শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

খেলা ফিচার

বছরটি রোনালদোর, রিয়ালেরও

| প্রকাশের সময় : ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

দেখতে দেখতে স্মৃতির পটে হারিয়ে যাচ্ছে আরেকটি বছর। বিদায় নেয়ার পথে ২০১৬ সাল। অপেক্ষা নতুন বছর ২০১৭ সালকে স্বাগত জানানোরা। ক্রীড়াঙ্গণেও সেই বিদায়ের সুর। চলছে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব-নিকাশ। সত্যিই তো কেমন কাটলো এবছরটি? কার ঝুলি সমৃদ্ধ হলো কতোটা? কিংবা, নতুন কোন চমক নিয়ে হাজির ছিলেন কী কেউ? তারই খতিয়ান তুলে ধরতে দৈনিক ইনকিলাবের পাঠকদের জন্য ২০১৬ সালটিকে আরেকবার স্মৃতিচারণ করাতে ধারাবাহিক আয়োজন ‘সালতামামি’। আজ থাকছে আন্তর্জাতিক ফুটবলের খবরা-খবর। লিখেছেন ফারুক হোসাইন

চলতি বছরের শুরুর দিকে কাতালানভিত্তিক পত্রিকা দ্য স্পোর্টস ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ছবিসহ একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, যার শিরোনাম ছিল- ‘দ্য এন্ড’। টানা কয়েকম্যাচ গোলশূন্য, দলের পাশাপাশি নিজেও প্রচ- বাজে ফর্মের মধ্যদিয়ে যাচ্ছিলেন। ব্যস, চারদিকে হৈচৈ- তাহলে কি ফুরিয়ে গেলেন রোনালদো? বয়সের কাছে হার মেনে গেলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো?
তবে শুনেছি, সাহসীরা নাকি হার মানেন না। একটা পরাজয়ে পিছিয়ে পড়েন না। আত্মবিশ্বাস, কঠোর পরিশ্রম, একাগ্রতার মাধ্যমে আবারো বিজয়ীর হাসি হাসেন। রোনালদো তো তেমনই সাহসী একজন। জন্মের পর থেকেই যে তিনি লড়তে শিখে গেছেন। অভাবের সাথে নিত্যদিন যুদ্ধ করে যে আজকের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো হয়ে উঠেছেন, তিনি কী করে এত সহজে হার মানেন?
তিনি হার মানেননি, তিনি ফিরে এসেছেন; পারফরম্যান্স দিয়েই সব সমালোচকদের মুখ বন্ধ করেছেন। বছরের শুরুতে সেই ম্লান হাসির রোনালদো বছরটা শেষ করছেন হাসিমুখে। বছরের শুরুতেই যার হাত ছিল শূন্য, ১২ মাস ঘুরতেই তার দু’হাত আজ অর্জনে পরিপূর্ণ। জাতীয় দল কিংবা ক্লাব- সব জায়গাতেই জায়গাতেই রোনালদো পারফরম্যান্স আর অর্জনের দিক থেকে ছিলেন উজ্জ্বলতর এক নক্ষত্র।
চ্যাম্পিয়নস লিগ, ইউরো কাপ, উয়েফা সুপার কাপ, ক্লাব বিশ্বকাপ- একই বছরে জিতেছেন এই চারটা দলগত ট্রফি। ব্যক্তিগত অর্জন হিসেবে আছে ইউরো পটি, ইউরো সিলভার বুট, ব্যালন ডি’অর, সাথে ক্লাব বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বল। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ফুটবলার হিসেবে ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে ৫০০ গোল করেছিলেন, যার শেষটা করেছেন শুধুই ক্লাবের হয়ে ৫০০ গোল করে- যেখানে এই শতাব্দীতে শুধু তিনিই রাজা।
টানা সাতটা টুর্নামেন্টে গোল কিংবা চার ইউরোতে গোল, বা দুই ক্লাবের হয়ে ক্লাব বিশ্বকাপে গোলের কীর্তিও এই রোনালদোর। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে আগেই সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন, বছর শেষে ক্লাব বিশ্বকাপেরও সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেন। ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ থেকে ক্লাব বিশ্বকাপ নামকরণ হওয়ার পর এই টুর্নামেন্টের ফাইনালে কেউ হ্যাটট্রিক করতে পারেননি। রোনালদো সেই রেকর্ড টাও নিজের করে নিলেন। ফুটবল স¤্রাট পেলের পরে দ্বিতীয় ফুটবলার হিসেবে আর আধুনিক ক্লাব বিশ্বকাপের একমাত্র ফুটবলার হিসেবে ফাইনালে হ্যাটটিক করার নজির গড়লেন।
এই বছরে ৫৭ ম্যাচে ৫৫ গোলের পাশাপাশি অ্যাসিস্ট করেছেন ১৭ বার, সাথে ব্যক্তিগত অর্জনগুলো ছিল ঈর্ষা করার মতোই। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ক্যারিয়ারের ৪০ বার গোলের হ্যাটট্রিক; জাতীয় দলের হয়ে ১৩ ম্যাচে ১৩ গোল; কিংবা সব মিলিয়ে সর্বশেষ ১৬ ম্যাচে ১৮ গোল- এই ক্রিস্টিয়ানো ছুটছেন অবিরাম গতিতেই। রিয়াল মাদ্রিদের টানা ৩৭টি ম্যাচে না হারার রেকর্ড সাথে রোনালদোর। দিন দিন রোনালদো এই ফুটবল কারিশমার পরিধি বাড়ছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, সাফল্যই যেন তার পিছনে ছুটছে। সত্যি, ২০১৬ সালটা শুধুই সিআর সেভেনের।
তার চতুর্থবারের মতো ব্যালন ডি’অর জিতে নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায়। ইয়োহান ক্রুইফ, মিশেল প্লাতিনি, মার্কো ফন বাস্তেন কিংবা ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারদের ছাপিয়ে যাওয়া এই অর্জনে পর্তুগিজ তারকা নিজেকে সর্বকালের সেরা ইউরোপিয়ান ফুটবলার ভাবতেই পারেন।
গত জানুয়ারিতে ফিফা-ব্যালন ডি’অরের পুরস্কারটা পাওয়া হয়নি তার। আর্জেন্টাইন তারকা লিওনেল মেসি তাকে পেছনে ফেলে পুরস্কারটা জিতে নেয়ার পর অনেকেই ভেবেছিলেন পর্তুগিজ তারকা বোধ হয় আর কখনোই ‘সেরা’ হতে পারবেন না। কিন্তু ব্যালন ডি’অর ফিফার মালিকানা থেকে বেরিয়ে ফ্রান্স ফুটবলের একক মালিকানায় আসতেই পুরস্কারটি যেন খুঁজে নিল তার পুরনো প্রার্থীকে। ২০০৮ সালে ফ্রান্স ফুটবলের অধীনে থাকার সময়ই প্রথমবারের মতো ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন রোনালদো। এরপর ফিফার অধীনে চলে যাওয়ার পর রোনালদো জিতেছেন একবার। লিওনেল মেসির মতো ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলারের সঙ্গে দ্বৈরথ লড়েই তার এ অর্জন। ফ্রান্স ফুটবলের অধীনে দুবার, আর ফিফার অধীনে দু’বার- রোনালদোর মোট চারবারের ব্যালন ডি’অর অর্জন পাঁচবার জয়ী লিওনেল মেসির পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। একই পুরস্কার ইয়োহান ক্রুইফ, মিশেল প্লাতিনি, মার্কো ফন বাস্তেন জিতেছেন তিনবার করে, বেকেনবাওয়ার, কিগান, রুমেনিগেরা দুইবার করে। রোনালদো এই গ্রেটদের সবাইকে ছাপিয়ে গিয়ে নিজেকে সর্বকালের সেরা তাই ভাবতেই পারেন!
রোনালদোর এদের সবার চেয়ে হয়তো এগিয়ে থাকবেন অন্য একটা কারণে। তাকে লড়তে হচ্ছে লিওনেল মেসির মতো একজনের সঙ্গে। ক্রুইফ, প্লাতিনি, বাস্তেনদের কী মেসির মতো কোনো ‘চ্যাম্পিয়নের’র সঙ্গে লড়তে হয়েছিল? বেকেনবাওয়ার, রুমেনিগেরাও তো ইউরোপীয় সার্কিটে রোনালদোর মতো কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি হননি। একবার করে ব্যালন ডি’অরের স্বাদ পাওয়া রুদ খুলিত, রাবার্তো বাজ্জো, জর্জ বেস্ট, ববি চার্লটন, ইউসেবিও, লুইস ফিগো, জিনেদিন জিদান, জার্ড মুলার, জিয়ান্নি রিভেরা, রিস্টো স্টয়চকভরাও অর্জনে রোনালদোর চেয়ে পিছিয়ে থাকবেন বড় ব্যবধানেই। যদিও তাদের অনেকেরই শ্রেষ্ঠত্ব কেবল ব্যালন ডি’অর দিয়ে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়।
মেসির মতো ফুটবলারের যুগে তার সঙ্গেই জোর লড়াই চালিয়ে চারবার ব্যালন ডি’ অর জয়, সঙ্গে ক্যারিয়ারে ৪৯৯ গোল রোনালদোকে সবার চেয়ে এগিয়ে দিচ্ছে পরিসংখ্যানে। মেসিকে তো অনেকেই সর্বকালের সেরা হিসেবে মেনে নিতে চান। এই একটি জায়গায় ক্রুইফ, প্লাতিনি, বাস্তেন কিংবা ফিগো, জিদানরা পিছিয়ে পড়েন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর চেয়ে। তাহলে কি রোনালদোই সর্বকালের সেরা ইউরোপীয় ফুটবলার? ব্যাপারটা অবশ্যই তর্ক-সাপেক্ষ। বিশেষ করে ক্রুইফ, প্লাতিনি, জিদানদের খেলতে দেখা প্রজন্মের এতে একমত না হওয়াই স্বাভাবিক। তবে কেবল ব্যালন ডি’অরকে যদি মানদ- ধরা হয়, রোনালদো এগিয়ে থাকবেন বড় ব্যবধানেই!
আগে থেকেই এই পুরস্কারের জন্য অনেক এগিয়ে থাকা রোনালদো অবশ্য ছিলেন না অনুষ্ঠানে। ক্লাব বিশ্বকাপে খেলতে রিয়ালের হয়ে এখন তিনি জাপানে। প্রীতি ম্যাচ খেলতে বার্সেলোনা দলের সঙ্গে কাতারের পথে মেসিও। গত অক্টোবরে এই পুরস্কারের জন্য ৩০ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ করেছিল ফ্রান্স ফুটবল। লড়াইয়ে ছিলেন গতবারসহ পাঁচবারের বর্ষসেরা মেসি, গত বছর তৃতীয় হওয়া নেইমার, বার্সেলোনার গত মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা লুইস সুয়ারেজ, বছরজুড়ে ক্লাব ও দেশের হয়ে দুর্দান্ত খেলা ফরাসি ফরোয়ার্ড অঁতোয়ান গ্রিজমানের মতো তারকারা। দ্বিতীয় সেরা হয়েছেন বার্সেলোনার হয়ে গত মৌসুমে লা লিগা ও কোপা দেল রে জেতা মেসি। আতলেতিকো মাদ্রিদের তারকা গ্রিজমান হয়েছেন তৃতীয়। উরুগুয়ের তারকা স্ট্রাইকার সুয়ারেজ চতুর্থ ও ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমার পঞ্চম হয়েছেন।
বছরজুড়ে অসাধারণ খেলা রোনালদোর ব্যক্তিগত ও দলগত সাফল্য ছিল আকাশচুম্বী। রিয়ালের হয়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার দুই মাসের মধ্যে গত জুলাইয়ে দেশকে প্রথমবারের মতো ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ জেতাতে নেতৃত্ব দেন তিনি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গত আসরে সর্বোচ্চ ১৬ গোল করা ও চারটি গোল করানো রোনালদোকে সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালে ঠিক স্বরূপে দেখা যায়নি। কিন্তু অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে ফাইনালে টাইব্রেকারের জয়সূচক গোলটি করেছিলেন তিনি। গত মৌসুমে লা লিগায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৫ গোল করেছিলেন রানার্সআপ হওয়া রিয়ালের এই তারকা ফরোয়ার্ড। আর সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছিলেন পাঁচটি গোল। এ মৌসুমে এখন পর্যন্ত ১০টি গোল করেছেন তিনি। ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে দেশকে প্রথম শিরোপা জেতাতে নেতৃত্ব দেওয়া রোনালদো চোট পেয়ে ফাইনালের শুরুতেই ছিটকে পড়েছিলেন। কিন্তু তিন গোল করে ও সতীর্থদের দিয়ে দুটি করিয়ে দলকে ফাইনালে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল তার। ২০১৬ সালে ৪২ ম্যাচ খেলে মোট ৩৮টি গোল করেন রোনালদো, সতীর্থদের দিয়ে করান ১৪টি। সাম্প্রতিক সময়েও জাতীয় দলের হয়ে ছন্দে আছেন রোনালদো। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে তিন ম্যাচ খেলে করেছেন ৭ গোল।
নিজের চতুর্থ ব্যালন ডি’অর জিতে এসেছিলেন ক্লাব বিশ্বকাপ খেলতে। ব্যক্তিগত পুরস্কারটা উদযাপন করতে রোনালদোর সম্ভবত একটা ট্রফিরও দরকার ছিল। সেটি পেয়েও গেলেন রিয়াল মাদ্রিদ ফরোয়ার্ড। আসলে বলা উচিত অর্জন করে নিলেন। দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক করেছেন, তাতে জাপানের কাশিমা অ্যান্টলার্সকে ৪-২ গোলে হারিয়ে ক্লাব বিশ্বকাপের ট্রফিও জিতে নিল রিয়াল। রোনালদোর সঙ্গে পূর্ণতা পেল জিদানের ‘আন্তর্জাতিক অভিযান’। দায়িত্ব নেওয়ার পর রিয়ালের হয়ে আন্তর্জাতিক তিনটি শিরোপায় অংশ নিয়েছিলেন- চ্যাম্পিয়নস লিগ, উয়েফা সুপার কাপ ও এই ক্লাব বিশ্বকাপ। জিতলেন তিনটি ট্রফিই। হ্যাটট্রিক হলো জিজুরও।

এক নজরে
-ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা সবচেয়ে বেশিবার জিতেছে বার্সেলোনা, ২০০৯, ২০১১ ও ২০১৫ সালে। গত তিন বছরে দ্বিতীয় শিরোপা জিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে ব্যবধান কমালো এর আগে ২০১৪ সালে জেতা রিয়াল মাদ্রিদ।
-আসরের ফাইনালে এই প্রথম হ্যাটট্রিক করলেন কোনো খেলোয়াড়। পেলেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও।
-রোনালদোর অবশ্য তিনবার ট্রফিতে চুমু খাওয়া হয়ে গেল। ম্যানচেস্টার ইউনাইটের হয়ে ২০০৮ সালেও একবার শিরোপা জিতেছিলেন পর্তুগালের এই তারকা।
-লস ব্ল্যাঙ্কোদের দায়িত্ব নেয়ার পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, উয়েফা সুপার কাপের পর ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপাও জেতা হয়ে গেল জিদানের। তিনটিতেই ম্যাচ গড়িয়েছে অতিরিক্ত সময়ে!
-মজার ব্যপার হলো, রিয়াল মাদ্রিদ অধ্যায় শুরুর পর থেকে জিজু হার দেখেছে মাত্র ২টি আর শিরোপা দেখেছে ৩টি!

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন