংবাদপত্রে একইসঙ্গে ভালো এবং যেখানে কর্তৃপক্ষের অসম্পূর্ণতা রয়েছে সেখানে নজর দেই। স্বাধীন সাংবাদিকতার মাধ্যমে তা মানুষের কাছে এবং সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দিতে কাজ করে। কিন্তু এ কাজগুলোকে বাধাগ্রস্ত করতে অনকেগুলো আইন রয়েছে। এসব আইনের সংশোধনের প্রযোজনীয়তার কথা বলেন মাহফুজ আনাম।
আলতামাশ কবির বলেন, সংবাদ প্রায় ৭২ বছর ধরে বস্তুনিষ্ঠ, গঠনমূলক সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা করে এসেছে। যারা দীর্ঘ সময় ধরে সংবাদ প্রকাশ করছেন তাদের সবাইকেই শুভেচ্ছা জানাই। সংবাদ প্রকাশের জন্য অনেক সাংবাদিককে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। সংবাদপত্র সবসময়ই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আইনের অবৈধ প্রয়োগ করে সংবাদপত্রকে যেন বাধাগ্রস্ত করা না হয় এটাই সরকারের কাছে আবেদন।
সূচনা বক্তব্যে এ কে আজাদ বলেন, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরপরই দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশিত হয়। সে সময় থেকে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলোতে তারা সাহস ও সততার সঙ্গে ভূমিকা পালন করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গণমাধ্যম এদেশের জনগণের সঙ্গে ছিল। তাই আজকের অনুষ্ঠানে এমন সংবাদপত্রগুলোকে সম্মাননা জানাতে পেরে নোয়াব আনন্দিত।
তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের সংবাদপত্রগুলো সঙ্কটে পড়েছে। ডিজিটাল মিডিয়ার আগ্রাসী উত্থানে সংবাদপত্রের বাজার সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। কাগজের পাঠক ও বিজ্ঞাপন দুই-ই কমছে। এর মধ্যে টিকে থাকার চেষ্টা করছে ছাপা পত্রিকা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই খাতে সরকারের আরও সহযোগিতা দরকার। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে কিছু আইনের অপব্যবহারের গণমাধ্যম কর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। এ আইনগুলোর সংস্কার প্রয়োজন।#
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন