শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে

| প্রকাশের সময় : ২৫ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুস্তাফা জামান আব্বাসী : যারা তরুণ তাদের কাছে স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য আছে। থাকতেই হবে, তা না হলে স্বাধীনতা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। স্বাধীন জাতিরা অনেক দূর এগিয়ে যায়, তাদের শক্তি ঐক্যবদ্ধ চিন্তা। অনৈক্য আনে অশান্তি। প্রতিশোধের আগুন আনে মৃত্যুর অন্ধকার।
মৃত্যুর অন্ধকার কূপ থেকেই জেগে উঠবে নতুন সকাল। সিরাজুদ্দৌলার আমলে অন্ধকার কূপের ট্রাজেডির কথা ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা প্রচার করেছিল, কিন্তু ব্যাপারটা ছিল একদম উল্টো। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের সব সম্পদ ‘লুট’ করে নিয়ে গিয়েছিল। ‘লুট’ শব্দটি প্রথম ইংরেজি ভাষায় আশ্রয় নেয় অষ্টাদশ শতাব্দিতে। ‘লুট’-এর পাশে লেখা আছে প্লান্ডার। একাত্তরের স্বাধীনতার পর আমাদের যাবতীয় সামরিক সরঞ্জাম ‘লুট’ হয়ে গিয়েছিল এ কথা এখন স্বাধীনতার বইগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো লুকোনো নয়। কিন্তু যারা ‘লুট’ করবে তারা বেশি দিন ভোগ করতে পারবে না। সমস্ত ইউরোপের ‘লুটেরা’ রা এখন বুঝতে পারছে আফ্রিকা ও এশিয়ায় তাদের শোষণ যেমন টেকে নি তেমনি ইউরোপের মানুষও এখন নিজেরাই শংকিত কিভাবে তাদের আগামী জীবন বয়ে আনবে অতীতের মত সমৃদ্ধি। ‘লুট’ কখনো সমৃদ্ধি আনতে পারে না। একজনের স্বাধীনতা বিপন্ন করে আরেকজন স্বাধীনতার উচ্চ প্রবক্তা হতে পারে না। চিন্তাশীল মানুষ সব কারিগরী ফাঁস করে দেবে। স্বাধীনতা কি তা আমরা বুঝেছি। অনেকে এর অর্থ বুঝেছে অন্য রকম, তা হল অন্যের স্বাধীনতা হরণ, তাদের সম্পদ ‘লুট’ করা এবং নিজেরা ভোগ করা। তা তারা পারবে না। কারণ প্রকৃতি সে নিয়ম সমর্থন করে না। বিধাতা এই নিয়মকে সম্পূর্ণ ধূলিস্মাৎ করে দেবে।
সব সময় বলেছি জাতীয় ঐক্যের কথা। নানা চিন্তার মধ্যেও সমন্বয় আনা। প্রতিশোধ নিতে চাইলে সমন্বয় হবে না। কাউকে বিনা কারণে সাজা দেয়া মনুষ্যত্বের পরিপন্থী। সাজাপ্রাপ্তরা প্রতি দিন প্রতিক্ষণ আল্লাহ্র মেহমান। তাদের অশ্রæতে আল্লাহ্র আরশ কেঁপে উঠে। তাই উচিৎ নতুন স্বাধীনতা প্রাপ্ত জাতিদের নবীর কথা মেনে চলা। পরামর্শ করে চল। একা নয়। সম্পূর্ণ ধূলিস্মাৎ হয়ে যাবে। পৃথিবীর অনেক বড় বড় জাতির চিহ্ন মুছে গেছে। ইতিহাসের কোথাও তাদের খুঁজে পাওয়া যায় নি। কুরআনের পাতায় অনেক জাতির নাম আছে শুধু, আর কোন পরিচয় নেই। আল্লাহ্ মিথ্যার আশ্রয় নেন না। আল্লাহ্র প্রতিটি বাক্য সত্যি। আমরা মুসলমান হয়েও এ কথায় ইমান আনতে পারি না, তাই আমরা পরাজয়ের দ্বার দিয়ে বার বার হেঁটে যাই।
আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বাংলা ভাষা আল্লাহ্র মহান দান ছাড়া আর কিছু নয়। এই দানকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করতে হবে তার প্রতি বিনীত শুকরিয়ার মাধ্যমে। যদি শুকরিয়া না জানাই তাতে আল্লাহ্র কোন ক্ষতি নেই, আমাদেরই ক্ষতি। পৃথিবীতে অনেক মুসলিম রাষ্ট্র আছে। অনেকে ইসলাম মেনে চলেন, অনেকে নয়। আমরা মুসলিম অথচ ঐক্যের প্রধান বাণীটি আমরা ভুলে বসে আছি। যার ফলে আমাদের বার বার ফিরে তাকাতে হচ্ছে পলাশির প্রান্তরের দিকে। আমাদের বিপন্ন অবস্থা থেকে মুক্তির একই পথ। তা হল বিভেদ ভুলে যাওয়া, আক্রোশে অন্ধ না হওয়া, সবার দিকে পবিত্রতার দৃষ্টি, আনন্দের দৃষ্টি, ক্ষমার দৃষ্টি প্রবাহিত করা।
এক বন্ধু জানিয়েছেন ফেসবুকের মাধ্যমে দেশে যখন চলছে পেট্রোল বোমার হাহাকার, তখন তোমাদের এই অবান্তর আলোচনায় কি ফলাফল? বারান্তরে জানিয়েছি মানুষকে দগ্ধ করা কোন মতেই সমর্থন যোগ্য নয়। কখনোই এটা সুফল বয়ে আনতে পারে না। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও জানতে হবে যে আমরা কি একে অন্যকে ধ্বংসের সিদ্ধান্তই নিয়েছি? আমার মনে হয় দেশের তরুণরা এই পরস্পর ধ্বংসের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে। তরুণরা জেগে উঠবেই। তারা জানতে চাইছে, স্বাধীনতার অর্থ কি? ঐ পতাকার পেছনে কি কাজ করেছে যাতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম? আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব না কেন? শুধু দু’টি রাজনৈতিক দলের কারণে? তা হতে পারে না।
অরবিন্দ কেজরিওয়াল তরুণদের শক্তির কথা প্রমাণ করে দিয়েছেন। তাতে ভারতের বড় বড় দলরা নতুন করে ভাবতে বসেছেন ঐ নতুন টুপি পরা ভদ্রলোকের কাছে কি আছে যা তাদের নেই। আমি বলি ওটি হল তারুণ্যের শক্তি, নতুনের শক্তি। ওদের মধ্যেও ভুল হবে, ভ্রান্তি হবে, দলাদলি হবে। তা হলেও নতুনদের শক্তি যে কি বিরাট তা প্রথম বার দিল্লিতে অনুভূত হয়েছে। জনতার মঞ্চ দেখেছি, পরে শাহবাগ, যেখানে অগণিত মোমবাতি নিয়ে প্রতিবাদ, আবার দেখেছি ইসলামের পতাকা নিয়ে আরেক দল তরুণের নিষ্পেষণ। সত্য এর মাঝেই খুঁজে নিতে হবে। সাধারণ মানুষ যারা তারা প্রতিবাদে ক্লান্ত। তারা আর রাস্তায় নামতে চায় না। কি হবে রাস্তায় নেমে? স্বাধীনতার স্বাদ তারা বুঝে ফেলেছেন। এটি কতিপয় মানুষের অধীনতা।
মহান গ্রন্থ সামনেই আছে, তাতে লেখা: সকল মুসলমান [সম্মিলিতভাবে] যেন একটি প্রাচীর, যার প্রতিটি অংশ বাকি অংশগুলোকে দৃঢ় করে। এমনিভাবে, তারা নিশ্চয়ই প্রতিষ্ঠিত হবে একে অন্যের সহায়তায়। তোমার মুসলমান ভাইকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দাও, যদি সে মজলুম হয়, অথবা অত্যাচারী। যদি অত্যাচারী হয়, তা হলে কিভাবে তাকে আমরা সাহায্য করতে পারি? মুহাম্মদ [সা] বললেন: তাকে অত্যাচার করা থেকে নিরস্ত ও নিষেধ করে। মুসলমানরা সবাই কওমের ভাই। কখনো একে অপরের উপর জুলুম করবে না, একে অপরকে সাহায্য করা থেকে বিরত হবে না, একে অপরকে ঘৃণা করবে না। ন্যায়ের আসন হৃদয়ে, তাই যার হৃদয় ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত, সে অপর মুসলমানকে ঘৃণা করতে পারে না। এক জন মুসলিমের যা কিছু আছে, যেমন: তার রক্ত, সম্পত্তি, সুনাম, এর সবই অন্য মুসলিমের জন্য হারাম। কোন ব্যক্তি পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তাই চাইবে যা সে নিজের জন্য চায়। যখন তিন জন মানুষ এক সঙ্গে হবে, তখন তাদের দু’ জন তৃতীয় ব্যক্তিকে শুনতে না নিয়ে চুপিসারে কথা বলবে না। কারণ এতে তৃতীয় ব্যক্তি কষ্ট পায়। সবচেয়ে ভাল মুসলমানদের গৃহ সেটাই, যেখানে এতিম উপকৃত হয়। আর নিকৃষ্ট সেই মুসলিম গৃহ, যেখানে এতিম হয় নিগৃহিত। আল্লাহ্র চোখে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে ভাল, যে তার বন্ধুদের চোখে সবচেয়ে ভাল। আর আল্লাহ্র নিকটবর্তিদের মধ্যে সেই সবচেয়ে ভাল, যে তার আপন প্রতিবেশিদের চোখে সর্বোত্তম। সমস্ত মুসলমান কওম মিলে যেন একটি মানব দেহ, একটি মানুষের চোখে ব্যথা হলে বা মাথা ব্যথা হলে যেমন সারা শরীরে সেই কষ্টবোধ ছড়িয়ে থাকে।
উপরের কথাগুলো নবীর। এগুলোকে যিনি মূল্য দেবেন না, তিনি আর যাই হোন মুসলমানিত্বের দাবি বঞ্চিত। চার দিকে প্রশ্ন, আমরা মুসলমান না অন্য কিছু। এ প্রশ্নের উত্তর জানতেন যারা প্রাণ দিয়েছেন। আমরা মুসলমান হিসেবেই বেঁচে থাকতে চাই। যারা বেঁচে আছি তারা প্রশ্নগুলোর মীমাংসা চায়। তর্ক নয়, মীমাংসা। বাংলাদেশের নি¤œাঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ সাগরের পানিতে ডুবে যাবে। এটাই আবহাওয়াবিদদের খবর। এ দিকে আমরা বেঁচে থাকতেই ডুবে যাব অথৈ সলিলে, তা কি করে হয়।
স্বাধীনতাহীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না। অতীতের বর্ণ হিন্দুদের চিন্তা ছিল আলাদা, মুসলমানদের আলাদা। দু’টোর সমাধান হয় নি। নজরুল চেয়েছিলেন সমাধান, শেরেবাংলাও, সোহরাওয়ার্দিও। আমরা চিরতরে ভাগ হয়ে গেছি। তরুণরা এর মধ্যেও চায় মিলনের গান, মিলনের কবিতা। পুরনো দিনের বিবাদ মিটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। রান্নাঘর আলাদা হয়েছে, তাতে কি? নানা উৎসবে আমরা একই গান গাইব। আমরা একই মানুষ।
তেমনি বাংলাদেশের দু’টি প্রধান দল কেন এক হতে পারবে না? কেন কষ্টার্জিত স্বাধীনতা হবে এদের পরস্পর মালিন্যের ক্রোধে আক্রান্ত? আমি নিশ্চিত আজকের দিনে সব মানুষের এইটাই প্রশ্ন।
সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন