সরকার আদম আলী, নরসিংদী থেকে : রায়পুরার নিলক্ষারচরে আওয়ামী লীগের দুই লাঠিয়াল বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত ৮টি হত্যাকান্ডসহ ১৪টি মামলার আইন ও আদালতের সমাধান আবারো তিরোহিত হয়ে গেছে। গত মঙ্গলবার রায়পুরার এমপি, সাবেক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, বর্তমান চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম ও সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হক সরকারের নেতৃত্বাধীন দুই লাঠিয়াল বাহিনীর নেতাদের ডেকে দুইপক্ষকে ২২ লাখ টাকা জরিমানা নির্ধারণের মাধ্যমে এসব হত্যাকান্ড ও দাঙ্গা ঘটনার শালিসি মীমাংসা দিয়েছেন। ২০১৪ সালের পূর্বে সংঘটিত এমনি ৪টি হত্যা ও কয়েকটি দাঙ্গা সংক্রান্ত মামলা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের পর গত ২ বছরাধিককালে পুনরায় ৮টি হত্যাকান্ডসহ ৯টি দাঙ্গা সংঘটিত হয়। আর এ থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা নিচ্ছে এক শ্রেণীর রাজনীতিক, লাঠিয়াল সরদার, গ্রাম্য মোড়ল ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা। বার বারই সেখানে গ্রাম্য দাঙ্গার সৃষ্টি হচ্ছে, অকাতরে মানুষ মরছে, পঙ্গু ও সম্পদ হারা হচ্ছে, বহুসংখ্যক মানুষ। স্বাধীনতা উত্তরকালে এই নিলক্ষার চরে কমবেশি ৪০টি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু কোনো হত্যাকান্ডের বিচারই আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারেনি। কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহল তাদের নিজেদের স্বার্থে কথিত শালিস-দরবারের মাধ্যমে মামলাগুলো নষ্ট করে দিয়েছে। যুগ যুগ ধরে এই কথিত শালিস দরবারের কারণেই নিলক্ষারচরে একের পর এক দাঙ্গা, হাঙ্গামা, টেঁটাযুদ্ধ, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটে চলছে। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, রায়পুরার নিলক্ষারচরে টেঁটাযুদ্ধ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামার মূল কারণ হচ্ছে গ্রাম্য মোড়লিপনা। মেঘনার মাছের ঘের এবং চরাঞ্চলের জমি দখল নিয়ে গ্রাম্য মোড়লরা একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপনের জন্য লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করে। এরপর তারা যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে তাদের ছত্রছায়ায় চলে যায়। রাজনৈতিক নেতারা তাদেরকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে আশ্রয় দেয়। প্রাপ্ত তথ্য মতে, নিলক্ষারচরের ৮/৯টি গ্রামের প্রতিটি গ্রামেই একাধিক লাঠিয়াল বাহিনী রয়েছে। হরিপুর নামে শুধু একটি গ্রামেই রয়েছে ২২টি লাঠিয়াল বাহিনী। জাতীয় সংসদ, উপজেলা পরিষদ বা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এলেই লাঠিয়াল বাহিনীগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। ২০১৪ সালের পূর্বে এই গ্রাম্য মোড়লিপনাকে নিয়ে ৪টি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। মামলাও হয় ৭/৮টি। এসব ঘটনা নিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে তৎকালীন মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু ২০১৪ সাল গত ১৩ মে এক সালিশের মাধ্যমে মামলাগুলোর আপস-মীমাংসা করে দেন। এতে দুই পক্ষের কয়েক দফা টেঁটাযুদ্ধে ৪টি হত্যাকান্ডের জন্য জরিমানা ধার্য করা হয় সাড়ে ২২ লাখ টাকা ও বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের জন্য সাড়ে ৩ লাখ টাকা। কিন্তু এ আপস মীমাংসার রেশ কাটতে না কাটতেই বীরগাঁও গ্রামের মহাজন বাড়ির নাসু মিয়া ও সরকার বাড়ির আনোয়ার হোসেনের পক্ষের লোকজনের মধ্যে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। এতে টেঁটার আঘাতে ঘটনাস্থলেই ইয়াকুব আলী (৫০) নামে নাসু গ্রæপের আর একব্যক্তি মারা যায়। রায়পুরা থানা আওয়ামী লীগ নিলক্ষা ইউনিয়নে ৫ বার নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হক সরকারকে মনোনয়ন না দিয়ে তাজুল ইসলাম নামে একব্যক্তিকে মনোনয়ন দেয়। এ নিয়েই শুরু হয় নতুন করে দুই আওয়ামী লীগ নেতার মধ্যে বিরোধ। নির্বাচনের দিন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী তাজুল ইসলামের লাঠিয়াল বাহিনী জোরপূর্বক কেন্দ্র দখল করে নির্বাচনে জয়লাভ করার পর পরই শুরু হয় সেখানকার দাঙ্গা, টেঁটাযুদ্ধ, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, আর মানুষ খুনের ঘটনা। ৩টি হত্যাকান্ডের ঘটনায় রায়পুরা থানায় মামলা রুজু হলেও ৫টি হত্যাকান্ডের কোনো মামলা নেয়নি থানা পুলিশ। আদালত মামলা রুজু করার নির্দেশ দিলেও দীর্ঘদিন যাবত ৫টি হত্যামামলাই রায়পুরা থানা পুলিশ ধামাচাপা দিয়ে রাখে। এরপরও আরো কয়েকটি দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা ঘটে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২/৩শ’ বাড়িঘর। গত ১৪ নভেম্বর সংঘটিত হয় সর্বশেষ দাঙ্গা-হাঙ্গামা। গত মঙ্গলবার রায়পুরার এমপি রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু রায়পুরা ডাকবাংলোয় বসে সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হক সরকার ও বর্তমান চেয়ারম্যান তাজুল ইসলামের লাঠিয়াল বাহিনীর মধ্যে সৃষ্ট বিরোধ মীমাংসা করেন। তবে জরিমানাকৃত ২২ লাখ টাকা কিভাবে ব্যয় করা হবে তা জানা যায়নি। তবে জনগণ বলছে, অতীতে কোনো মীমাংসাই স্থায়িত্ব পায়নি। এবার ৮টি হত্যাকান্ডের ঘটনা মীমাংসার নীতি ও পদ্ধতিগত দিক দেখেই বুঝা যায় এই মীমাংসাও বেশিদিন টিকবে না। হত্যাকান্ডের বিচার আইন ও আদালতের ভিত্তিতে না হলে কোনো সমাধানই স্থায়িত্ব লাভ করবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন