বিজ্ঞানের কাছে নিঃশর্ত সমর্পিতরা যখন অজ পাড়া গাঁয়ের রাহেলা বেগমদের মতো আঙ্গুল বোঝাই করে আংটি পরেন তখন বিস্মিত হতেই হয়। বিজ্ঞানের মান যাবে বলে যারা খোদার কালাম বুকে তুলে নিতে পারেনি, অদেখা সত্যকে মানতে হবে বলে যারা বিশ্ব জাহানের অধিপতির কাছে সমর্পিত হতে পারেনি তারাই যখন না দেখা রাশির ভয়ে বিশালায়তন রাশিম্যাগাজিন ছড়িয়ে উবু হয়ে পড়ে থাকেন গভীর মগ্নতায় তখন সত্যিই ভেবে বিব্রত হই-এ কেমন তেলেসমাতি বৈপরীত্ব গো! বৈপরীত্ব হলেও বাস্তবতা এটাই, যারা আল্লাহ-খোদা মানে না, ধর্মের প্রতি যাদের সীমাহীন ভয়, বিজ্ঞানের প্রতি যাদের অতিরিক্ত শ্রদ্ধা, রাশিম্যাগাজিনের তারাই ক্রেতা, সংরক্ষক, পাঠক এবং পরম বিশ্বাসী ভক্ত।
মজার বিষয় হল আমাদের সমাজের যেসব তরুণ-তরুণী অতি আধুনিকতার জাত রক্ষার্থে ধর্মচিন্তার বারান্দা দিয়ে হাঁটে না, অনেকে তো ধর্মকে কুসংস্কার বলে তৃপ্তি পায় (নাউজুবিল্লাহ)-দেখি সেসব তরুণ-তরুণী বছরের শুরুতে রাশিচক্রের পত্রিকা একখানা কিনবেই। আর কেউ যদি জ্যোতিষীর দরবারে হাতপাতা অবস্থায় মডেল হতে পারে কোনো খ্যাত কিংবা অখ্যাত কাগজে, তার রাশি আর ঠেকায় কে?
জ্যোতিষীর দরবারে ভিখারির মতো হাত পেতে বসার এই চিত্র যখন পত্রিকার পাতায় দেখি তখন আমার কাছে মনে হয়, এ যেন এক অদৃশ্য শাস্তি বিধান। যারা সকল শক্তির উৎস, সমগ্র জাহানের সৃষ্টিকর্তা প্রভুর কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে পারেনি আহকামুল হাকিমীন আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে ঠেলে দিয়েছেন ওই জ্যোতিষীর কাছে। অতঃপর মহান মনিবের দরবারে হাত না পাতার অপরাধে হাত পেতে বসে আছে মনিবের এক তুচ্ছ দাসের সমীপে।
এরচেয়েও বড় হতাশার কথা হলো, আমাদের সমাজে যারা মসজিদে এসে নামাজ পড়েন, বিশ্বাস করেন ভবিষ্যৎ সংবাদ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না, তারাও যান জ্যোতিষীর কাছে। কেউ যায় অর্থের অর্থহীন আবেদনে আবার কেউ যায় দারিদ্র্যের তাড়া খেয়ে।
অথচ পবিত্র ইসলামের দৃষ্টিতে যেমন হস্তরেখার আলোকে বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণীর কোনো ভিত্তি নেই এবং তার প্রতি বিশ্বাস রাখা বৈধ নয়, তেমনি চোখের সামনে দাঁড়ানো বাস্তবতাও সমর্থন করে না এর সত্যতাকে। কারণ ওই রেখাবিদ মশায়ের ভবিষ্যদ্বাণী ও তার দেয়া ফর্মুলাই যদি সঙ্কট উত্তরণের সত্যপথ হতো তাহলে ঝড়-বৃষ্টি-রোদে দাঁড়িয়ে আজীবন ভবিষ্যদ্বাণীর ফেরি করে বেড়াতে হত না এই ভাগ্য নির্দেশককে।
ইসলামের দৃষ্টিতে রাশিচক্র একটি ধোঁয়া। গণক জ্যোতিষীকে হাত দেখানো কঠিন পাপ। কোনো মানুষকে ক্ষতি করার মতো নিজস্ব কোনো ক্ষমতা গ্রহ-নক্ষত্র কেন কোনো মানুষেরও নেই। মানুষের ভাল-মন্দ সকল পরিণতি সম্পর্কে পরিপূর্ণরূপে জ্ঞাত আছেন কেবল আল্লাহ তা’আলা। কল্যাণকামনা কিংবা অকল্যাণ থেকে মুক্তির জন্য হাতপাততে হবে শুধু তাঁরই কাছে। তিনিই পারেন অনাকাক্সিক্ষত ভবিষ্যৎ ও ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে রক্ষা করতে। অন্য কেউ কিংবা অন্য কিছু নয়।
লা’ল, ইয়াক‚ত, যমরদ, আকীক আর ফিরোযা পাথরের দোহাই দিয়ে কঠিন বিপদ তো দূরের কথা এডিস মশা তাড়ানোও সম্ভব নয়। যদি সম্ভব হত তাহলে, সবার আগে দেশের শঙ্কা-ভয়-আকাল আর দলের বিপদ কাটাবার জন্য দলীয় প্রতিটি সরকার ডজন ডজন জ্যোতিষী নিয়োগ করত। পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠত জ্যোতিষী স্কুল। চাষ হত আকীক আর ফিরোযা পাথরের। এত সহসা কুপোকাত হত না ধনী-ব্যবসায়ী বিত্তবানরা ত্রাসী ঘাতকের হাতে।
সারিসারি দেবতার মন জয় করে কাবু যে মুশরিক গোষ্ঠী মূলত তারাই ক্ষুদ্র ভগবান হিসেবে চাপিয়ে দিয়েছে আমাদের ধর্ম বিমুখ বন্ধুদের উপর বেগুনাহ কতিপয় পাথরকে, যে পাথরকে আজ তারা শ্রদ্ধায় বিশ্বাসে বরণ করে, ঠিক সেভাবেই, যেভাবে মুশরিকরা বরণ করে তাদের হাতের তৈরি মূর্তিকে।
বড় কথা হল, এই মাটির পৃথিবীতে আমরা কোনো উদ্দেশ্যেহীন সৃষ্টি নই। মাটির পৃথিবীকে সমূহ কল্যাণকর্মে আবাদ করে তোলার এক অপার্থিব লক্ষ্যে আমাদের আগমন। সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাহ হিসাবে আমাদের কর্মপদ্ধতি, কর্মসূচী সবই সুচিন্তিত ও সুরক্ষিত। সবিশেষ পৃথিবীর সকল অন্যায়-অবিচার ও অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিকে জয় করে খোদার রাজত্ব প্রতিষ্ঠাই উম্মাহর দায়িত্ব।
আর এই দায়িত্ব পালনে প্রথম সারির সৈনিক হিসেবে জীবন-মরন, সাধ-স্বপ্ন বাজি রেখে এগিয়ে যাবে উম্মাহর তাজাপ্রাণ তরুণেরা। যেভাবে তারা এগিয়ে গেছে যুগেযুগে নির্মাণে, সংস্কারে, প্রতিবাদে, প্রতিরোধে। জানি না কেন যেন আমার কাছে মনে হয় রাশির কুমন্ত্রণা দিয়ে সেই দীপ্ত কর্মমুখর তারুণ্যকে সংশয়ের ফাঁদে ফেলারই এক শয়তানি কৌশল, এই রাশিকেন্দ্রিক রাশিরাশি আয়োজন।
সুতরাং রাশির তৈরি ফাঁদের রশিতে পা দেয়া নয়, প্রয়োজন নতুন বছরের এই সূচনাপর্বে আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ সমর্পণ। এই মুহূর্তে রাশিফলের সংশয়পত্র কিংবা আকীক পাথর নয়, আমাদের হাত ধরে আমাদের কর্মে ও বিশ্বাসে উঠে আসুক চিরন্তন সফলতার বিশ্বস্ত রাহবার আলকুরআন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন